ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালা। তরজমা স্বাতী রায়
সূর্যাস্তের সময় বাগামোয়ো শহরে প্রবেশ করলাম। "আরও তীর্থযাত্রী শহরে আসে," বেউলাতে এই কথাগুলো শোনা গেল। "শ্বেতাঙ্গ লোকটি শহরে এসেছে," আমরা বাগামোয়োতে এই শব্দগুলো শুনলাম। আর আগামীকাল আমরা জল পেরিয়ে জাঞ্জিবারে যাব, সোনার দরজা দিয়ে প্রবেশ করব; আর কিছুই দেখতে হবে না, কোন গন্ধ শুঁকতে হবে না, আর পেটের পক্ষে আপত্তিকর কিছুর স্বাদ আর পেতে হবে না!
কিরাঙ্গোজি তার শিঙা বাজাতে থাকল, আস্টলফো১-এর জাদু-শিঙ্গার মতন প্রায় বিস্ফোরণের সম্ভাবনা দেয় আর কি! স্থানীয়রা ও আরবরা আমাদের চারপাশে ভিড় করে এলো। আর সেই উজ্জ্বল পতাকা, যার নক্ষত্রগুলি মধ্য আফ্রিকার বিশাল হ্রদের জলের উপর দুলেছিল, যেটি উজিজিতে দুর্দশাগ্রস্ত, নির্যাতিত লিভিংস্টোনের কাছে ত্রাণের প্রতিশ্রুতি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল, সে আবার সমুদ্রে ফিরে এলো - ছেঁড়া অবস্থায় তা সত্য, তবে কোন ভাবেই অসম্মানিত নয়- ছিন্ন-ভিন্ন, কিন্তু পূর্ণ-সম্মানে।
শহরের কেন্দ্রে পৌঁছে, একজন শ্বেতাঙ্গকে দেখতে পেলাম। একটা বড়, সাদা বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়েছিলেন। আমারই মতো ফ্ল্যানেল ও হেলমেট তাঁর পরনে; অল্পবয়সী, লালচে-গোঁফওলা; ঝকঝকে, প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মুখ, একদিকে সামান্য হেলানো মাথাটি তাঁর চেহারাতে একটা বেশ চিন্তাশীল ভাব এনে দিয়েছিল। শ্বেতাঙ্গটি আমারই মতো মনে হল। তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম। তিনিও আমার দিকে এগিয়ে এলেন, আমরা করমর্দন করলাম – পরস্পরকে জড়িয়ে ধরাটুকুই যা শুধু বাদ রইল।
“ভেতরে আসবেন না?” তিনি বললেন.
“ধন্যবাদ।”
"কী নেবেন - বিয়ার, স্টাউট, ব্র্যান্ডি? ওহো, বাই জর্জ! আপনার দুর্দান্ত সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানাই,” তিনি আবেগাভিভূত হয়ে বলে উঠলেন।
তখনই তাঁকে বুঝে ফেললাম। ইনি একজন ইংরেজই হবেন । এরকম কাজ করা তাদেরই অভ্যাস; তবে মধ্য আফ্রিকায় ব্যাপারটা একটু অন্যরকম ছিল। (“অসাধারণ সাফল্য! এইভাবেই কি আমার অভিযানকে দেখা হবে? তবে তাও ভাল। কিন্তু ইনি কীভাবে এসম্পর্কে জানলেন? ওহ, ভুলেই গেছি। আমার দূতেরা কথা রটিয়েছে, বুঝলাম।)
“ধন্যবাদ। যা দেবেন তাতেই চলবে।”
“আসুন একটু বিয়ার খাই। এই ছোকরা তাড়াতাড়ি দে, না হলে তোকে পিটিয়ে ছাতু করব," সে হেঁকে-ডেকে বলল।
তারপর যা কথাবার্তা হল, তার আর বিশদ বিবরণ দিয়ে কী হবে! শীঘ্রই তাঁর নিজস্ব লঘুচালে, মজা করে জানালেন তিনি কে, কেন এসেছেন, তাঁর কী আশা-আকাঙ্ক্ষা, কেমন ধ্যান ধারণা আর বিভিন্ন বিষয়ে তিনি কীই বা মনে করেন। তিনি হলেন লেফটেন্যান্ট. উইলিয়াম হেন, আর.এন। রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি লিভিংস্টোনকে খুঁজে বের করার ও ত্রাণ পাঠানোর জন্য যে লিভিংস্টোন অনুসন্ধান ও ত্রাণ অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে, সে অভিযানের তিনি নেতা। অভিযানের পরিকল্পনার গোড়ায় লেফটেন্যান্ট. লেওয়েলিন এস ডসন-কে এর নেতা হিসেবে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু আমার লোকদের থেকে তিনি যখন শুনেছিলেন যে আমি লিভিংস্টোনকে খুঁজে পেয়েছি, তখন তিনি জাঞ্জিবারে চলে গিয়েছেন, আর ডক্টর জন কার্কের সঙ্গে পরামর্শ করার পরে, পদত্যাগ করেছেন। তার এখন আর কোন দায়িত্ব নেই, সকল দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে লেফটেন্যান্ট. হেনের উপর দেওয়া হয়েছে। মোম্বাসার একজন মিশনারি মিস্টার চার্লস নিউও এই অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনিও দায়িত্ব ত্যাগ করেছেন। অগত্যা এখন পরে আছেন লেফটেন্যান্ট. হেন ও মিস্টার অসওয়াল্ড লিভিংস্টোন, ডাক্তারের দ্বিতীয় পুত্র।
“মিস্টার অসওয়াল্ড লিভিংস্টোন এখানে?" আমি বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ; তিনি সোজা এখানেই আসছেন।”
“আপনি এখন তাহলে কি করবেন ?” আমি জানতে চাইলাম।
“মনে তো হয় না যে এরপর আর যাওয়ার কোন মানে হয়! আপনি আমাদের পালের হাওয়া পুরো কেড়ে নিয়েছেন। যদি আপনি তাঁর প্রয়োজন মিটিয়েই থাকেন, তবে আর আমার গিয়ে কী লাভ? আপনার কি মনে হয়?”
“দেখুন, এটা অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল। আপনাকে ঠিক কি হুকুম দেওয়া হয়েছে সেটা আপনিই সবচেয়ে ভাল জানেন। .আপনি যদি কেবল তাকে খুঁজে বার করতে ও তাঁকে আরও রসদ জোগাতে এসে থাকেন, তাহলে আপনাকে সত্যই বলতে পারি যে তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেছে, রসদও দেওয়া হয়েছে। কয়েকটিন মাংস ও আর কয়েকটা খুচরো জিনিস ছাড়া আর কিছুই তার দরকার নেই। তার নিজের হাতে লেখা প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকা আমার সঙ্গেই আছে। তবে তার ছেলেকে তো যেভাবেই হোক যেতে হবে, এবং সে বাবদে প্রয়োজনীয় লোকলস্কর আমি যথেষ্ট সহজেই পেয়ে যাব।”
“আচ্ছা, তিনি স্বস্তিমত থাকলে আর আমার গিয়ে কোনো লাভ নেই।’
“ভেবেছিলাম ভাল ভাল শিকার করব। আমি শিকার করতে খুব পছন্দ করি। একটা আফ্রিকান হাতিকে মারার যে আমার কত শখ!”
“হ্যাঁ, লিভিংস্টোনের আপনাকে প্রয়োজন নেই। তিনি জানিয়েছেন যে তাঁর কাছে প্রচুর রসদ আছে— তাঁর হাতের কাজ আরামদায়কভাবে শেষ করার জন্য সেই রসদ যথেষ্ট! আর নিশ্চয় তিনিই এটা সব থেকে ভাল বুঝবেন। তাঁর কোন কিছুর অভাব থাকলে তিনি নিশ্চয় সে কথা তালিকায় উল্লেখ করতেন। এর বেশি জিনিসই বরঞ্চ তার কাছে বাধা হবে। -সেসব বইবার লোক তো পাবেন না। এখানে কি কি আছে?"
তিনি মৃদুহাস্যে বললেন, “আমাদের ভাণ্ডার কাপড় ও পুঁতিতে ভরা। একশ নব্বইটারও বেশি বস্তা রয়েছে।”
“একশ নব্বই খানা মোট! ”
“হ্যাঁ ”
“আরে, এত মালপত্র নিয়ে কোথায় যাবেন? এত জিনিস বইবার মত যথেষ্ট লোক তো পুরো উপকূলেই নেই। একশ নব্বই বোঝা! সেসব বইতে তো অন্তত আড়াইশ লোক লাগবে, কারণ কমপক্ষে পঞ্চাশ জন অতিরিক্ত লোক তো নিতেই হবে!”
এই সময়ে একজন লম্বা, হালকা, অল্প বয়স্ক, ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন। ফ্যাকাশে গাত্রবর্ণ, পাতলা চুল, কালো ঝকঝকে চোখ, আমার সঙ্গে তাঁকে মিঃ অসওয়াল্ড লিভিংস্টোন নামে পরিচয় করানো হল। এই ভূমিকা অবশ্য প্রায় অপ্রয়োজনীয় ছিল, কারণ তাঁর চেহারায় তাঁর বাবার অনেকটাই ছাপ আছে। তাঁকে দেখলে বেশ স্থিরপ্রতিজ্ঞ বলে মনে হয়। আর তিনি আমাকে যেভাবে অভিবাদন করলেন, তার থেকে মনে হল তিনি বরং বেশ সংযতবাক। আমার অবশ্য মনে হল এটা তার ভবিষ্যতের জন্য ভাল কারণ আমি এই গুণটাকে নতুন ধারণা আশুগ্রাহিতার প্রকাশ হিসেবে দেখলাম। এই দুই যুবকের মত বিপরীতমুখী চরিত্র খুব কমই একসঙ্গে উপস্থিত হয়েছে। একজন চঞ্চল, অনাবশ্যক, অসংলগ্ন, প্রফুল্ল, অনিয়ন্ত্রিত জীবনীশক্তিতে সদা ফুটন্ত, অপ্রতিরোধ্য-রকমের অদম্য, হাসিখুশি ও আনন্দময়। অন্যজন শান্ত, সামান্য কঠোরও, সদা-অবিচলিত আচরণে, বিনীত রাশভারী, অটল-সংকল্পবদ্ধ, স্থিরতার প্রতিমূর্তি, তবে তার চোখের ঝিলিক অটল অভিব্যক্তিতে প্রাণসঞ্চার করে। দুজনের মধ্যে, আমার মতে পরের জন এমন একটি অভিযানের যোগ্যতর নেতা হতেন; যদিও উচ্ছল, সাহসী, সদা স্ফূর্তিতে ফুটতে থাকা হেনের যদি অন্যরকমের কালসহ গুণাবলী থাকে—যে সকল গুণ দৈহিক গঠনতন্ত্রের অংশ নয়, বরং মনের সঙ্গে যুক্ত - পুনঃ পুনঃ বিপর্যয়, জ্বর-জ্বালা, দুঃখ-কষ্ট ও অসুবিধার মধ্যেও ধৈর্য না হারানো ও সেসব সহ্য করার নৈতিক সাহস যদি তার থাকে, তাহলে সে একজন যোগ্য সঙ্গী বটে। মনে হল, লিভিংস্টোন প্রকৃতিগত ভাবে দায়িত্বের বোঝাকে বইতে সক্ষম। হেন যদিও পুরুষত্বের গুণসমূহ অর্জন করেছেন, তবু তাঁর স্বাভাবিক প্রাণোচ্ছলতা ও আবেগপ্রবণতার কারণে এই ধরনের দায়িত্বের জন্য এখনও খুব কম বয়সী বলে মনে হয়েছিল।
“আমি লেফটেন্যান্ট হেনকে বলছিলাম যে তিনি যান আর নাই যান, আপনাকে আপনার বাবা মিস্টার লিভিংস্টোনের কাছে যেতেই হবে।”
“ওহ, আমিও যাব বলেই ঠিক করেছি।”
“হ্যাঁ, সেটাই ঠিক। আপনাকে ঠিকমত লোকজন দিয়ে দেব, আপনার বাবার কী রসদ প্রয়োজন তাও দেব। আমার লোকেরা আপনাকে ইউন্যান্যেম্বেতে নিয়ে যাবে - কোন সমস্যা হবে না। ওরা রাস্তাঘাট ভালই জানে, সেটা একটা বড় সুবিধা। তারা জানে কিভাবে নিগ্রো সর্দারদের মোকাবিলা করতে হয়, তাদের সম্পর্কে আপনার মাথা ব্যথা করারও দরকার নেই, শুধু হাঁটতে হবে। যেটা সবথেকে বেশি দরকার তাহল খুব দ্রুতগতিতে চলা. আপনার বাবা জিনিসপত্রের জন্য অপেক্ষা করবেন।”
“সেরকম হলে আমি ওদের খুবই তাড়াতাড়ি হাঁটাব।”
“হ্যাঁ, ওরা তো মোট ছাড়া হাঁটবে, কাজেই সহজেই লম্বা পথ পাড়ি দিতে পারবে।”
ব্যাপারটা ওখানেই মিটে গেল। হেন মনস্থ করলেন যে, ডাক্তারকে যেহেতু রসদের যোগান দেওয়া হয়েছে, তাঁর আর যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু, আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করার আগে, তিনি একবার ডক্টর কার্কের সঙ্গে পরামর্শ করতে চাইলেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি হেরাল্ড অভিযানের সঙ্গে পরের দিন জানজিবারে যাবেন।
দুপুর দুটোয় আমি আরামদায়ক এক বিছানায় গা ঢেলে দিলাম। শয়নকক্ষের কিছু কিছু জিনিসপত্র যেমন হ্যাভারস্যাকস, ন্যাপস্যাকস, পোর্টম্যান্টো, চামড়ার বন্দুকের বাক্স-এসবের থেকে একটা দারুণ নতুন নতুন গন্ধ বেরোচ্ছে। নতুন অভিযানে হাত পাকাচ্ছে তো এঁরা, এখনও ভাল মতন বুদ্ধি পাকেনি; সবারই প্রথম প্রথম এমন হয়, তবে আফ্রিকার অন্দরমহল থেকে একবার ঘুরে এলেই এইসব বাড়াবাড়ি উবে যাবে।
আহ! বিছানায় শুয়ে কী যে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললাম! ভাবলাম, “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! আমার হন্টনপর্ব শেষ হল।”