ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে হেনরি মর্টান স্ট্যানলিকে যিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন লিভিংস্টোনকে খুঁজে বার করতে, তাঁকে লেখা লিভিংস্টোনের একটি চিঠির প্রতিলিপি। তরজমা স্বাতী রায়
নিউ ইয়র্কের দুটো চিঠি জেমস গর্ডন বেনেট জুনিয়রকে লেখা। তাঁর বাবাকে নয়, তাঁকেই, তিনিই সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে আমার নেতৃত্বে অভিযান পাঠিয়েছিলেন। পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে আমি সেই চিঠি দুটোর একটা এখানে পুনঃপ্রকাশ করছি। কারণ এই চিঠিটার ধরণ ও সারবস্তু বুঝিয়ে দেবে, যে মানুষটার বেঁচে থাকা-না থাকার খবরটুকু পাওয়ার জন্য ভয়ানক খরচ করে একটা অভিযান পাঠানো হয়, সেই মানুষটা কেমন।
উজিজি, টাঙ্গানিকার ধারে,
পূর্ব আফ্রিকা, নভেম্বর, ১৮৭১।
জেমস গর্ডন বেনেট, জুনিয়র, এসকোয়ার।
প্রিয় স্যার - সাধারণতঃ অদেখা কাউকে চিঠি লেখাটা খানিকটা কঠিন কাজ - অনেকটা কোন একটা বিমূর্ত ধারণাকে সম্বোধন করার মতই বলা যায় - তবে আপনার প্রতিনিধি, মিঃ এইচ এম স্ট্যানলির, এই দূরের দেশে উপস্থিতি আপনার সঙ্গে আমার অপরিচয়ের ব্যবধান ঘুচিয়েছে। উনি না এলে আমি অবশ্যই এই চিঠি লিখতে কিন্তু কিন্তু করতাম। তবে ওঁকে পাঠিয়ে আপনি যে অসীম দয়া দেখিয়েছেন সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লিখতে খুবই স্বচ্ছন্দ বোধ করছি।
তিনি আমাকে যে অসহায় অবস্থায় খুঁজে পেয়েছিলেন, তার বিবরণ দিলে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন যে আমার আপনাকে এত কৃতজ্ঞতা জানানোর যথেষ্ট কারণ আছে। আমি জ্বলন্ত সূর্য মাথায় নিয়ে প্রায় সাড়ে চারশ থেকে পাঁচশ মাইল হেঁটে উজিজিতে এসেছি। আমার যাত্রার যা উদ্দেশ্য ছিল, সেই ভৌগলিক লক্ষ্যের প্রায় কাছে পৌঁছেও আমি অবাক, চিন্তিত ও পরাজিত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি। এবং তার এক মাত্র কারণ হল যথার্থ কুলির বদলে আমাকে জাঞ্জিবার থেকে কয়েকজন দো-আঁশলা মুসলমান দাস পাঠানো হয়েছিল। মানুষের অন্য মানুষকে অমানবিক যন্ত্রণা দেওয়া, শারীরিক অত্যাচার করার ভয়াবহ চেহারা দেখে আমার দুঃখিত হৃদয় আরও দুঃখ পেয়েছে, অপরিসীম মনস্তাপে ডুবে গেছে। প্রতিটা পদক্ষেপে আমার মনে হচ্ছিল, এবার মারা যাব। ক্লান্তিকর, গুমোট পথে প্রতিবার অসীম কষ্টে পা ফেলেছি এমন বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। উজিজিতে যখন পৌঁছেছি, তখন শুধু হাড় কখানাই সম্বল ।
সেখানে দেখলাম যে জাঞ্জিবারের থেকে প্রায় পাঁচশো স্টার্লিং পাউন্ডের যেসকল মূল্যবান দ্রব্যাদি আমি পাঠাতে বলেছিলাম, সেগুলো অকারণে এক মাতাল দো-আঁশলা মুসলমান দর্জির হাতে সঁপে দেওয়া হয়েছিল। সে লোকটা উজিজি আসার পথে ষোল মাস ধরে সেসব উড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়ে, যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা বেচে নিজের জন্য দাস আর হাতির দাঁত কিনেছে। সে কোরানে ভরসা করেছিল আর দেখতে পেয়েছিল যে আমি মারা গেছি। সে এমনকি উন্যানেয়েম্বের শাসককেও লিখেছিল যে সে আমাকে খুঁজতে মান্যুয়েমাতে দাস অবধি পাঠিয়েছিল আর সে ফিরে এসে আমার মৃত্যুসংবাদ জানিয়েছিল। তার মাতাল হাঁয়ের থেকে বেচে থাকা অবশিষ্ট কটা জিনিস বিক্রি করার জন্য সে শাসকের থেকে অনুমতিও চেয়েছিল।
সে অবশ্য আমাকে যারা আগেই দেখেছে তাদের মারফৎ খুব ভাল করেই জানত যে আমি বেঁচে ছিলাম - মালপত্র, লোকজনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম; তবে চরিত্র-নীতির দিক দিয়ে, সে স্পষ্টতই একটা বোকা লোক। তবে যেহেতু এখানে ছুরি বা বন্দুকের ব্যবহার করা ছাড়া আর কোন অপরাধের বিষয়ে কোনও আইন নেই, ফলে আমাকে অতি দুর্বলভাবে বসে থাকতে হল , একেবারে নিঃস্ব তখন , সম্বল বলতে শুধু কটা বিনিময়যোগ্য কাপড় আর পুঁতি – সেই ক’টা রেখে দিয়েছিলাম যে যদি এই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়ার মতন কোন চরম প্রয়োজন হয় তো কাজে লাগবে।
উজিজির লোকদের মধ্যে ভিক্ষা করার আশু সম্ভাবনা আমাকে আরও কাতর করে তুলছিল। পুরো হতাশ হতেও পারছিলাম না, কারণ এক বন্ধু জাম্বেজির মুখে পৌঁছে বলেছিলেন যে হতাশার চোটে তিনি প্রায় তাঁর স্ত্রীর ছবি ভেঙ্গে ফেলতে উদ্যত হয়েছিলেন। এর থেকে বেশি আর কিই বা করা যায়! কথাটা শুনে খুব হেসেছিলাম। এটা শোনার পর থেকে হতাশার বাবদে ধারণাটাই আমার কাছে এমন হাস্যকর ছিল যে নিরুৎসাহিত হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
যাই হোক, আমি যখন দুঃখের শেষ সীমায় পৌঁছেছি, তখন একজন ইংরেজ দর্শনার্থী এসেছেন বলে একটা অস্পষ্ট গুজব কানে এল। তখন ভাবছিলাম যে আমিই হয়ত সেই লোক যে জেরুজালেম থেকে জেরিকোতে এসেছিল; তবে কোন পাদ্রী, লেবীয় বা স্যামারিটান কেউই সম্ভবত আমার পথ মাড়ায়নি। তবু একজন ভাল স্যামারিটান কাছেই ছিল, আর আমার দলের একজন খুব জোরে ছুটে এসে, খুবই উত্তেজিত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "একজন ইংরেজ আসছেন! আমি দেখেছি!" আর সঙ্গে সঙ্গে সে তার সঙ্গে দেখা করতে ছুটে গেল।
আফ্রিকার এই অংশে এই প্রথম একটা কাফেলার মাথায় একটা আমেরিকান পতাকা দেখা গেল, সেটাই আমাকে এই অপরিচিত ব্যক্তি কোথাকার লোক তা জানালো।
আর দশজন ব্রিটিশ দ্বীপবাসির মতন আমিও শীতল, ভাবাবেগ প্রকাশ করতে পারি না। তবে আপনার দয়া আমার সারা শরীর রোমাঞ্চিত করেছে। সত্যি সত্যিই আমাকে অভিভূত করেছিল। আমি মনে মনে বলেছিলাম, "আপনার এবং আপনার সকল কিছুর উপর প্রভুর অফুরান আশীর্বাদ নেমে আসুক!"
মিঃ স্ট্যানলি আমাকে যা সব খবর দিলেন তা রীতিমত রোমাঞ্চকর। ইউরোপ ভূখন্ডের বিশাল রাজনৈতিক পরিবর্তন; আটলান্টিক মহাসাগরের তলা দিয়ে তার নিয়ে যাওয়ার সাফল্য; জেনারেল গ্রান্টের নির্বাচন, এবং আরও অনেক বিষয় পরের বেশ কিছু দিন ধরে আমার মন জুড়ে ছিল। আমার শরীরেও তখন তখনই উপকার হয়েছিল। ১৮৬৮ সালের কয়েকটা 'স্যাটারডে রিভিউ' ও 'পাঞ্চ' থেকে যা টুকরো টাকরা খবর সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম সেটুকুই এতদিন সম্বল ছিল। এছাড়া গত কয়েক বছর দেশের কোন খবরই পাইনি। আমার ক্ষিধে ফিরে এল। এক সপ্তাহের মধ্যে আবার গায়ের বলও ফিরে এল বলে মনে হল।
মিঃ স্ট্যানলি লর্ড ক্লেরেডনের (যার মৃত্যুতে আমি খুবই দুঃখিত) খুবই সহৃদয় একটা চিঠি এনেছিলেন। উৎসাহ দিয়ে লেখা চিঠি। ১৮৬৬ সালের থেকে বিদেশ বিভাগের থেকে আসা প্রথম চিঠি। তিনি এই খবরও দিয়েছেন যে ব্রিটিশ সরকার দয়াপরবশ হয়ে আমার সহায়তার জন্য এক হাজার স্টার্লিং পাউন্ড পাঠিয়েছেন। তাঁর আসার আগে অবধি আমি কোনও বিশেষ আর্থিক সহায়তার সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। আমি মাইনে ছাড়াই এসেছি, তবে টাকার চাহিদাটি এখন সানন্দে মিটে গেল। আপনি ও আমার সকল বন্ধুকেই এটা জানাতে আমি উদ্গ্রীব । তবে আমার বন্ধু স্যার রডেরিক মারচিসন বলেন যে আমার "জন বুল" এর মতন জেদ। তাই এমনকি চিঠির মারফৎ কোন উৎসাহ না পেলেও, আমি বিশ্বাস করেছিলাম যে এসব কিছুর ফলাফল মঙ্গলের হবে আর আমার নিজের কাজেই লেগে ছিলাম।
দক্ষিণ মধ্য আফ্রিকার জলবিভাজিকাটি দৈর্ঘ্যে সাতশ মাইলেরও বেশি। অগণিত ঝর্ণা রয়েছে এই পথে - তাদের সংখ্যা গুণতে গেলে জীবন কাবার । এই জলধারাগুলো জুড়ে জুড়ে চারটে বড় নদী হয়েছে, আর সেগুলো আবার জুড়ে, দশ থেকে বারো ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশে শুরু হওয়া নীলনদের সুবিশাল উপত্যকার দুটো বিশাল নদীতে পরিণত হয়েছে। অনেক আগেই এই পুরোন সমস্যাটার সমাধান জানা ছিল আর সে জন্য এই এলাকার জলনিকাশ ব্যবস্থা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা করতে পেরেছিলাম। তবেঁ আমাকে অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হয়েছিল, প্রতিটা পদক্ষেপ আন্দাজে ফেলতে হয়েছিল - কারণ নদী কোথায় যাচ্ছে তাতে আর কার কি এসে যায়! "আমরা ইচ্ছেমত জলপান করি, তারপর বাকীটা বয়ে চলে যাক ।"
যেসব পর্তুগিজরা কাজেম্বেতে এসেছে, তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য দাস সংগ্রহ আর হাতির দাঁত জোগাড়। অন্য কিছুই তারা শোনেনি। আমি জলপ্রবাহ নিয়ে তাদের প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেছি, যতক্ষণ না আমার ভয় হত যে এবার বোধহয় এরা ধরে নেবে যে আমার মাথায় জল জমেছে।
আমার শেষ কাজটা করতে গিয়ে উপযুক্ত দলবলের অভাবে খুবই বাধা পেয়েছি। এবার আমি নরখাদকদের দেশের মধ্যে দিয়ে কেন্দ্রীয় জলধারাটির প্রবাহপথ অনুসরণ করছিলাম। এই দেশটাকে মান্যুয়েমা বলে, বা সংক্ষেপে মুনিয়েমা। জলপ্রবাহের এই পথে চারটি বড় হ্রদ রয়েছে। চতুর্থটির কাছে গিয়েও ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। এই হৃদ এক থেকে তিন মাইল প্রশস্ত, এবং বছরের যে কোনও সময়ে বা কোনও পর্যায়ে কখনই এখানে পৌঁছানো যায় না। পশ্চিমের দুটো জলধারা, লুফিরা বা বার্টি ফ্রেয়ারের নদী, কামোলোন্ডো হৃদে এই ধারার সঙ্গে মিশেছে। তাছাড়া অপুর্ব আইভার লোমামি লিংকন হ্রদের মধ্যে দিয়ে এসে এখানে ঢুকেছে। মনে হয় এটাই নীল নদের পশ্চিমের বাহু তৈরি করে, যেখানে পেথেরিক ব্যবসা করেছিলেন।
এবার, আমি জানতাম যে জলবিভাজিকাটি মাত্র ছয়শত মাইল বিস্তৃত আর দুর্ভাগ্যক্রমে পুরোটার মধ্যে এই সপ্তম একশ মাইলই সব থেকে আকর্ষণীয়; কারণ এখানে, যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে , তাহলে মাটির ঢিবি থেকে চারটে ঝর্ণা বেরিয়েছে এবং চারটের মধ্যে শেষটা অল্প দূরেই একটা বড় নদী হয়েছে।
এর মধ্যে দুটো, লুফিরা ও লোমামি উত্তরের মিশরের দিকে গেছে, আর দুটো, লিয়াম্বায়ে, বা আপার জামবেজি ও কাফুল দক্ষিণে ইথিওপিয়ার ভিতরে গেছে।
সাইস শহরে মিনার্ভার সেক্রেটারি হেরোডোটাসকে নীল নদের উৎস হিসেবে যাদের কথা বলেছিলেন, এগুলোই কি সেগুলো ?
আমি প্রায়শই এদের কথা শুনেছি। বহু দূরে বসেও। এদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহই ছিল না। আর প্রতিবার পরিবারের কথা ভাবতে বসলেই বাড়ির জন্য খুব মনখারাপ করলেও , আমি এদের পুনরাবিষ্কার করে নিজের কাজ সমাপ্ত করতে চাই।
পাঁচশো স্টার্লিং পাউন্ডের মূল্যবান পণ্য আবারও দায়সারাভাবে দাসদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আর চার মাসের বদলে দীর্ঘ এক বছর ধরে সেটা রাস্তাতেই ছিল। এবার আপনার খরচে আমাকে অবশ্যই এই নদীগুলোর কাছে যেতে হবে, যাতে আমি আমার কাজে স্বাভাবিকভাবে একটা দাঁড়ি টানতে পারি।
আর উজিজির ভয়াবহ দাসত্ব প্রথা নিয়ে আমার লেখাগুলো যদি পূর্ব উপকূলের দাস বাণিজ্যকে দমন করতে সাহায্য করে, তবে আমি একে একযোগে নীলনদের সকল উত্স আবিষ্কারের চেয়েও বড় বলে ভাবব। এখন আপনারা চিরকালের জন্য নিজেদের দেশে দাসপ্রথা বন্ধ করেছেন, এবার আপনাদের শক্তি এই কাজে নিয়োজিত করুন। এই সুন্দর দেশটা যেন অভিশপ্ত। যেন ঈশ্বরেরই অভিশাপে এখানে জাঞ্জিবারের নীচ সুলতান দাসব্যবসার সুবিধাগুলো পেতেই থাকে ,আর পর্তুগালের রাজমুকুটের কাল্পনিক অধিকারগুলি আরও কিছুদিন দূরে ঠেকিয়ে রাখা হয় যতদিন না পর্তুগিজ দাস-ব্যবসায়ীদের কাছে আফ্রিকা আরেকটা ভারত হয়ে ওঠে।
আপনার অসীম উদারতার জন্য আবার আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করেছি।
ইতি
আপনার কৃতজ্ঞ,
ডেভিড লিভিংস্টোন।