ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে ন্যামওয়েজি উপজাতির মানুষদের কথা। তরজমা স্বাতী রায়
উন্যামওয়েজির সরকার হল বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র। রাজাকে বলা হয় এমটেমি। উন্যানওয়েম্বে, উসাগোজি আর উগালা ছাড়া উন্যামওয়েজির আর কোন প্রধান এই উপাধি পাওয়ার যোগ্য নয়, যদিও জেলাগুলির প্রধানদের প্রতি সৌজন্য দেখাতে এই উপাধি দেওয়া হয়। উন্যানয়েম্বের বর্তমান সর্দার হলেন এমকাসিওয়া; পাকালামবুলা হল উগারার সর্দার; ও উসাগোজির প্রধান হল "মোটো" বা ফায়ার। স্থানীয় ২০০০০ লোকের থেকে এমকাসিওয়া প্রায় ৩,000 জন যোদ্ধার দল তৈরি করতে পারে। অথচ তাবোরা বা কুইহারের ছোট ছোট অঞ্চলগুলো একা একাই ১৫০০ যোদ্ধা সরবরাহ করতে পারে।
ন্যামওয়েজিদের কিছু অদ্ভুত রীতি আছে। একটা বাচ্চার জন্মের পরে তার বাবা পিতা নাড়িটা কেটে ফেলে আর সেটা নিয়ে রাজ্যের সীমানায় গিয়ে সেখানে মাটিতে পুঁতে দেয়। যদি সে জায়গাটা একটি নদী হয়, তাহলে নদীর পাড়ে পুঁতে দেয়; তারপর একটা গাছের শিকড় নিয়ে সে ফিরে আসে, আর বাড়ি ফিরে নিজের দরজার চৌকাঠে সেটা পুঁতে দেয়। তারপর সে তার বন্ধুদের জন্য একটা ভোজের বন্দোবস্ত করে। একটা বলদ বা গোটা ছয়েক ছাগল মারে, পোম্বে বিলোয় সবাইকে। যমজ সন্তানের জন্ম হলে, তারা কখনই একজনকে মেরে ফেলে না, বরং সেটা আরও বড় আশীর্বাদ মনে করে। প্রসবের সময় হলে, মা জঙ্গলের দিকে ছুটে যায় আর সেখানেই আরেক মহিলা তাকে সাহায্য করে। বিয়ের অনুষ্ঠান হয় গোগোদের মতোই। উভয় পক্ষের সামর্থ্য অনুসারে, বৌয়ের বাবাকে গরু বা ছাগল পণ দিতে হয়। মন্দ উদ্দেশ্যে জাদুবিদ্যা কাজে লাগালে মৃত্যুদণ্ডই বিধান। দুর্বৃত্তদের ধরা আর শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে গোগোর মধ্যে যেমনটা প্রচলিত সেই একই অনুষ্ঠান উন্যামওয়েজিতেও চলে। রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড। একজন চোর বামাল ধরা পড়লে, হয় ঘটনাস্থলেই জবাই করা হয়, অথবা, এমেটেমি, বা রাজার রায় অনুসারে, যার জিনিস হাতানোর চেষ্টা করেছিল তারই চাকর হতে হয়।
মৃত্যুর পরে, ন্যামওয়েজিরা মৃতদেহটিকে হয় জঙ্গলে রেখে আসে, অথবা, কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলে বসার ভঙ্গিতে, বা কাত করে শুইয়ে, গোগোদের মত কবর দেয়। পথ চলতে চলতে কেউ মারা গেলে, দেহটা নিছকই একপাশে ফেলে দেওয়া হয়।। জঙ্গলের পরিচ্ছন্নতম পরিষ্কর্তা হায়নার খাদ্য হিসেবে। সুলতানকে গ্রামের মধ্যে সমাধিস্থ করা হয়।
দেশের উত্তরাংশের ন্যামওয়েজিরা খুবই পরিশ্রমী। নিজেদের দরকারের লোহা তারা নিজেরাই গলিয়ে বার করে। ট্যাঙ্গানিকা থেকে উসাগরা অবধি প্রায় সব কোদালই তাদের তৈরি । ইউন্যানিয়েম্বে থেকে কোদাল না কিনে কোন কাফেলা ফেরে না। এই কোদাল দিয়ে তারা গোগোদের নজরানা মেটায়। এইভাবে আমদানি করা লোহার জিনিসপত্র দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম দিকের উপজাতিরা অনেক প্রয়োজন মেটায়। এর থেকে তারা বর্শা, তীরের ফলা, দা এবং যুদ্ধের কুঠার বানায়। উন্যানয়েম্বেতে প্রায়শই দেশী কারিগরদের দেখা যায় কাপড়ের বদলে মারাত্মক সব যন্ত্রসম্ভার ফিরি করতে। দু’গজ কাপড়ের বিনিময়ে একটা নতুন বর্শা, বা এক ডজন তীর; চার গজ চাদরের বদলে একটি খুব ভাল মানের, পিতল-তামার তারে সাজানো ধনুক পাওয়া যাবে। আর একটা মাঝারি চেহারার কুঠারের জন্য দুই গজ চাদর হলেই হবে। এই শেষের অস্ত্রটা, বইয়ের ছবিতে যেমন দেখা যাচ্ছে, প্রস্তর যুগে পিক্টরা১ বা ইতিহাসের আদি পর্বে রোমান ও মিশরীয়রা যেমন অস্ত্র ব্যবহার করত, সেই রকম। একদিকে বাগামোয়ো থেকে সান সালভাদর অবধি, অন্য দিকে নুবিয়া থেকে কাফির-ল্যান্ড অবধি সর্বত্র এরকম কুঠার ব্যবহার হয়।
কিন্যামওয়েজিতে দেবতাকে বলা হয় মিরিঙ্গু; কিগোগোতে তাকে বলা হয় মুলুঙ্গু; আর কিসোওয়াহিলিতে বলা হয় মিয়েঞ্জি মুঙ্গু। ন্যামওয়েজিরা তাকে সম্পদ বিতরণকর্তা ও সবকিছুর স্রষ্টা হিসাবে দেখে। নিজেদের পার্থিব সম্পদ বৃদ্ধির জন্য ছাড়া খুবই কম তার কাছে প্রার্থনা করা হয়। যখন উন্যামওয়েজিতে কোন পরিবারের কেউ মারা যায়, তখন মৃতের আত্মীয়রা বলে যে "মিরিঙ্গু তাকে নিয়ে গেছে;" বা, "সে হারিয়ে গেছে।" "সবই ঈশ্বরের কর্ম।" আর যে রকম শ্রদ্ধার সঙ্গে কথাটা বলে তাতে বোঝা যায় যে "এটা তাদের চোখে কত বিস্ময়ের।"
"কোন তরুণী কি তার অলঙ্কারের কথা ভুলে যেতে পারে? নাকি কোন বিয়ের কনেই তার সাজপোশাক ভুলে যেতে পারে?" উন্যামওয়েজিতে এগুলো হতে পারে বলে মনে হয় না। যে মুহূর্তে মেয়ে মা বলে ডাক দেয়, সেই মুহূর্ত থেকেই অলঙ্কার তার সারাক্ষণের মাথাব্যথার কারণ। লাল, হলুদ, সাদা ও সবুজ পুঁতির সুন্দর কব্জি-ভরা গয়না দেখতে তার ভারি পছন্দ। তার গাঢ়-রঙা ত্বকের উপর তারা এক বৈপরীত্য তৈরি করে; গলার থেকে ঝোলা বিভিন্ন রঙের পুঁতির লম্বা মালাতে সারাক্ষণ আঙ্গুল জড়ানো তার পছন্দের খেলা। বা কোমর ঘিরে থাকা চন্দ্রহার নিয়ে খেলতেও সে খুব পছন্দ করে; এমনকি সে তার চুলকেও পুঁতির অলঙ্কারে সাজায়, আর শুনতে ভালবাসে যে তাকে কত সুন্দর দেখাচ্ছে! একটা সর্পিল তারের কটিবন্ধ পেলেই সে খুশি, তার সঙ্গে পড়ার মতন কোনও পোশাক না থাকলেই বা কি! অধৈর্য হয়ে সে নিজের বিয়ের দিনটির অপেক্ষা করে, যখন সে শরীরে জড়ানোর জন্য একটা কাপড় পাবে । যতদিন না সে তার মুরগির বিনিময়ে আরব বণিকদের পসরা থেকে সস্তা চকমকে জিনিস কেনার মতন স্বাধীন না হয়ে ওঠে, ততদিন এইটুকুতেই তার আনন্দ!
অ্যাংলো-স্যাক্সন দেশগুলোতে মহিলাদের যে চা-পার্টিগুলো তার উৎস মনে হয় বহু পুরোনো। মিশর যখন সভ্য জাতির তালিকার শীর্ষে ছিল, তখনও এই প্রথা বা এই ধরণের সমাবেশের চল ছিল। মেমফিসের উদ্ধার-হওয়া দেয়ালে প্রাচীন মিশরের ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখেছে অথচ মহিলাদের সামাজিক জটলার দৃশ্য চোখে পড়েনি এমন কি কেউ আছে? আবিসিনিয়ার মতন প্রাচীন রীতিনীতিতে নিষ্ঠাবান দেশেও এই রকম মেয়েদের সভা দেখেছি। উন্যামওয়েজিতেও এমন মেয়েদের আড্ডা দেখা যায়। সূর্যাস্তের সময় বিভিন্ন বাড়ির মেয়েরা জড়ো হয়ে একসঙ্গে বসে সারাদিনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে- অতিশয় মামুলি কথাবার্তা, একটা কিন্যামওয়েজি যৌথ আলোচনার আসরে আর কিই বা কথা হবে - কিন্তু কিন্যামওয়েজির গ্রামের বয়স্কা -যুবতী নির্বিশেষে সবার মুখে যে সুখ ও নিখুঁত পরিতৃপ্তির ছবি দেখেছি, কদাচিৎ এরকম দৃশ্য দেখা যায়! প্রতিটি মহিলা যার যার নিজের পিঁড়েতে বসে, আর তার উঠতি বয়সের মেয়ে তার পাশেই বসে। মা যখন মনের আনন্দে গল্পে মত্ত আর ধূমপান করতে ব্যস্ত, মেয়ে তখন চটপট হাতে মায়ের মাথার পশমি চুলগুলো দিয়ে অজস্র বিনুনি বেঁধে ফেলে, কুঞ্চিত অলকচূর্ণে মাকে সাজিয়ে তোলে। বয়স্কারা গোল করে উবু হয়ে বসে পাখির মতন কিচিরমিচির করে নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয়। কেউ বলে, তার গরুটা দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, কেউ আবার বলে সে কত বেশি দামে সাহেবের কাছে তার দুধ বেচেছে - কেউ হয়ত বলে সেদিন মাঠ নিড়ানোর সময় তার সঙ্গে কি হয়েছে, কেউ আবার বলে তার কর্তা কিন্যামওয়েজি রাজধানীতে ফসল বেচতে গেছে কিন্তু এখনও ফেরেনি।