ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে চলছে উজিজির পথে যাত্রার বর্ণনা। তরজমায় স্বাতী রায়
আধঘণ্টার চলার পর চারপাশের ছবিটা বেশ জীবন্ত হয়ে উঠল। শ-ও মুগ্ধ হতে লাগল। বোম্বে আমাদের ঝগড়া ভুলে গিয়েছিল, এবং আমাকে ভরসা দিল যে, যদি আমি মিরাম্বোর দেশ পেরোতে পারি, তবে আমি টাঙ্গানিকাতেও পৌঁছব; মাব্রুকি বার্টনেরও ধারণা যে আমরা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব। উন্যানয়েম্বেতে সেলিম এত জ্বরে ভুগেছে যে সে জায়গাটা ছাড়তে পেরে খুশি। সামনে সুন্দর উপত্যকা ছাড়িয়ে পাহাড় ঠেলে উপরের দিকে উঠেছে। পাহাড়ের মাথা তুলে দাঁড়ানোর মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যা আমাকে চনমনে করে তুলল আর এগিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ যোগাল।
দেড় ঘণ্টার মধ্যে, আমরা এমকওয়েনকয়ের কিন্যামওয়েজি গ্রামে আমাদের শিবিরে পৌঁছলাম। জায়গাটা আমাদের বিখ্যাত গাইয়ে মাগাঙ্গার জন্মস্থান।
আমার তাঁবু খাটানো হল, মালপত্র সব টেম্বেতে গুছিয়ে রাখা হল; তবে দলের অর্ধেক লোক তাদের বৌ আর নাগরীর আদর খেতে কুইহারাতে ফিরে গেল।
রাতের দিকে আমার আবারও জ্বর এল। সকালের আগেই তা চলে গিয়েছিল, তবে ভয়ানক দুর্বলতায় কাতর করে দিয়ে গেল। শুনতে পেলাম যে দলের লোকরা আগুন পোহাতে পোহাতে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করছে, পরের দিন যাওয়া হবে কি হবে না! তাদের মূল প্রশ্ন এই যে আমি কি পদযাত্রা চালিয়ে যাব! বেশিরভাগই একমত যে, যেহেতু সাহেব অসুস্থ, তাই হাঁটা বন্ধ থাকবে। তাদের গা-জ্বালান অলসতাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটা ভয়ানক রকমের জেদ চাপল। তবে তাদের প্রস্তুত হওয়ার জন্য ডাক দিতে আমি যখন আমার তাঁবু থেকে বেরলাম, দেখা গেল অন্তত বিশ-জন নিখোঁজ; আর ‘কাইফ-হালেক' (আক্ষরিক অর্থ, কেমন চলছে?) যে কিনা লিভিংস্টোনের চিঠি-পত্র নিয়ে যাচ্ছিল, ডাঃ লিভিংস্টোনের চিঠির থলে নিয়ে সে এসে পৌঁছায়নি।
তাকে খুঁজে বার করার জন্য বাছাই করা কুড়ি-জন বিশ্বাসী পালোয়ানকে উন্যানয়েম্বেতে পাঠালাম। আর সেই সঙ্গে সেলিমকেও শেখ বিন নাসিবের কাছে পাঠালাম। দাসদের বাঁধার একটা লম্বা শিকল কিনে হোক বা ধার করে হোক, নিয়ে আসার জন্য।
রাতের দিকে আমার বিশ-জন গোয়েন্দা নিখোঁজদের মধ্যে ন’জনকে পাকড়াও করে নিয়ে এল। জিজির লোকেরা একজোট হয়ে পালিয়েছে, তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেলিম একটি শক্ত শিকল নিয়ে ফিরে এল, অন্তত দশজনকে সেই শিকলে আটকে রাখা যাবে। কাইফ হালেকও চিঠির থলি নিয়ে এসে হাজির, আমার তত্ত্বাবধানে সে সেটা লিভিংস্টোনকে পৌঁছে দেবে। তারপর সবাইকে ডেকে দাস-শৃঙ্খলটা ভাল করে দেখানো হল। তাদের বললাম যে আমিই প্রথম শ্বেতাঙ্গ যে একটা দাস-বাঁধার শিকল সঙ্গে রেখেছি। কিন্তু, তারা যেহেতু সঙ্গে যেতে এতই ভয় পাচ্ছে, অতএব এটা ব্যবহার করতে বাধ্য হব, সবাইকে একসঙ্গে করে রাখার এটাই একমাত্র উপায়। ভাল লোকদের ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। তবে যারা দল ছেড়ে পালাবে, সেই চোরগুলো যারা টাকা-পয়সা উপহার বন্দুক গোলাবারুদ সব পেয়েছে আর তারপরেও দল ছেড়ে পালাচ্ছে, এটা তাদের জন্য। এখন কাউকে শিকলে আটকাব না; কিন্তু আজকের পর থেকে যেই পালাবে, অমনি চলা থামাব আর যতক্ষণ না তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ আর এগোব না। তার পরে তাকে গলায় শিকল বেঁধেই উজিজির দিকে যেতে হবে। ‘শুনতে পেয়েছ?’ ‘হ্যাঁ,’ উত্তর এল। ‘বুঝতে পেরেছ?’— 'হ্যাঁ.'
সন্ধ্যে ছ’টার সময় শিবির গুটিয়ে ইনেসুকার রাস্তা ধরলাম, রাত আটটায় সেখানে পৌঁছলাম।
পরদিন সকালে যখন আমরা হাঁটতে শুরু করব, দেখা গেল আরও দু'জন পালিয়েছে। বারাকা ও বোম্বেকে অবিলম্বে উন্যানয়েম্বেতে পাঠানো হল আসমানি আর কিঙ্গারু নামের নিখোঁজ দুজনকে ফিরিয়ে আনার জন্য। বলে দেওয়া হল যে তাদের ছাড়া যেন ফিরে না আসে। পাঠকের হয়তো মনে থাকবে যে পরের লোকটা এই নিয়ে তৃতীয়বার পালাল। যখন ওদের খোঁজ চলছিল, তখন আমরা ইনেসুকা গ্রামে থেমে রইলাম, অন্য কারোর জন্য থামা যত না দরকার, শ-এর জন্য সব থেকে বেশি।
সন্ধ্যাবেলায় দলত্যাগীদের ফিরিয়ে আনা হল। এরা কোনভাবেই শুধরানোর না। যেমনটা হুমকি দিয়েছিলাম, আচ্ছাসে চাবুক মেরে তাদের শিকলে বেঁধে দিলাম। আর যাতে পালাতে না পারে। বোম্বে এবং বারাকা গ্রেফতারির ঘটনার দারুণ বিবরণ দিল। আমার তখন মনমেজাজ খুব ভাল। তাই কাজ সুসম্পন্ন করার জন্য তাদের সকলকে একটা করে মিহি কাপড় পুরস্কার দিলাম।
পরের দিন সকালে আরেকজন কুলি পালাল, সঙ্গে নিয়ে গেল তার মজুরির পনেরটা নতুন কাপড় আর একটা বন্দুক। কিন্তু উন্যানয়েম্বের কাছে আরও বেশিদিন অপেক্ষা করাটা বিপদের। শুধুমাত্র দক্ষিণের জঙ্গুলে জায়গার মধ্যে দিয়ে একটুকুও না থেমে ক্রমাগত চললেই সে বিপদ এড়ানো সম্ভব। আমার দলবলের একজন, দুর্দান্ত আবদুল কাদেরের কথা হয়তো অনেকের মনে থাকবে। সেই যে দর্জি, যে কিনা আফ্রিকার বিস্তৃত অন্দরে হাতির দাঁতের সম্পদ পাওয়ার মত জ্বলজ্বলে বাসনা নিয়ে বাগামায়ো থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। আজ সকালে, সামনের পথের বিপদের খবরে আতঙ্কিত হয়ে, আবদুল কাদের ছাড়া পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠল। কসম খেয়ে বলল যে সে অসুস্থ — আর এক পাও এগোতে পারবে না। লোকটাকে নিয়ে একেবারে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কাপড় দিয়ে তার পাওনা-গন্ডা মিটিয়ে দিলাম আর চলে যেতে বললাম।
কাসেগেরার পথে প্রায় অর্ধেকটা যাওয়ার পরে পথের মধ্যেই মাবরুক সেলিম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। চিকিৎসা হিসেবে তাকে ক্যালোমেলের একটা দানা আর কয়েক আউন্স ব্র্যান্ডি খাওয়ানো হল। সে আর হাঁটতে পারছে না, তাই তাকে একটা গাধার পিঠে চড়তে বললাম। জাইদি নামের আরেকজন বাত-জ্বরে অসুস্থ ছিল; এছাড়া শ যে প্রাণীটার পিঠে চড়েছিল তা থেকে দুবার গড়িয়ে পড়ল আর বিস্তর অনুরোধ-উপরোধের পরে সে আবার গাধায় পিঠে উঠছিল। সত্যি, আমার অভিযানটার উপর যেন রাহুর ছায়া পড়েছে, মনে হচ্ছিল যেন ভাগ্যদেবী চান যে আমরা ফিরে যাই। যেন সবকিছুই উড়ে-পুড়ে নষ্ট হতে বসেছে। উন্যানিয়েম্বের থেকে অন্তত পনেরো দিন দূরে থাকলে যেন বেঁচে যাব!
আমরা এসে পৌঁছানোর পরে কাসেগড়ায় সেদিন দুপুর আর সন্ধ্যা জুড়ে ভারি সব আনন্দের দৃশ্য। এতদিন যারা ছিল না, তারা সবে উপকূল থেকে ফিরে এসেছে, যুবকদের জমকালো জামাকাপড়ে বেশ বীরপুরুষের মতন লাগছে। নতুন বারসাতি, সোহারি ও উজ্জ্বল নতুন কানিকির লম্বা পোশাক— ঝোপের আড়ালে সেসব পরে হঠাৎ সেজে-গুজে যুবকেরা হাজির হল। মাইনেডদের মত মেয়েরা হিহি করছিল আর গোটা সন্ধ্যে ভরে জোরে, ঘন ঘন ও প্রবলোত্সাহে উলু দিচ্ছিল। কৃশকায়া মেয়েরা তরুণ বীরদের দিকে গদগদ হয়ে তাকাচ্ছে; বুড়িরা আদর করে তাদের গায়ে হাত বোলাচ্ছে; লাঠি হাতের বেঁকা-পিঠের বুড়োরা তাদের আশীর্বাদ করছে। উন্যামওয়েজিতে একেই খ্যাতি বলে! সকল ভাগ্যবান যুবকরা ভোররাত অবধি গল্প শোনাল- বিশাল সমুদ্রের কাছে আর জাঞ্জিবার দ্বীপের উনগুজাতে যা কিছু চমৎকার জিনিস দেখেছে তার বর্ণনা দিচ্ছিল, কীভাবে দুর্দান্ত সাদা পুরুষদের জাহাজ আর অনেক অনেক সাহেব দেখেছে, ভয়ঙ্কর গোগোদের দেশ পেরনোর সময় তাদের কত বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে, কত না পরীক্ষা দিতে হয়েছে- আরও কত কত বিচিত্র তথ্য, যেগুলোর সঙ্গে পাঠক ও আমি ইতিমধ্যেই পরিচিত হয়েছি।
২৪ তারিখে আমরা শিবির গোটালাম, আর ইমবিটির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ-নৈঋত কোণের দিকে চলতে লাগলাম। প্রায় তিন ঘণ্টার মধ্যে কিগান্ডুতে এলাম।
এই গ্রামটা এমকাসিওয়ার মেয়েরা শাসন করে। গ্রামে পৌঁছানোর আগেই আমাদের জানানো হয়েছিল যে খাজনা না দিলে আমরা ঢুকতে পারব না। খাজনা দেব না বলে, আমরা কিগান্ডুর বাঁদিকে এক মাইল দূরের একটা ভাঙ্গা, ইঁদুর থিকথিক করা পাঁচিল-ঘেরা জায়গায় শিবির স্থাপন করতে বাধ্য হলাম। চরম দরকারের সময় এমকাসিওয়াকে ছেড়ে চলে আসার জন্য এখানকার ভিতু লোকরা খুবই নিন্দা-মন্দ করছিল। আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
শিবিরের প্রায় দোরগোড়ায় গাধার পিঠ থেকে নামতে গিয়ে শ রেকাব খুঁজে না পেয়ে হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। মিস্টার শ'-র ছোট নাটকটা বড্ড ঘন ঘন হচ্ছে। তাই, তাকে সাহায্য করার জন্য লোকেরা ছুটে এলে, আমি তাদের চলে যেতে বললাম, শ একাই থাক। বোকা লোকটা ওই প্রখর রৌদ্রে পুরো এক ঘণ্টা মাটিতে পড়ে রইল, আর তারপর আমি যখন তাকে সহানুভূতি-হীনভাবে জিজ্ঞাসা করলাম যে তার কোন অস্বস্তি হচ্ছে কিনা, তখন সে উঠে বসল আর বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠল।
‘ফিরে যেতে চাও, মিঃ শ?’
‘যদি আপনি দয়া করে ছেড়ে দেন। মনে হয় না যে আমি আর যেতে পারব, এবার আপনি যদি যথেষ্ট সদয় হন, তাহলে আমি ফিরে যেতে খুবই চাই।’
(ক্রমশ...)