ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনি। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে এক আফ্রিকান গোষ্ঠীর বিরুদ্ধ যুদ্ধের বর্ণনা। তরজমায় স্বাতী রায়
৩ অগাস্ট আমরা এমফুটো ছেড়ে মিরাম্বোর সঙ্গে যুদ্ধের জন্য রওনা দিলাম। আফ্রিকান সর্দারকে হারাতে পারলে উজিজির উদ্দেশে যাত্রা করার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় আমার সব মালপত্র এমফুটোতে রাখা রইল। আমাদের কপালে যাই থাকুক না কেন, মালগুলো অন্তত নিরাপদ জায়গায় রইল।
উমান্দায় পৌঁছানোর ঢের আগেই, আমি পালাজ্বরের প্রচণ্ড আক্রমণের ঘোরে হ্যামকে পড়ে রইলাম, সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত জ্বর ছাড়েনি। এমফুটো থেকে ছয় ঘন্টা দূরের উমান্ডায় পৌঁছে আমাদের যোদ্ধারা সারা গায়ে একটা ওষুধ মাখল, তাদের ওঝারা সে ওষুধ বানিয়ে দিয়েছে- একটা ভেষজ যার গুণাগুণ শুধু ন্যামওয়েজির গাঙ্গারাই জানে, তার রসের সঙ্গে মাটামার আটা মিশিয়ে তৈরি সেই ওষুধ।
৫ অগাস্ট সকাল ছটায় আমরা আবার যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলাম, গ্রাম থেকে বেরোনোর আগে, এক ন্যামওয়েজি বক্তা ‘মানেনো’ বা বক্তৃতা দিল।
‘‘শব্দ! শব্দ! শব্দ! শোন, এমকাসিওয়ার ছেলেরা, উন্যামওয়েজির সন্তানেরা শোন! তোমাদের সামনে দুস্তর পথ, বনের চোরেরা অপেক্ষা করছে; হ্যাঁ, তারা চোর, তারা তোমার কাফেলা ধ্বংস করবে, তোমার হাতির দাঁত চুরি করবে, তোমার নারীদের হত্যা করবে। দেখো, আরবরা তোমাদের পাশে আছে, আরবের সুলতানের রক্ষকেরা ও শ্বেতাঙ্গরা তোমাদের সঙ্গে আছে। যাও, এমকাসিওয়ার ছেলেরা রয়েছে তোমাদের সঙ্গে; যুদ্ধ কর, হত্যা কর, ক্রীতদাস লুঠ করো, কাপড় নাও, গবাদি পশু নাও, মারো, পেট ভরে খাও! যাও!’’
এই জোরালো বক্তৃতার পরে একটা জোর, বন্য চিৎকার হল আর তারপর গ্রামের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হল, লাল নীল ও সাদা পোশাক পরা সৈন্যরা মল্লবিদদের মত লাফাতে লাফাতে আর অবিরাম গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বেরিয়ে এল; গুলির শব্দ নিজেদেরই উত্সাহিত করার জন্যে বা জিম্বিজোর দুর্গপ্রাকারের অন্তরালে সুলতান কোলঙ্গোর প্রাসাদে যারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে তাদের প্রাণে ভয় জাগানোর জন্য।
জিম্বিজো উমান্ডা থেকে মাত্র পাঁচ ঘন্টার দূর, সকাল এগারটায় আমরা জায়গাটা দেখতে পেলাম। বনের ছায়ায় আমরা এই জায়গার চারপাশের চাষের জমির প্রান্তে এসে থামলাম। বেশ কয়েকজন প্রধান তাদের দলবলকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছিল যে দূর্গে গুলি ছোঁড়ার দূরত্বের মধ্যে না পৌঁছানো অবধি গুলি যেন না চালানো হয়।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চুপিসারে খামিস বিন আবদুল্লাহ গ্রামের পশ্চিম দিকে চলে গেল। ন্যামওয়েজিরা প্রধান প্রবেশ পথের সামনে রইল, ডানদিকে সৈয়দের ছেলে সৌদের বাহিনী ও বাঁ দিকে হাবিবের ছেলেরা তাদের সাহায্যার্থে দাঁড়িয়ে। আবদুল্লাহ, মুসৌদ, আমি এবং অন্যরা পূর্ব দিকের দরজাগুলো আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত, এই ব্যবস্থায় একমাত্র উত্তর দিক বাদ দিয়ে আর সব দিক দিয়েই তারা প্রকৃতপক্ষে বন্দি।
যেই আমরা বন থেকে বেরিয়ে উন্যানয়েম্বের রাস্তা ধরে উঠলাম, আচমকা আমাদের দিকে এক ঝাঁক গুলি ছুটে এল, যে দিক দিয়ে শত্রু সৈন্য হানা দেবে বলে তারা অনুমান করেছিল সেই দিক বরাবর আক্রমণ শুরু হল, আর সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণকারী বাহিনীও খুব চমত্কার ধরণে তাদের গুলির প্রত্যুত্তর দিতে লাগল। কিছু কিছু হাস্যকর দৃশ্যও তৈরি হচ্ছিল বৈকি- কেউ কেউ গুলি চালানোর ভান করছিল, তারপর একপাশে ঝাঁপ দিচ্ছিল, তারপর সামনের দিকে, তারপরে পিছনের দিকে, লাফ দিতে থাকা ব্যাঙের মত তৎপর ভাবে- তবে যুদ্ধটা বেশ জবরদস্ত হচ্ছিল। আমার সৈন্যদের ব্রীচ লোডার বন্দুকগুলো আমার পছন্দের চেয়ে অনেক দ্রুতবেগে আমার ধাতব কার্তুজগুলো গ্রাস করছিল; আনন্দের কথা এই যে একটা সময় গুলি চলা বন্ধ হল আর আমরা পশ্চিম, দক্ষিণ, উত্তর দিক দিয়ে, দরজা দিয়ে, মেরি অ্যানড্রুজের মত লম্বা বেড়া টপকে দল বেঁধে গ্রামে ঢুকে পড়লাম। আমাদের বাহিনীর দ্রুতগামী সৈন্যদের তাড়া খেয়ে বেচারা গ্রামবাসীরা উত্তরের দরজা দিয়ে ঘেরের থেকে পাহাড়ের দিকে ছুটে পালাচ্ছিল, আর ব্রীচ-লোডার ও শট-গানের গুলি লাগছিল তাদের পিঠে।
গ্রামটা বেশ ভালভাবেই সুরক্ষিত, আর কুড়িটার বেশি মৃতদেহ পাওয়া যায়নি, ওদের শক্ত পুরু কাঠের বেড়া আমাদের গুলির বিরুদ্ধে দারুণ সুরক্ষা দিয়েছিল।
সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে সৈন্য রেখে, জিমবিজো থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, আর এক ঘন্টার মধ্যে আশেপাশের এলাকা থেকে শত্রুদের সাফ করে দিলাম, আরও দু’টো গ্রাম দখল করলাম, সমস্ত মূল্যবান জিনিসপত্র লুঠে নেওয়ার পরে গ্রাম দুটোতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। প্রচুর পরিমাণে শস্য ছাড়াও লুঠের মাল হিসেবে আরবদের ভাগে কিছু হাতির দাঁত আর জনা পঞ্চাশেক ক্রীতদাস পড়ল।
তারপর সাতশো আরব ও ক্রীতদাসদের একটি দল আশেপাশের সব জায়গায় শত্রু মুক্ত করল আর উইল্যানকুরুর দূর্গ অবধি আগুন লাগাল ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাল।
নয় তারিখে, সৌদ বিন সৈয়দ ও আরও প্রায় বিশ জন আরব যুবক পাঁচশো জনের একটা বাহিনী নিয়ে খোদ উইল্যানকুরুই আক্রমণ করল। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে মিরাম্বো সেখানেই বসবাস করছে। আরেকটা দল গেল জিম্বিজোর অল্প উত্তরে জঙ্গলে-ঢাকা নিচু পাহাড়ের দিকে। এইখানে তারা এক ঘুমন্ত বন-চোর যুবককে ধরে তার মাথাটা পিছনের দিকে টেনে ছাগল বা ভেড়ার মত কেটে দিয়েছিল। আরেকটা দল দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেল আর মিরাম্বোর গেরিলা যোদ্ধাদের একটা দলকে হারিয়ে দিয়েছিল, আমরা দুপুরে খবরটা পেলাম।
সকালে আমি সাইদ বিন সালিমের টেম্বেতে গেলাম। পাছে জঙ্গলের মধ্যে শত্রুরা লুকিয়ে থাকে তাই জিমবিজোর জঙ্গলের লম্বা ঘাস পোড়ানোটা যে কতটা জরুরী সেটাই তাকে বোঝাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরেই আমি আবার পালাজ্বরে আক্রান্ত হলাম, কাজেই ঘরে ফিরে আসতে বাধ্য হলাম আর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম যাতে ঘামতে শুরু করি। তবে শ আর বোম্বেকে আগেই আদেশ দিয়েছিলাম যে আমার কোনও লোক যেন শিবির ছেড়ে না যায়। তবে কদিন পরেই সেলিম আমাকে জানাল যে অর্ধেকেরও বেশি লোক সৌদ বিন সাইদের সঙ্গে উইল্যানকুরু আক্রমণে গেছে।
সন্ধ্যে ছটা নাগাদ জিমবিজোর গোটা শিবির তড়িতাহত হয়ে শুনল সৌদ বিন সৈয়দের সঙ্গে যে সকল আরব গিয়েছিল তারা সবাই মারা পড়েছে: আর তার দলের অর্ধেকেরও বেশি লোক নিহত। আমার নিজের দলের কয়েকজন ফিরে এসেছে, তাদের কাছ থেকে শুনলাম যে গ্রান্টের প্রাক্তন ভ্যালে উলেদী, মাব্রুকি খাতিলাবু(পিতৃহন্তা), মাব্রুকি(ছোটজন), উসসেগুহার বারুতি ও ফেরাহান মরে গেছে, এও জানলাম যে ওরা খুব তাড়াতাড়িই উইল্যানকুরু দখল করতে পেরেছিল। মিরাম্বো আর তার ছেলেও ছিল সেখানে, এরা যেই দলবল নিয়ে গ্রামে ঢুকেছে, মিরাম্বো তার লোকদের জড়ো করে গ্রাম ছেড়ে পালায়। তারপর উইল্যানকুরু আর জিম্বিজোর মাঝে রাস্তার দু’পাশে ওঁত পেতে বসে থাকে। আক্রমণকারী দলটা যখন ফিরে আসছিল, তাদের সঙ্গে ছিল একশোরও বেশি হাতির দাঁত, ষাট গাঁটরি কাপড়, আর দুশ-তিনশ ক্রীতদাস, মিরাম্বোর লোকেরা হঠাৎ তাদের দু’দিক দিয়ে লাফিয়ে উঠে বর্শা দিয়ে আঘাত করে। বীর সৌদ তার দোনলা বন্দুক ছুঁড়ে দু'জনকে গুলি করে, আর যখন সে বন্দুকে ফের গুলি ভরছিল, তখন একটা বর্শা এসে তাকে এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দেয়: বাকী সব আরবদেরও একই দশা হয়। যে শত্রুদের হারিয়ে দিয়েছে বলে ভেবেছিল, তাদের এই আকস্মিক আক্রমণে দল এতটাই নিরাশ হয়ে পড়েছিল যে, লুঠের মালপত্র ফেলে সবাই দে-দৌড়। তারপর বনের মধ্য দিয়ে অনেক ঘুরে ফিরে তারা জিম্বিজোতে ফিরে আসে আর এই দুঃখের গল্প শোনায় সকলকে।
এই পরাজয়ের প্রভাব বর্ণনাতীত। যাদের স্বামী মারা গেছে সেই মেয়েরা বিলাপ করছিল- কান্নার শব্দে ঘুমানো যাচ্ছিল না। সারা রাত তারা চিৎকার করে কাঁদছিল। শত্রুর অগোচরে ঘাসের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে যে আহতরা পালিয়ে আসতে পেরেছিল, কখনও কখনও তাদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। সারা রাত ধরে দলছাড়ারা একজন একজন করে ফিরে আসছিল। তবে আমার দলের যাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল, তাদের কথা আর কখনও শোনা যায়নি।
সাত তারিখটা ছিল দুঃখের দিন, পশ্চাদপসরণের দিন, অবিশ্বাসে ভরা দিন; শান্তিপূর্ণভাবে ব্যাপারটা মেটানোর সবরকম চেষ্টা না করেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আরবরা একে অপরকে দোষ দিতে লাগল। যুদ্ধ নিয়ে উত্তপ্ত বৈঠক বসল, সেখানে কয়েকজন অবিলম্বে উন্যানয়েম্বেতে ফিরে গিয়ে নিজেদের বাড়িতে লুকিয়ে থাকার প্রস্তাব তুলল। খামিস বিন আবদুল্লাহ, অপমানিত সম্রাটের মত, তার স্বদেশীদের ঘৃণ্য ভীরুতার বিরুদ্ধে সরব হলেন। এই তেতে-ওঠা মিটিং ও পশ্চাদপসরণ করার প্রস্তাব শীঘ্রই পুরো শিবির জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আর অন্যসব কারণের তুলনায় এই কথাতেই ন্যামওয়েজি ও ক্রীতদাসদের সম্মিলিত বাহিনী সম্পূর্ণরূপে হতাশ হয়ে পড়ল। আমি বোম্বেকে সাইদ বিন সেলিমের কাছে পাঠালাম এই কথা বলতে যে, তারা যেন পশ্চাদপসরণ করার কথা না ভাবে। একবার পিছু হটলে সেটা মিরাম্বোকে উন্যানয়েম্বে অবধি যুদ্ধ টেনে নিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানোর সমতু্ল্য হবে।
এই বার্তা দিয়ে বোম্বেকে পাঠানোর পর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু দুপুর দেড়টা নাগাদ সেলিম আমাকে ডেকে তুলল, ‘‘কর্তা, উঠুন, সবাই পালাচ্ছে, খামিস বিন আবদুল্লাহ নিজেও পালাচ্ছেন।’’ সেলিমের সাহায্যে জামাকাপড় পরে নিলাম, আর টলতে টলতে দরজার দিকে এগোলাম। প্রথমেই দেখলাম থানি বিন আবদুল্লাহকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সে আমাকে দেখেই চিৎকার করে বলে উঠল ‘সাহেব, তাড়াতাড়ি পালান- মিরাম্বো আসছে।’ তারপর সে আবার জ্যাকেট পরতে পরতে ঘুরে দৌড়াতে শুরু করল, ভয়ে তার চোখ দুটো প্রায় গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিল। খামিস বিন আবদুল্লাহও চলে যাচ্ছিলেন, পালানোর দলে তিনিই ছিলেন শেষ আরব। আমার দু’জন লোকও তার পিছন পিছন পালাচ্ছিল; সেলিম তাদের রিভলভার দিয়ে ভয় দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল। শ মিরাম্বোর কোমল করুণার ভরসায় আমাকে ফেলে রেখে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আমার জিন তার গাধার পিঠে চাপিয়েছিল। শুধু বোম্বে, স্পেকের মাবরুকি, চন্দা, উন্যান্যেম্বের মাবরুকি, এমটামানি, জুমা ও সরমিন ছিল- পঞ্চাশ জনের মধ্যে মাত্র সাতজন। এদের মধ্যে চন্দা আবার নির্বিকার ভাবে খাবার খাচ্ছিল। বাকিরা সবাই পালিয়েছে আর ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে, শুধু উলেদি (মানওয়া সেরার দলের লোক) ও জাইদি পালাতে পারে নি, সেলিম গুলি ভরা রিভলবারের ভয় দেখিয়ে তাদের ফিরিয়ে এনেছিল। তখন সেলিমকে বললাম আমার গাধার পিঠে জিন চাপাতে, আর বোম্বেকে হুকুম দিলাম শ-কে তার নিজের জিন পরাতে সাহায্য করতে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রাস্তায় নামলাম, দলের সবাই থেকেই থেকেই আসন্ন শত্রুর ভয়ে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে; গাধাগুলোকে এমন জোরে ছোটাচ্ছিল যে আমি তীব্র ব্যথায় মরছিলাম। আমি বরং সানন্দে মৃত্যুর অপেক্ষায় শুয়ে থাকতাম। তবে কিনা জীবন বড়ই মধুর, আর আমি আমার অভীষ্ট পূর্ণ হতে দেখার আশা তখনও ছাড়িনি। আরবরা পালিয়ে এমফুটোতে গিয়েছিল। এমফুটোর দিকে চলতে চলতে সেই দীর্ঘ নির্জন রজনীতে আমার মন কল্পনা-পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিল। রাতের বেলা শ তার গাধা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল, বার বার বলা সত্ত্বেও উঠল না। আমি নিজে যেমন হতাশ হইনি, তাই শ'-কেও হতাশ হতে দেওয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না। তাকে ফের জন্তুর পিঠে তুলে দেওয়া হল, আর তাকে সাহায্য করার জন্য তার দু’পাশে দু’জন লোক মোতায়েন করা হল; এইভাবে আমরা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে চললাম। মাঝরাতে নিরাপদে এমফুটো পৌঁছলাম আর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে ঢুকে গেলাম। যেখান থেকে বীরত্বের সঙ্গে রওনা হয়েছিলাম, সেখানেই হেরো ভূত হয়ে ল্যাজ গুটিয়ে ফিরে এলাম।
আমার সব লোক দেখালাম অন্ধকার নামার আগেই এখানে পৌঁছে গেছে। আমাদের বীর পথপ্রদর্শক উলিমেঙ্গো যে কিনা আমাদের অস্ত্র-শস্ত্র আর লোকবল নিয়ে বেজায় উল্লসিত ছিল, ভেবেছিল জয় নিশ্চিত, সেও এগারো ঘন্টার পথ ছয় ঘন্টায় ছুটে এসেছে; গাঁট্টাগোট্টা চৌপেরেহ, যাকে আমি আমার দলবলের মধ্যে বিশ্বস্ততম বলে ভাবতাম, সে উলিমেঙ্গোর চেয়ে মাত্র আধঘন্টা পরে এসে পৌঁছেছিল; আর সেই যে চঞ্চল, শৌখিন, বক্তৃতাবাজ নেতা-গোছের খামিসি, সে তৃতীয় হয়েছিল; স্পেকের ‘বিশ্বস্তরা’ অন্য যে কোন বেচারা নিগ্রোর মতন একইরকম কাপুরুষ বলে প্রমাণিত হয়েছিল। শুধুমাত্র সেলিম, জেরুজালেমের আরব ছেলেটিই, সাহসী ও বিশ্বস্ত বলে প্রমাণিত হয়েছিল। জন্মের দিক দিয়ে ইউরোপীয় হলে কি হয়, শ প্রমাণ করেছিল যে সে নিগ্রোদের চেয়ে বেশি যদি নাও হয় তাদের মতন একই রকম নিকৃষ্ট ও নীচ মনের লোক।
সেলিমকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার মনিবকে মৃত্যুর মুখে ফেলে তুমিও কেন পালালে না?” “ওহ, সরকার,” সরলভাবে আরব ছেলেটি বলল, “আপনি চাবুক পেটা করবেন বলে ভয় পেয়েছিলাম।"
(অষ্টম অধ্যায়ের শেষ। পরের কিস্তিতে শুরু হবে নবম অধ্যায়)