ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে উকাওয়েন্দি রাজ্যের মধ্যে দিয়ে চলার অভিজ্ঞতা। তরজমা স্বাতী রায়
১৩ তারিখে আমরা পাহাড়ের শিরা বেয়ে বেয়ে এগোতেই থাকলাম। এই ক্রমাগত ওঠা ও নামার ফলে আগে কখনো কেউ পা রাখেনি এমন সব উপত্যকা ও পর্বতমালা আমাদের চোখে ধরা দিচ্ছে; উত্তর বাহিনী নদীগুলো বৃষ্টিতে ফুলে উঠেছে, এক বিশাল আদিম বন, এর আবছা ছায়ায় আগে কোন সাদা মানুষ হাঁটেনি।
১৪ তারিখেও একই দৃশ্য দেখতে দেখতে চলা - টানা উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত পাহাড়, একটা আরেকটার সঙ্গে সমান্তরাল - টাঙ্গানিকা হ্রদের সঙ্গেও। শৈলশিরাগুলোর পূর্ব ঢালে হঠাৎ হঠাৎ-ই গভীর উপত্যকা থেকে উঠে আসা খাড়া ঢাল ও ধাপ মতন দেখা যায়। যখন পশ্চিম দিকটা অবশ্য অনেকটা বেশি ঢালু। এটা ট্যাঙ্গানিকা পূর্ব দিকে জলবিভাজিকা উকাওয়েহদির অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য।
এই উপত্যকাগুলোর মধ্যে একটাতে এইদিন আমরা লালচে দাড়িওয়ালা বানরদের একটা দলের মুখোমুখি হয়েছিলাম। কাফেলা দেখে তাদের চিৎকার, চেঁচামেচি গোটা এলাকা জুড়ে শোনা যাচ্ছিল। তারা গাছ বেয়ে তরতরিয়ে অনেক উপরে উঠে যাচ্ছিল আর চেঁচিয়ে-মেচিয়ে যেন যুদ্ধের ডাক দিচ্ছিল - ফলে তাদের কাছে ঘেঁষতে পারিনি। তবে তারপরেও আমাদের এগিয়ে যেতে দেখে তখন আবার মাটিতে নেমে এলো; ওদের পিছনেই পড়ে থাকতাম যদি না হঠাৎ মনে পড়ত যে আমার অনুপস্থিতি আমাদের অভিযানকেও থামিয়ে রেখেছে।
দুপুর নাগাদ বিশাল শৈলশিরা ধরে দ্রুত "কুমীর" নদীর দিকে যাচ্ছিলাম। তখনই আমরা আমাদের ম্যাগডালাটিকে১ দেখতে পেলাম - একটা বিশাল উঁচু পর্বত - তার ভয় -দেখানো খাড়া চেহারা নজর কাড়ল। চার পাশের সমতলের মাঝে মাথা উঁচু করে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশের জঙ্গলে ঢাকা সমভূমি প্রাচীন, রহস্যময় সৌন্দর্য জড়ানো। তারপরে একসময় সাদা হয়ে গেল সব। একটা পাতলা সরের মতন কুয়াশার আদুরে চাদর ঢেকে দিল সবকিছু। এখন আমাদের চারপাশে উজ্জ্বল সবুজ। প্রতিটি বৃক্ষ - তরুলতা-গুল্ম বৃষ্টির জল মেখে দ্রুত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। গ্রীষ্মকালের গরমের দিনে যে নদীগুলো চলতে ভুলে যেত, সেগুলো এখন ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বেগবতী, জঙ্গল ঘেরা খোলা প্রান্তরে তার কলকলানি শোনা যাচ্ছে। অনেকগুলো জলধারা পেরলাম - সেগুলো সব কটাই রুফুগুর উপনদী।
সুন্দরী, মোহিনী উকাওয়েন্দি! এই রাজ্যের সীমানার মধ্যের বন্য, স্বাধীন, ঘন সবুজ, স্বতঃস্ফূর্ত প্রকৃতির সঙ্গে কিসের তুলনা করব? ইউরোপের কোন কিছুর ? নাকি এশিয়ার কিছুর সঙ্গে? কোথায়? হয়ত ভারতের সঙ্গে কিছুটা মেলে। হ্যাঁ; অথবা মিংরেলিয়া ও ইমেরিশিয়ার২ কথা বলতে হয়। কারণ সেখানেও ফেনিল নদী আছে; সুরম্য টিলাও আছে; আছে উদ্ধত পাহাড়, আকাশ ছোঁয়া পর্বত আর বিস্তৃত বন, সুউচ্চ সরল গাছের সারি, তাদের ফাঁক দিয়ে অনেক দূরের দৃশ্যও নজরে আসে, এখানেও যেমন দেখা যাচ্ছে । একমাত্র উকাওয়েন্দিতেই যেন গাছপালার ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠাও প্রায় দেখা যায়; পৃথিবী এখানে এতই উদার, প্রকৃতি এতই প্রেম-ভরা, দয়া-ময়, যে এখানে থেকে যাওয়ার ইচ্ছেকে একটুও আমল না দিলেও, বা নিতান্ত প্রয়োজনের অতিরিক্ত এই তিমিরাচ্ছন্ন পরিবেশে শ্বাস নেওয়ার একটুও ইচ্ছা না থাকলেও, জায়গার প্রতি কেমন একটা অজানা টান অনুভব করা যায়। এই জায়গার মনোহারী, চোখ-ধাঁধানো সৌন্দর্যের নীচে সবকিছুই নোংরা হলেও, সভ্য লোকেরা সেই নোংরা দূর করতে পারে - পুরো অঞ্চলটাকে স্বাস্থ্যকর, সেই সঙ্গে উত্পাদনশীল করে তুলতে পারে। জানতাম যে এই সৌন্দর্যের মধ্য থেকেই আমার ম্যালেরিয়া জ্বরটিরও উদ্ভব - তার চাপে আমার শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, আমার শরীর-মনের সব শক্তি সে শুষে নিচ্ছে - এমনকি ভয়ানক অসুখের চাপে আমি টলমল করতে থাকলেও, মন তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়ে উঠতে থাকলেও, মাঝেমাঝেই পৌনঃপুনিক জ্বরের ধাক্কায় মাথা ঘুরে উঠলেও, জায়গাটার লোভনীয় চেহারার প্রতি এক মোহময় ভালবাসা অনুভব করছি। যতই জায়গাটার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, একটা দুঃখের ভাব যেন মন ছেয়ে যাচ্ছে - ভাগ্যের টানে উকাওয়েন্দি থেকে দূরে চলে যেতে হচ্ছে বলে যেন ভাগ্যের সঙ্গেই কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে ইচ্ছা হচ্ছে।
ট্যাঙ্গানিকার উপকূল থেকে যাত্রা শুরুর নবম দিনে আমরা আবার আমাদের "ম্যাগডালা পর্বত" দেখতে পেলাম, উত্তর-পূর্ব দিকে অন্ধকার মেঘের মতো জমে রয়েছে। দেখেই বুঝলাম যে আমরা ইমরেরার কাছে চলে এসেছি। উকাওয়েন্দির বিজন জঙ্গল পেরনোর আমাদের ইকারাস৩-তুল্য প্রচেষ্টা শীঘ্রই সাফল্যের মুকুট মাথায় তুলবে। পথপ্রদর্শকদের সম্মিলিত পরামর্শের বিপরীতে গিয়ে আমি শুধুমাত্র কম্পাস ও আমার চার্ট ধরে চলার সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলাম। দলের সবাই ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়বে এরকম সব অনুমানের কথাও কানে তুলিনি। গাইডরা আমার পথ বদলে দক্ষিণ-পশ্চিম মুখো পথ ধরতে খুবই প্ররোচিত করতে চেয়েছিল, সেসব কথা শুনলে নিঃসন্দেহে দক্ষিণ-পশ্চিম উকোনঙ্গো বা উত্তর-পূর্ব উফিপাতে পৌঁছে যেতাম। বুড়ো, অভিজ্ঞ সৈন্যরা দুঃখের সঙ্গে জানতে চেয়েছিল যে তাদের না খাইয়ে মারাই আমার সংকল্প কিনা, কারণ আমার উত্তর-পূর্ব দিকের রাস্তাটাই নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি কম্পাসে আস্থা রাখতে পছন্দ করেছিলাম। ওই আদিম জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে, নদী পেরিয়ে, খাড়া শৈল শিরা বেয়ে উঠে আবার গভীর উপত্যকায় নেমে এক পা এক পা করে এগোনোর সময়, একটুও সূর্যের আলোর দেখা মেলেনি । ঘন কুয়াশায় ঢাকা অরণ্য; প্রায়শই বৃষ্টির ধাক্কা খেতে হত; গোটা আকাশ যেন ধূসর বাষ্পের অতল গভীরতায় ঢাকা। ডাক্তারের অবশ্য আমার উপর গভীর আস্থা ছিল, আর আমি আমার পথেই চলেছিলাম।
শিবিরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে লোকেরা খাবারের সন্ধানে বনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। কাছেই পাওয়া গেল সিংওয়ে গাছের ঝোপ। প্রচুর মাশরুম গজিয়ে আছে - পেট ঠান্ডা করার জন্য যথেষ্ট। এতটা বৃষ্টির আবহাওয়া না হলে, শিবিরের জন্য শিকার জোগাড় করা সম্ভব ছিল; কিন্তু প্রবল ক্লান্তি ছিল আর জ্বরের কারণে দুর্বলও ছিলাম। তাই একবার চলা থামানোর পরে আর শিবির ছেড়ে বেরোতে পারিনি। আমাদের চারদিকে খুবই সিংহের ভয় ছিল, দিনরাত তাদের ভয়ানক গর্জন শোনা যেত, শিকারিরা সেই শুনে এতই ভয় পেয়েছিল যে, শিবিরে নিয়ে আসা প্রতিটা শিকারের জন্য পাঁচটা করে কাপড় বকশিস দেওয়ার কথা বললেও, কেউই শিবিরের কাঠের বেড়ার মধ্যের পরিচিত নিরাপত্তা ছেড়ে সেই বিষণ্ণ প্রান্তরে পা রাখতে সাহস করেনি।