ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। তরজমা স্বাতী রায়
আমাদের জাহাজটা উগোমার একটি বিশাল এমভুলে গাছ থেকে বানানো। এটা একটা নড়বড়ে ক্যানো ছাড়া আর কিছু নয়। এটা একটা আফ্রিকান আর্গো১। এর গ্রীক দেশীয় বিখ্যাত প্রতিরূপের থেকে অবশ্য এই জাহাজ অনেক বেশি ভাল কাজে নিযুক্ত। আমরা সোনার লোম আনতেও যাইনি, কোন ভাড়া খাটতেও যাইনি। বরং একটা বাণিজ্যপথ খুঁজতে গিয়েছিলাম যার মারফত নীলনদের জাহাজগুলো উজিজি, উসোওয়া এমনকি আরও দূরের মারুঙ্গু অবধি আসতে পারে।
টাঙ্গানিকার উত্তরপ্রান্তে কি যে আবিষ্কার করতে পারি তাও তখনও অজানা। ধরে নিয়েছিলাম যে দেখব রুসিজি নদী টাঙ্গানিকার থেকে বেরিয়ে আলবার্ট বা ভিক্টোরিয়া এন'ইয়ানজার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। স্থানীয়রা ও আরবরাও বলেছিল যে রুসিজি নদী এই হ্রদ থেকে বেরিয়েছে।
সাইদ বিন মাজিদ বলেছিল যে তার ক্যানোতে পঁচিশ জন লোক আর সাড়ে তিন হাজার পাউন্ড হাতির দাঁত ধরবে। সেই শুনে আমরা পঁচিশ জন লোককে নৌকায় তুলেছিলাম, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আবার লবণের বস্তা ছিল - স্থানীয়দের কাছে বেচার জন্য। কিন্তু উজিজির কাছের উপকূল থেকে যাত্রা শুরুর পরেই, বোঝা গেল নৌকা বেশি বোঝাই হয়ে গেছে। নৌকার ধার অবধি ডুবে যাচ্ছে। আবার তীরে ফিরে এসে, ছজন লোককে নামিয়ে দিলাম, সব লবণের বস্তাও নামিয়ে দেওয়া হল। ফলে আমাদের দলে আর মাত্র ষোলজন মাল্লা রইল। এছাড়া সেলিম, ফেরাজি নামের বাবুর্চি আর দুজন জিজি গাইডও ছিল।
এইভাবে নৌকা ঠিকঠাক বোঝাই করে আমরা আবার রওনা হলাম, বাংওয়ে দ্বীপের দিকে নৌকার মুখ ঘোরানো হল। উজিজির বন্দর থেকে জায়গাটা চার বা পাঁচ মাইল দূরে। এই দ্বীপ অতিক্রম করার সময় গাইডরা আমাদের জানাল যে কিছু বছর আগের তুতাদের আক্রমণের সময় আরব ও জিজিরা এইখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। সেবার তারা যখন উজিজি আক্রমণ করে, তখন তারা অনেককে হত্যা করে। শুধু যারা পালিয়ে দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল, তারাই একমাত্র তুতাদের আগুন ও তলোয়ার থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
সেই দ্বীপ পেরিয়ে, নদীর বিভিন্ন বাঁক ধরে নৌকা বেয়ে চলার পরে, আমরা কিগোমার অপূর্ব উপসাগর দেখতে পেলাম। টাঙ্গানিকার উপর দিয়ে বিভিন্ন দিকে বাতাস বয়ে যায়। সেই জন্যে এটা একটা দুর্দান্ত জাহাজঘাটা - প্রথম দেখাতেই তা বোঝা যায়। সকাল দশটার দিকে আমরা কিগোমা গ্রামের দিকে রওনা হলাম। তখন পূর্ব দিকে বাতাসের বেগ বাড়ছিল, যেন আমাদের নৌকা একেবারে সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
কিগোমা হল উজিজি থেকে উত্তরগামী নৌকাগুলোর বন্দর, বিশেষত যেসব অভিযাত্রী দলের খুব একটা তাড়া নেই, তাদের জন্য তো বটেই। পরের দিন ভোরে উঠে তাঁবু গুটিয়ে, মালপত্র বেঁধেছেদে, রান্না করে, কফি পান করে আবার উত্তর দিকে রওনা দিলাম।
হ্রদটা বেশ শান্ত; গাঢ়-সবুজ জল, উপরের নির্মল নীল আকাশের ছায়া পড়েছে জলে। জলহস্তীগুলো আমাদের নৌকার ভয়ানক কাছ ঘেঁষে এসে নিঃশ্বাস-ছাড়ছে, আর তারপরই আবার মাথা নিচু করে জলের তলায় ডুব দিচ্ছে, যেন আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। বেম্বার জঙ্গলে ঢাকা উঁচু উঁচু পাহাড়গুলো উল্টোদিকে চোখে পড়ছে। পারের থেকে প্রায় এক মাইল দূরে জায়গাটা। জলের রং দেখেও মনে হচ্ছে খুব গভীর। তাই ভাবলাম, জলের গভীরতা মাপার জন্য এটাই বেশ জায়গা। মেপে বেরোল, জল এখানে পঁয়ত্রিশ ফ্যাদম গভীর।
এই দিন আমাদের নৌকা তীর ঘেঁষে চলছিল। পার বরাবার একটা পাহাড়ের সারি, ঘন জঙ্গলে ভরা আর সবুজ ঘাসে ঢাকা, আচমকা ঢালু হয়ে, মিঠে জলের সাগরের অতলে নেমে গেছে। সেই পাহাড় আমাদের মাথার উপরে, বেশ কটা অন্তরীপ গোল করে কাটিয়ে আসতে আসতে, গভীর জলের মায়ায় জড়াতে জড়াতে খুব আশা জাগছিল যে হয়ত নতুন কোন আশ্চর্য বা কোন অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পাব! হতাশও হইনি অবশ্য। অজস্র অপরূপ উদ্ভিদ কুঞ্জে সাজানো জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়, গাছে গাছে ফুল ধরেছে, ফুলের মুকুট মাথায় পরে এদিক ওদিকে বিচিত্র গড়নের পাহাড়েরা মাথা তুলেছে - কেউ পিরামিডের মত দেখতে, কেউ বা কাটা শঙ্কুর মতন, কারোর মাথা টেবিলের মতন, কারোর বা শিরা বের করা, চার্চের খাড়া ছাদের মত, কারোর আবার মসৃণ উজ্জ্বল গা, কারোর এবড়োখেবড়ো জংলী চেহারা - খুবই আগ্রহভরে দেখছিলাম, তাঁদের গা থেকে অবর্ণনীয় মিষ্টি সুগন্ধ বেরোচ্ছে। খাঁড়ির প্রান্তের অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যগুলো খুবই প্রশংসা কুড়চ্ছিল। শান্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবিগুলো পরপর চোখের সামনে ফুটে উঠছে আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই মনে গভীরতম আনন্দ জাগাচ্ছে। এ জায়গা নিয়ে বলতে বসলে কথা ফুরবে না। অবশ্য এটা সহজেই বোঝা যায় যে ডাক্তার এখানকার চেয়েও আরও সুন্দর, আরও নয়ন ভুলানো দৃশ্য ঢের দেখেছেন, তাই এখানকার দৃশ্যাবলী দেখে আমার মতোই তাঁরও অনেক কিছু বলার থাকলেও , প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রশংসার সকল শক্তি তাঁর অনেক আগেই ফুরিয়ে গিয়েছিল।
বাগামায়ো থেকে উজিজি পর্যন্ত পথে আমি সেই দৃশ্যের সঙ্গে তুলনীয় আর কিছুই দেখিনি- পাম-কলা-বট-মিমোসার কুঞ্জছায়ায় ঘেরা এই জেলে বসতিগুলির চারিদিকে পামের বনের ডাইনে-বাঁয়ে সাবু গাছের সারি, শস্য-উপচানো চাষের ক্ষেত অনিমেখে চেয়ে আছে নিচের শান্ত জলের দিকে। সেই উপসাগরের জলে ঊষালগ্নে পাহাড়ের সৌন্দর্যের ছায়া পড়ে, ওই পাহাড়ই তাদের প্রায়শ ঝাঁপিয়ে পড়া প্রবল, দুরন্ত ঝড়ের ঝাপট থেকে বাঁচায়।
এখানকার জেলেরা স্পষ্টতই নিজেদের সুখী বলে ভাবে। হ্রদের জলে যত চাই মাছ মেলে, খেয়ে কুলায় না, একটু পরিশ্রম করলেই বিক্রির জন্যেও অঢেল। পাহাড়ের খাড়া ঢাল বরাবর মেয়েরা চাষ করে, সেখানে সাবু, চিনাবাদাম, মিষ্টি আলু ছাড়াও দৌরা ও ভারতীয় ভুট্টার মতো প্রচুর ফসল ফলে। পাম গাছের থেকে তেল পাওয়া যায় আর কলার ঝাড় থেকে মেলে প্রচুর সুস্বাদু ফল। লম্বা লম্বা দারুণ আকারের গাছ রয়েছে গিরিখাত জুড়ে, সেগুলো কেটে কেটে নৌকা বানানো হয়। একজন মানুষের মন যা চায়, আর পেটও যা চায় সবই সেখানে প্রকৃতি উদার হস্তে সরবরাহ করে। বাইরে থেকে, ভিতর থেকে সব দিক থেকেই যেন একেবারে সম্পূর্ণ আর নিখুঁত সুখের বলে মনে হয়। সেই ভরন্ত সুখের ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ে - জাঞ্জিবারে লবঙ্গ তোলার জন্য বা চাকরের কাজের জন্য মাত্র কয়েক ডটি দিয়ে এখান থেকে কত কত হতভাগ্যদের আরবরা কিনে নিয়ে যায়, হ্রদ আর সমুদ্র উপকূলের মধ্যের ভয়াল, বিজন প্রান্তরের উপর দিয়ে যখন সেই লোকগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন এই ঘরের কথা ভেবে তাদের কতই না দীর্ঘশ্বাস পরে।
যতই আমাদের দ্বিতীয় শিবির নিয়াসাঙ্গার কাছে আসছি, ততই মনোরম পাহাড়ের সারি আর সবুজ চারণ ভূমি ও ফসল ক্ষেত শোভিত ভিতরে ঢুকে যাওয়া খাঁড়ির সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রাচীন পন্টাস উপকূলের তুলনা মনে আসছে। আমাদের ডিঙ্গি পারে ভেড়ানোর কয়েক মুহূর্ত আগে, দুটো ছোট ঘটনা ঘটেছিল। একটি বিশাল কুকুর-মুখো বানরকে গুলি করেছিলাম। সেটা নাক থেকে লেজের শেষ অবধি ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি ; মুখটাই ছিল সাড়ে আট ইঞ্চি লম্বা, আর ওজন ছিল প্রায় ১০০ পাউন্ড। এর লেজের ডগায় কোনও লোমের গোছা ছিল না, তবে গোটা শরীরটা লম্বা কোঁকড়ানো লোমে ঢাকা। এরকম প্রাণী প্রচুর ছিল। সঙ্গে ছিল আরও মার্জার-মুখ লম্বা লেজের ছোট চেহারার বানরও। অন্য ঘটনাটা হল যে একটি বিশাল টিকটিকির দর্শন পাওয়া। প্রায় আড়াই ফুট লম্বা, আমরা ভালভাবে দেখে ওঠার আগেই সেটা আড়ালে চলে গেল। ডাক্তার অনুমান করেছিলেন যে এটা মনিটর টেরেস্ট্রিস।