মানচিত্রে চিহ্নিত বাগামোয়ো শহরেই এখনও আটকে স্ট্যানলে।
প্রথম কাফেলাটা বেরনোর আগে, সুর হাদজি পাল্লুর সঙ্গে আমি টাকাপয়সার বাবদে একটা নির্দিষ্ট বোঝাপড়ায় পৌঁছালাম। সে এক চমৎকার মানুষ। যাত্রার জন্য নির্দিষ্ট সকালে সে আমার কুঁড়েতে এল আর নিরীহ গম্ভীর ভাবে আমার কাছে তার হিসেব দাখিল করল। উন্যাময়েম্বে অবধি যাওয়ার মজুরি হিসেবে সে যে কুলিদের পঁচিশ ডটি করে দিয়েছে তার রসিদ। আমাকে তখনই টাকা দিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করল।
শুনে তো আমি থ! মাত্র আগের দিনই সকালে এর সঙ্গে আমার কথা হল যে, আমার শিবিরে তিনহাজার ডটি কাপড় রয়েছে, যা কিনা কুলিদের ভাড়া মেটানোর উদ্দেশ্যেই কেনা। এও কথা হল যে আমার অভিযানে বাগামোয়ো থেকে উন্যানয়েম্বেতে যাওয়ার জন্য যেসব মুটে ভাড়া করা হবে, তাদের প্রত্যেককে আমাদের শিবিরে মজুত করা কাপড়ের থেকেই মজুরি দেওয়া হবে। সেসব কথা কি এই লোকটা ভুলে গেল? দেখলে তো বেশ বুদ্ধিমান বলেই মনে হয়। জিজ্ঞেস করলাম যে তার সেসব কথা মনে আছে কি না, সে জানাল যে তার মনে অবশ্যই আছে; তবে কিনা এত তাড়াতাড়ি সেই চুক্তিটি ভাঙার কারণ এই যে সে নিজের কাপড় বিক্রি করতে চায়, আমার কাপড় না। আর তার কাপড় সে বিনিময় করতে রাজি না, কাপড়ের বদলে তার টাকা চাই। তবে আমি তাকে বোঝতে পেরেছিলাম যে সে যখন আমার জন্য কুলি ভাড়া করছে, তখন তাকে আমার কাপড় দিয়েই আমার কুলিদের ভাড়া মেটাতে হবে; যেটুকু টাকা আমি তাকে দেব বলে ভাবছি, সেটা শুধু আমার এজেন্ট হিসাবে তার কাজ করার জন্য যতটুকু আমি যথেষ্ট বলে মনে করি সেইটুকুই। আর শুধু এই শর্তেই সে এই বিষয়ে বা পরে অন্য কোনো বিষয়ে আমার হয়ে কাজ করেবে এবং ‘মুসুঙ্গু’-রা অত সহজে নিজের কথা ফিরিয়ে নিতে অভ্যস্ত না।
আগের অনুচ্ছেদে দুজনের বাক্যবিনিময়ের যতটুকু বললাম, না বলা রইল তার থেকে ঢের বেশি। এক ঘণ্টার কথোপকথন, আধ ঘণ্টার ক্রুদ্ধ ঝগড়া, তার মধ্যে সুর হাদজি পাল্লু প্রতিজ্ঞা করে বসল যে আমি যদি ওর কাপড় না নিই তবে সে আমার সঙ্গে মোটেই ব্যাবসা করবে না, অনেক কান্নাকাটি, অনুনয়-বিনয়, সকরুণ অনুশোচনা, আরও কত কিছুই যে চলল। সব কিছুতেই আমার একটাই কথা, “আমি যেভাবে চাই সেভাবে করতে হলে করো, না হলে ফোটো।’’ অবশেষে স্বস্তি এল, এবং ব্যাপারটা ভালো ভাবেই মিটল। সুর হাদজি পাল্লু হাসিমুখে ফেরত গেল, সঙ্গে কাফেলার জন্য তিনটি সৈন্যের পোশো (খাবার), এবং হোঙ্গা (শ্রদ্ধাঞ্জলি) নিয়ে গেল। এই ঝামেলাটা মিটল আর পরের এই একই রকমের ঝগড়াগুলোরও যে এত শান্তভাবে মীমাংসা হল, এটা আমার জন্য খুবই স্বস্তির। না হলে বাগামোয়ো থেকে যত তাড়াতাড়ি আমি বেরিয়ে পড়তে পেরেছিলাম, তা পারতাম কিনা আমার সন্দেহ আছে। তবে এই বিষয়টা নিয়েই কথা বলছি যখন, আর যেহেতু বাগামোয়োতে যে কদিন ছিলাম এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে প্রায় প্রতিটা মুহূর্তে মাথা ঘামাতে হয়েছে, আমি বরং আমার কাজের সঙ্গে সুর হাদজি পাল্লু ও তার ব্যাবসার সম্পর্কটি স্পষ্ট করেই বলি।
সুর হাদজি পাল্লু ব্যাবসার নিরিখে বেশ চটপটে যুবক, উদ্যমী, দ্রুত হিসেব কষে ফেলতে পারে মনে মনে—মনে হয়েছিল একজন সফল বানিয়া হওয়ার জন্যই তার জন্ম। তার চোখদুটো কখনও চুপ করে থাকত না, আমার শরীরের প্রতিটি অংশে, তাঁবু, বিছানা, বন্দুক, জামাকাপড়—সবের উপরেই গোল গোল করে ঘুরে বেড়াত এবং পরিষ্কার একচক্কর ঘুরে এসেই আবার চুপচাপ পরের চক্কর শুরু করত। তার আঙুলগুলোও কখনোই থেমে থাকত না, আঙুলের ডগাগুলো ছটফট করে সবসময় কিছু ছুঁতে চাইত; আমার সাথে কথা বলার সময়, সে ঝুঁকে পড়ে আমার ট্রাউজার্স, জামা বা জুতা বা মোজার কাপড়ের উপর হাত বোলাত: তারপরই তার নিজের হালকা জামদানি শার্ট বা ডাবওয়ানি ধুতিতে হাত বোলাত, যতক্ষণ না তার চোখ একটা নতুন কিছুর উপর গিয়ে পড়ছে, অমনি তার শরীর ঝুঁকে পড়ত আর স্পর্শোৎসুক আঙুলগুলো সামনের দিকে এগিয়ে যেত। তার মুখও সবসময় নড়তেই থাকত, চুন-সুপারি বা কখনো-কখনো খৈনি চিবানোর বদভ্যাসের জন্য। সবসময় একটা শব্দ হত, যেন শুয়োরের বাচ্চা মা-র দুধ টানছে। সে ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান ও প্রকৃত বিশ্বাসীরা যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও বাহ্যিক সৌজন্য মেনে চলে, সে সবই পালন করত। অমায়িক ভাবে আমাকে অভিবাদন জানাত, জুতো খুলত, আমার তাঁবুতে ঢুকতে ঢুকতে বলতে থাকত যে তার আমার সামনে বসার কোনো যোগ্যতাই নেই, এবং বসার পরে তার চিরাচরিত কূট কাজকর্ম শুরু করত। আক্ষরিক বা ব্যাবহারিক সততা কোনোটাই এই যুবকের জানা ছিল না; ‘খাঁটি সত্য’ কথাটাই তার একেবারে অপরিচিত; এতটুকু বয়সে সে এত মিথ্যা কথা বলেছে যে মনে হয় ইতিমধ্যেই তার চোখ থেকে সরলতা মুছে গেছে, তার চেহারা থেকে সততার রং নিভে গেছে, যদিও সে মাত্র কুড়ি বছরের এক যুবক, তাকে একজন আদ্যন্ত শঠ, অসৎ মানুষে বদলে দিয়েছে!
যে ছয় সপ্তাহ আমি বাগাময়োতে শিবির করে ছিলাম, দরকার মতো কুলি সংগ্রহের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, বিশ বছরের এই ছেলেটি আমাকে এত ঝামেলায় ফেলেছিল যে সারা নিউইয়র্কের সব দর্বৃত্তরা মিলেও পুলিশ-প্রধানকে অত সমস্যায় ফেলে না। দিনে আধ-ডজন বার সে কোনো অন্যায় কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ত, তবুও তার কোনো লজ্জা নেই। সে আমাদের কুলিদের কাপড় দেওয়ার যে হিসেব পাঠাত তাতে বলা থাকত যে প্রত্যেককে সে ২৫ ডটি করে কাপড় দিয়েছে। খোঁজ নেওয়ার জন্য একজনকে পাঠিয়ে জানলাম যে সবচেয়ে বেশি যে পেয়েছে সে ২০ ডটি কাপড় পেয়েছে, আর সবচেয়ে কম যে পেয়েছে সে পেয়েছে ১২ ডটি। সুর হাদজি পাল্লু বলেছিল যে সে কুলিদের বাজারের সেরা মানের মিহি কাপড় দেয়, অথচ ব্যক্তিগত পরীক্ষায় দেখা গেল সে একেবারে সস্তা মাল, যেমন ২’২ ফুট চওড়া আমেরিকান শিটিং, যার জাঞ্জিবারে দাম তিরিশ গজে ২.৭৫ ডলার বা সবচেয়ে নিকৃষ্ট কানিকি, যা সাধারণত বিক্রি হয় স্কোর প্রতি ৯ ডলারে। সে নিজে আমার শিবিরে এসে পোশো বা কাফেলার খাবারের জন্য ৪০ পাউন্ডের সামি-সামি, মেরিকানি এবং বুবু পুঁতির মালা নিয়ে গেল; অথচ বাগামোয়োর পরে প্রথম শিবিরের থেকে বেরনোর আগে ভাঁড়ারের ব্যক্তিগত পরিদর্শন করে দেখা গেল ৫ থেকে ৩০ পাউন্ডের মতো পুঁতি কম। তা ছাড়া সে নগদ টাকার ব্যাপারেও ঠকাত। যেমন, প্রতি দশজন কুলির কিঙ্গানি ফেরি পারাপারের জন্য ৪ ডলার করে লাগবে বলেছিল, আসলে কিন্তু তাদের ভাড়া মাত্র ২ ডলার; আর পোশোর জন্যও অত্যন্ত বেশি পাইস (এক সেন্টের এক চতুর্থাংশের সমান মূল্যের তামার মুদ্রা) লাগবে বলেছিল। চার চারটে সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন এই ছুঁচোমি চলেছিল। প্রতিদিন এক ডজন করে নতুন পরিকল্পনা করে; প্রতিটি মুহূর্ত শুধুই ভাবে কীভাবে আমাকে লুঠ করা যায়। তাকে ঠেকানোর ভাবনা ভাবতে ভাবতে আমি ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে যেতাম। নিজের সহকারীদের সামনে ধরা পড়লেও তার পাণ্ডুর গালে কোনো লজ্জার চিহ্নমাত্র দেখা যেত না; কেবল কাঁধে একটা ঝাঁকানি দিয়ে সে সব কিছু শুনে যেত! তার জন্য আমি যে উপহার দেব বলে ভেবে রেখেছি সেটা কমিয়ে দেব বলে ভয় দেখিয়েও কোনো লাভ হত না। এখন যা হাতে পাওয়া যায় তাই ভালো। কাজেই কয়েক দিন পরে ২০ ডলার পাওয়ার প্রতিশ্রুতির চেয়েও, এমনকি সেটা মুসুঙ্গুর দেওয়া কথা হলেও, এখন দশ ডলারের জিনিস হস্তগত করতে পারা তার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান।
পাঠক অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে এইরকম নির্লজ্জ কাজকর্ম প্রথম আবিষ্কারের পরেই কেন আমি তার সঙ্গে কাজ করা বন্ধ করে দিইনি। সে প্রশ্নের জবাবে আমি জানাই যে, তার সমান ক্ষমতার কাউকে না পাওয়া অবধি আমি তাকে ছাড়া কাজ চালাতে পারতাম না, তার উপরে আমি যেভাবে নির্ভর করতে পেরেছিলাম, আমি কখনও অন্য কোনো মানুষের উপর তেমন নির্ভরতা অনুভব করিনি; তার বা তার সমকক্ষ কারও সহায়তা ছাড়া আমাকে অবশ্যই কমপক্ষে ছয় মাস বাগামোয়োতে থাকতে হত, আর ততদিনে এই অভিযানটাই মূল্যহীন হয়ে যেত, অভিযানের খবর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ত। বাগামোয়ো থেকে জলদি বেরিয়ে পড়া আমার অভিযানের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য ছিল— তার পরে হয়তো আমার পক্ষে নিজের ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা সম্ভব হলেও হতে পারে।
এই সময়ে আমি যা যা ভাবতে পেরেছিলাম তার মধ্যে এই সমস্যাগুলো সব থেকে বড়ো। আগেই বলেছি যে আমার শিবিরে গাঁটরি-বোঝাই কাপড় ছাড়াও ১৭৫০ ডলারের ৩৫০০ ডটি কুলিদের কাপড় রাখা ছিল। ১৪০ জন কুলির মাথাপিছু ২৫ ডটি হিসেব ধরে, আমার মনে হয়েছিল আমার কাছে যথেষ্ট কাপড় আছে। আমি এই তরুণ ভারতীয়কে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে মুসুঙ্গু মোটেই বোকা নয়। তার চুরি করার কায়দাগুলো যে মুসুঙ্গু বোঝে না এমন না। এদিকে ৩৫০০ ডটি কাপড় সব খরচ হয়ে গেছে, যদিও আমি মাথাপিছু ২৫ ডটি দিয়ে মাত্র একশো তিরিশ জন কুলি পেয়েছি, যাতে হিসেবমতো মোট ৩২০০ ডটি লাগে। তবুও সুর হাদজি পাল্লুর হিসেবে ১৪০০ ডলার নগদ বেশি দেখাচ্ছে। তার বক্তব্য ছিল যে সে অতিশয় দামি ২৪০ ডটি সূক্ষ্ম কাপড় দিয়েছে, তার দামই আমার ৯৬০ ডটি কাপড়ের সমান। ফেরির পয়সা দিতে টাকা খরচ হয়েছে, কাফেলাপ্রধানদের জন্য তাঁবু, বন্দুক, লাল বনাতের কাপড় উপহার কিনতে টাকা লেগেছে, এমনকি উপকূলের লোকদের কুলি জোগাড় করতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য তাদের উপহার দিতেও টাকা লেগেছে। এইরকম নির্মম প্রতারণা দেখে আমি ক্ষেপে উঠেছিলাম ও তাকে বলে দিয়েছিলাম সে যদি তার পুরো হিসেব আবার ভালো করে দেখে সংশোধন না করে, তাহলে সে এক পয়সাও পাবে না। তবে এই হিসেব ঠিকঠাক করার আগে, আমার সব কথা, হুমকি, প্রতিশ্রুতি ইত্যাদিতে কেউ বিন্দুমাত্র কর্ণপাতও করছিল না। শেষে জাঞ্জিবারের তারিয়া টোপনের দোকান থেকে কাঞ্জি নামের একজন এল তারপর সেই হিসেব কমে ৭৩৮ ডলার হল। তারিয়া টোপনের কোনোরকম অসম্মান না করেই বলি, এটা বোঝা মুশকিল যে কাঞ্জি আর তরুণ সুর হাদজি পাল্লুর মধ্যে কে বড়ো জোচ্চোর; এদের দুজনকেই চেনেন এমন একজন শ্বেতাঙ্গের ভাষায় এদের দুজনের মধ্যে একচুলও ফারাক নেই। কাঞ্জি জটিল ও চতুর, সুর হাদজি পল্লু দুঃসাহসী ও সকল সংশোধনের অতীত। তবে দুজনেরই শান্তি হোক, বাগামোয়োতে আমি যে কাঁটার মুকুট পরেছিলাম, তেমন যেন তাঁদের মুণ্ডিত মাথায় কখনও না চাপে!
(ক্রমশ... পরের কিস্তি পড়ুন পরের বৃহস্পতিবার)
খানিকটা বিরতি দিয়ে পড়লাম। সেই একই টান টান উত্তেজনা, ঝরঝরে লেখনি।
“আমি যেভাবে চাই সেভাবে করতে হলে করো, না হলে ফোটো।’’
জানি না, মূল লেখায় কিভাবে আছে, তবে কথ্যভাষায় কথাটি "ফোটো" বা ঢাকাইয়ায় "কাট মারো" ইত্যাদির বদলে ভাবানুবাদে বিদায় হও, পড়তেই ভাল লাগবে।
চলুক।
এটুকু পড়ে মন ভরছে না।দারুণ