ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনি। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে স্ট্যানলে বর্ণনা করছেন সাগারা জনগোষ্ঠীর মানুষদের কথা। তরজমা স্বাতী রায়
ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনি। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে স্ট্যানলে বর্ণনা করছেন সাগারা জনগোষ্ঠীর মানুষদের কথা। তরজমা স্বাতী রায়
সেগুহহা থেকে বিশুদ্ধ সাগারাদের আলাদা করার মোটাদাগের তফাতগুলো পূর্ব উসাগারায় দেখা যায় না। আমরা প্রথমে তাদের এমপওয়াপওয়া গ্রামে দেখতে পাই। এখানে প্রথম দেখা গেল লম্বা পাতলা কোঁকাড়ান চুল, পিতল এবং তামার দুল, বল, ঝকঝকে জাঞ্জিবারের পয়সা দিয়ে সাজানো ছোট ছোট পুঁতির সরু রেখা অলকচূর্ণের মধ্যে দিয়ে এখানে -ওখানে ঘুরছে।
তরুণ সাগারারা সুদর্শন তরুণ আফ্রিকান বর্বরের সৌন্দর্যের আদর্শের উদাহরণ। তার মুখের মরা কালো রং হালকা গৈরিক ছোঁয়ায় বাদামীবর্ণের, তার কপালের উপর চার-পাঁচটি উজ্জ্বল তামার মুদ্রার সজ্জা, প্রতিটি কানে কানের লতিগুলোকে টেনে লম্বা করে একটি করে ছোট্ট লাউয়ের গোড়া ঝোলানো, মাথায় সহস্রাধিক তেলচকচকে কেশচূর্ণ পিতল এবং তামার ছোট ছোট টুকরো দিয়ে সাজানো, মাথাটি সুচারুভাবে পিছনে হেলান, চওড়া বুকটি চিতিয়ে রাখা আর সেই সঙ্গে তার পেশীবহুল বাহু এবং সমানুপাতে পা— সৌন্দর্যের প্রতিনিধিই বটে।
সাগারা, পুরুষ ও মহিলা উভয়েই, কপাল, বুক এবং বাহুতে উলকি আঁকে। প্রতিটি কানে লাউএর গোড়া ঢুকিয়ে রাখে। সেখানে তার 'তুম -বাক', বা তামাক জমানো থাকে, আর সেই সঙ্গে শামুকের খোল পোড়ানো চুন। তার গলায় বেশ কয়েকটা আদিম অলঙ্কার, যেমন দুটো-তিনটে ধরধবে সাদা কড়ি, খোদাই করা কাঠের টুকরো, বা একটি ছোট ছাগলের শিং, বা নিজস্ব উপজাতির ওঝার পবিত্রভাবে তৈরি করা কিছু ওষুধ, সাদা বা লাল পুঁতির ফান্ডো, অথবা দুই বা তিনটি গাঁথা সুঙ্গোমাজি ডিম, পুঁতি কিংবা এক ছড়া তামার মুদ্রা, আর কখনও কখনও সস্তা পয়সার ঘড়ির চেইনের মত ছোট পিতলের চেইন। এই জিনিসগুলো হয় তারা নিজেরাই তৈরি করেছে অথবা আরব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মুরগি বা ছাগলের বিনিময়ে কিনেছে। শিশুরা সবাই উলঙ্গ হয়ে ঘোরে; যুবকরা ছাগল বা ভেড়ার চামড়া পরে; প্রাপ্তবয়স্ক লোকেরা যারা সন্তানের মা বাবা, তারা দেশী কাপড়ের বা কানিকির বা বারসতির টুকরো কোমরে জড়ায়। বারসতি উসাগারায় খুবই পছন্দের রঙের কাপড়; সর্দাররা মৃমা দেওয়ানদের মত মাথায় ক্যাপ বা আরব তারবুশ[i] পরে।
“হ্যাঁ, যদি তার ছেলে থাকে, তো সে সুলতান হয়; আর যদি তার ছেলে না থাকে, তাহলে পদাধিকারের দিক দিয়ে সুলতানের ঠিক পরেই যে থাকে সেই সুলতান হয়। সাগিরা হলেন সুলতানের সব থেকে কাছের লোক, তাঁদের কাজ হল সকল অভাব-অভিযোগ শোনা এবং সুলতানকে জানানো। সুলতানের মাধ্যমে তিনিই ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করেন; তিনিই নজরানা নেন, সেটা প্রভু অর্থাৎ সুলতানের কাছে নিয়ে যান, তাঁর সামনে ধরে দেন, সুলতান যেটুকু যা ইচ্ছে তা তুলে নেন, বাকিটা সাগিরাই পান। এমনিতে সর্দারদের মান্য-পারা বলা হয়; সাগিরা হলেন প্রধান মান্য-পারা।’’
‘‘গোগোরা বিয়ে করে কিকরে?’’
‘‘ওহ্, তারা তাদের বৌদের কেনে।’’
‘‘কিরকম দাম পড়ে একজন মেয়ের?’’
“খুব গরীব মানুষেরা মেয়ের বাবাকে কয়েকটা ছাগল দিয়ে বৌ কিনতে পারে।’’
‘‘আর সুলতানদের কত টাকা দিতে হয়?’’
‘‘সে তিনি কনের বাবাকে প্রায় শতখানেক ছাগল, বা এত এত গরু, ভেড়া ও ছাগল দেন। তা তো হবেই, আরে তিনি হলেন দেশের রাজা । তিনি তো আর হাবিজাবি মেয়ে কিনবেন না। মেয়ের বাপের অনুমতি নিতে হবে, গবাদি পশু হাত বদল করতে হবে। দুপক্ষের কথা-বার্তাই তো চলে অনেক দিন ধরে। কনের পরিবার ও বন্ধুদের সকলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা শেষ হলে তবেই মেয়ে বাপের বাড়ির বাইরে পা দেয়। "
‘‘কেউ কাউকে খুন করলে, খুনীকে নিয়ে তোমরা কি করো?’’
‘‘যে মেরেছে তাকে পঞ্চাশটা গরু জরিমানা দিতে হয়। তবে সে যদি খুবই গরীব হয়, কিছু দিতে না পারে, তখন সুলতান নিহত মানুষের আত্মীয়-স্বজনকে হত্যাকারীকে মেরে ফেলার অনুমতি দেন। এবার তারা খুনিকে ধরতে পারলে, প্রথমে তাকে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধে, আর তারপর তার দিকে বর্শা ছোঁড়ে— প্রথমদিকে একটা একটা করে; তারপর খুনির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার মাথা কেটে দেয়, তারপর তার হাত-পা কেটে দেয় আর দেশজুড়ে সেগুলো ছড়িয়ে দেয়।’’
‘‘তোমরা চোরকে কি করে শাস্তি দাও?’’
‘‘চুরি করতে দেখা গেলে, সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলা হয়, আর এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করা হয় না। একটা চোরকে নিয়ে কিই বা বলবে কেউ?’’
‘‘কিন্তু ধরো তোমরা সঠিক জানো না যে কে চোর!’’
‘‘কারোর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আসার পর আমরা একটা মুরগি কাটি। যদি তার পেটের ভিতরটা সাদা হয়, তাহলে সে নির্দোষ আর যদি হলুদ হয় তাহলে সে দোষী।’’
‘‘তোমরা জাদুবিদ্যাতে বিশ্বাস কর?”
‘‘অবশ্যই বিশ্বাস করি, আর কেউ যদি গবাদি পশুদের জাদুটোনা করে, বা বৃষ্টি বন্ধ করে দেয় , তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।’’
উগোগোর ঠিক পরেই হল উয়ানজি, বা ‘মাগুন্ডা এমকালি’— উষ্ণ প্রান্তর। আগেকার দিনে, যখন উকিম্বুর থেকে লোকেরা এসে মাগুন্ডা এমকালিতে বসবাস শুরু করেনি, তখন কুলিরা এই এলাকা পেরনোর সময় প্রবল গরম ও তৃষ্ণার অভিযোগ করত। যে পথ দিয়ে তারা যেত, সেখানে জল প্রায় মেলে না। আর মাঝে মাঝেই সারা দিন ধরেই হাঁটতে হত— তাই ন্যামওয়েজি কুলিরা এই জায়গার নাম দিয়েছিল ‘উষ্ণ প্রান্তর’।
এখন এই উয়ানজি বা মাগুন্ডা এমকালি জায়গাটা মানুষে ভরা। মুনিয়েকা হয়ে যে উত্তরের পথটা গেছে, সেখানে যথেষ্ট জল পাওয়া যায়, ঘন ঘন গ্রাম, তাই আজকের যাত্রীরা নামটার মর্ম বোঝেন না। দক্ষিণ দিকের থেকে আসা কিম্বুরাই এখন এদেশে থাকে। তারা ভাল চাষবাস করে, খুবই পরিশ্রমী জাত। এদের দেখতে অনেকটা সাগারাদের মতো, তবে তাদের মত বীর পুরুষ হিসেবে এদের খ্যাতি নেই। এদের অস্ত্র বলতে হালকা বর্শা, তীর-ধনুক আর যুদ্ধ-কুঠার। এদের কুঁড়েগুলো বেশ পোক্ত ভাবে তৈরি, শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য বেশ দক্ষতার সঙ্গে সেগুলো বানানো। এদের দেওয়াল-ঘেরা গ্রামগুলোও বেশ দুর্ভেদ্যভাবে তৈরি – ঠিকমত লোকে পাহারা দিলে, শত্রুপক্ষের তা ভেদ করে ঢুকতে কামান ছাড়া গতি নেই। হাতি ও মহিষ ধরার জন্য ফাঁদ তৈরিতেও এরা খুবই দক্ষ। মাঝে মাঝেই তারা দলছাড়া সিংহ বা তাবাঘ ধরে আনে।
মাগুন্ডা এমকালির মধ্য দিয়ে চলার পরে, আমরা উন্যামওয়েজিতে এসে পৌছালাম, এ হল চাঁদের দেশ; এই সুন্দর এলাকায় বসবাসকারী মানুষের বিবরণ পরের কোন এক অধ্যায়ে দেওয়া যাবে খন।
(সপ্তম অধ্যায় শেষ)
[i] তারবুশ হল ফেজটুপির মত একরকম পুরুষ মানুষের টুপি, লাল ফেল্টের তৈরি, মাথার উপরে ট্যাসেল লাগানো।