ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে চলছে উজিজির পথে এগিয়ে চলার বর্ণনা। তরজমায় স্বাতী রায়
পয়লা অক্টোবর, দক্ষিণ-নৈর্ঋত কোণ বরাবর চার ঘণ্টা হাঁটার পর জিওয়ানি নামের একটা বড় জলাশয়ের কাছে পৌঁছলাম। একটা বিশালাকার ডুমুর গাছ (স্থানীয় ভাষায় এমকুয়ু), উন্যামওয়েজির বনের দৈত্যাকার গাছগুলোর মধ্যে একটা, তার ছায়ায় একটা পুরানো আধ-পোড়া বেড়া-ঘেরা থাকার জায়গা দেখলাম - এক ঘণ্টার মধ্যে সেটা একটা দুর্দান্ত শিবিরাবাসে রূপান্তরিত হল।
স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে গাছটার কান্ডের পরিধি আটত্রিশ ফুট। আফ্রিকায় আমি যত গাছ দেখেছি, এটা তাদের মধ্যে সুন্দরতম গাছগুলোর একটা। একটা সৈন্যদলও আরামসে পাতার এই বিশাল ছাতার নিচে তাদের দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রাম নিতে পারবে। মাটিতে এর ছায়ার ব্যাস ছিল একশ বিশ ফুট।
এই সময়টাতে আমি চাঙ্গা ছিলাম। তাই চারপাশটা ভালভাবে দেখতে পেরেছিলাম। দেখতে দেখতে মনটা বেশ প্রফুল্ল হয়ে উঠল। উন্যানয়েম্বেতে থাকার সময় এই আনন্দ কোথায় মুখ লুকিয়েছিল! তখন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছিল বলে সবসময় খুবই বিরক্ত লাগত। এখন দলের লোকজনের সঙ্গেও বন্ধুভাবে, নিজের সমতুল্য ভাবে মিশছিলাম। অভিযানের সফলতার সম্ভাবনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ তর্ক-বিতর্কও হচ্ছিল।
সেই সুবিস্তৃত জঙ্গলের গহনে চলতে চলতে দিনের আলো ফুরিয়ে এলো, আকাশের গায়ে সোনালি-রূপোলী-কমলা ও বিচিত্রবর্ণের রঙের পোঁছ লাগাতে লাগাতে সূর্য দ্রুত পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়ছিল, সুদূর-ছোঁয়া জঙ্গলের মাথায় সূর্যের রশ্মি ও টকটকে আভা প্রতিফলিত হচ্ছিল, চারিদিকে স্বর্গীয় শান্তি ও পবিত্র নীরবতা বিরাজমান, এমনকি আমার চারপাশের অশিক্ষিত মানুষগুলোর মনেও জীবনের এই অপূর্ব আনন্দের ছোঁয়া লাগল। সেই জঙ্গলে আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন মনিষ্যি নেই - দিনের কাজ শেষ হল, শিবিরের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও নিখুঁত, আমরা সবাই যে যার পাইপ বার করলাম, এতক্ষণ যত পরিশ্রম করেছি, এইবার তার ফল উপভোগ করব - মন ভরে আছে একটা কাজ ভালভাবে শেষ করার তৃপ্তিতে।
পথহারা ফ্লোরিকানের অথবা সাথীহারা গিনি-মোরগের কান্না, কাছের পুকুরের ব্যাঙেদের কর্কশ ঘ্যাঙরঘ্যাঙ, বা ঝিঁঝিঁপোকার ঘুমপাড়ানি গান ছাড়া বাইরে আর কিছু শোনা যাচ্ছে না; আমাদের শিবিরের ভিতরে শুধু হুঁকোর গুড়গুড় শব্দ শোনা যাচ্ছে, সবাই নীলচে ধোঁয়া টানতে ব্যস্ত, আমারও এই ধোঁয়া ভারি পছন্দের। ঘন পাতার গম্বুজের তলায় কার্পেটের উপর গা এলিয়ে দিয়েছি, মনটা ভারি প্রশান্ত, আমার ছোট মিরশুম পাইপের থেকে ধূমপান করছি, আকাশের ধুসর আলোর অপরূপ সৌন্দর্য বা চারপাশের বিরাজমান প্রশান্তি স্বত্বেও বাড়ির কথা, সুদূর আমেরিকার বন্ধুদের কথা ভাবছি- চিন্তা শীঘ্রই আমার এখনও-অসম্পূর্ণ কাজের দিকে ঘুরে যাবে- সেই লোকটির কথা ভাবতে বসব, যিনি আমার কাছে এখনও একটা ধোঁয়াশা, জানিনা তিনি মৃত নাকি আমার কাছে বা অনেক দূরে এমনই এক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এই মুহূর্তে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন, হয়ত আমার শিবিরের বাইরেই সে জঙ্গলের শীর্ষদেশ দৃশ্যমান। হয়ত আমরা দু’জনেই একই মাটিতে রয়েছি, হয়তো একই বনে ঘুরে বেড়াচ্ছি - কে জানে? হয়ত তিনি আমার থেকে এতটাই দূরে যে হয়তো উলভাতে তাঁর নিজের ছোট্ট কুটিরেই এখন রয়েছেন। যদিও আমি এখনও জানি না তিনি বেঁচে আছেন কিনা, তবুও একটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করছি, একটি বিশেষ রকম প্রসন্নতা যেটা বলে বোঝান কঠিন। মানুষ কেন এত দুর্বল তেজহীন যে, তাঁকে এখনও টো টো করে বেড়াতে হবে, নিজের অধৈর্য, অবাধ্য মনের কৌতূহল মেটানোর জন্য নিজেকেই শত শত মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে? 'তিনি কি বেঁচে আছেন?' এই জ্বালাতুনে প্রশ্নটার উত্তর জানার জন্য আমার মনে অদম্য কৌতূহল আর আমার মন প্রতিনিয়ত যে দুঃসাহসী কল্পনায় পাড়ি জমাচ্ছে, আমার দেহ যে কেন সেই মনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটতে পারে না! ধৈর্য ধর, আত্মাপুরুষ, অন্যের ঈর্ষনীয় আনন্দময় প্রশান্তিতে ডুবে থাকো! আপাতত এইটুকু জানাই যথেষ্ট যে তোমার যাত্রাটি অতি পবিত্র! এগিয়ে চলো, আর আশা রাখো!
সোমবার, দোসরা অক্টোবর, জঙ্গল ও সমতল পাড়ি দিয়ে আমাদের চলতে দেখা গেল। এই সমতল জিওয়ানি থেকে মান্যারা অবধি বিস্তৃত, পেরোতে সময় লাগল সাড়ে ছয় ঘণ্টা । মাথার উপর সূর্য দাউদাউ করে আগুন ঢালছে; তবে একটু দূরে দূরেই এমটুন্ডু আর মিওম্বো গাছ গজিয়েছে, ঠিক ততটুকুই দূরে যাতে প্রতিটা গাছ অবাধে বাড়তে পারে, তাদের পাতাগুলো মিলেমিশে ছায়া তৈরি করেছে - সেই ছায়ার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এখানে পথ সহজ, পরিষ্কার, শক্ত লাল মাটি কোন বাধার সৃষ্টি করে না। শুধু একটাই যা ঝামেলা সহ্য করতে হয়েছিল, তা হল সেৎসে, বা পাঙ্গা (তলোয়ার) মাছির আক্রমণ, সেগুলো এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘোরে। বুঝতে পারছিলাম যে আমরা শিকার যোগ্য প্রাণীর বিস্তৃত বাসস্থলের দিকে এগোচ্ছি, খুবই সতর্ক হয়ে চলছি যেন এই বনে বসবাসকারী কোন নমুনাই চোখ না এড়ায় ।
যখন আমরা এইরকম প্রায় ঘণ্টায় তিন মাইল বেগে এগোচ্ছি, যে কাফেলাটা আমি ভেবেছিলাম অন্য পথে গেছে সেটা আবার দেখা গেল, রাস্তায় কিছু একটা পড়ে আছে তার থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ সামনে, রাস্তার জিনিসটার দিকে সবাই তাকাচ্ছে। কাছে এসে দেখি যে জিনিসটা একটা মৃতদেহ, আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পীড়া, গুটিবসন্তের শিকার। লোকটা ওসেটোর লুঠেরা বা গেরিলা দলের একজন, উন্যানয়েম্বের এমকাসিওয়ার হয়ে কাজ করছিল, মিরাম্বোর গেরিলাদের এই বনে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এমবোগোর সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে উকোনোঙ্গো থেকে ফিরে আসছিল, নিজেদের সঙ্গীকে রাস্তায় ফেলে রেখে পালিয়েছে। মনে হল মাত্র একদিন আগেই মারা গেছে।
এই প্রসঙ্গে বলি যে, প্রায়শই রাস্তার ধারে একটা কঙ্কাল বা মাথার খুলি পাওয়া যেত। প্রায় প্রতিদিনই আমরা একটা, কখনও কখনও দুটোও, মরা ও ভুলে যাওয়া মানবতার শেষাবশেষ দেখতাম।
এর অল্প পরেই আমরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলাম আর একটা এমবুগা বা সমতল ভূমিতে পা রাখলাম, সেখানে কয়েকটা জিরাফকে দেখতে পেলাম, একটা ঝোপ চিবুচ্ছে, ঝোপের মাথা ছাড়িয়ে তাদের লম্বা গলা দেখা যাচ্ছে। দেখেই সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল; কারণ এইবার নিশ্চিত হলাম যে আমরা শিকারের দেশে ঢুকেছি, ও গোম্বে খাঁড়ি বা নদীর কাছে, যেখানে আমরা থামব বলে ঠিক করেছি, সেখানে এইসব প্রাণী অঢেল দেখা যাবে।
এই উত্তপ্ত সমভূমির উপর দিয়ে তিন ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা মান্যারার চাষের মাঠে এলাম। গ্রামের ফটকের সামনে এসে পৌঁছানর পর আমাদের প্রবেশ করতে নিষেধ করা হল, কারণ দেশ জুড়ে যুদ্ধ চলছে, পাছে গ্রামের লোক বিপদে পড়ে তাই কাউকেই ঢুকতে দেওয়ার ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকা উচিত। যাইহোক, আমাদের গ্রামের ডানদিকে একটা বেড়া-ঘেরা থাকার জায়গা দেখিয়ে দেওয়া হল, তার কাছেই কয়েকটা স্বচ্ছ জলের পুকুর, সেখানে আধ-ডজন ভাঙ্গাচোরা কুঁড়েঘর আবিষ্কার করা গেল, ক্লান্ত মানুষদের কাছে সেগুলো বড্ড বিরক্তির।
শিবির তৈরির পরে, আমাদের গাইডকে কিছু কাপড় দিয়ে গ্রামের থেকে কিছু খাবার কিনে আনার জন্য বলা হল। সামনে এক জনহীন এলাকার মধ্য দিয়ে টানা ন’দিন হাঁটা আছে, বা ১৩৫ মাইল পথ। তাকে জানানো হল যে সর্দার গ্রামের লোকদেরকে কোন খাদ্যশস্য বিক্রি করতে একদম কড়া নিষেধ করেছে।
স্পষ্টতই এটা এমন একটা ঘটনা যেখানে শুধু একটু কূটনীতিই কেবল কাজে লাগতে পারে; যদি ফের খাবার-দাবার জোগাড়ের জন্য কিকুরুতে লোক পাঠাতে বাধ্য হই, তাহলে এখানে বেশ কয়েক দিন আটকে পড়ব, যা মোটেই কাম্য নয়। তাই বাছাই করা জিনিসপত্রের একটা বস্তা খুলে, দুটো রাজকীয় কাপড় বেছে নিলাম এবং বোম্বেকে বললাম সেগুলো সুলতানের কাছে নিয়ে যেতে, সাহেবের সৌজন্য ও বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে। সুলতান গোমড়া মুখে সেগুলো ফেরত পাঠাল আর তাকে বিরক্ত না করে শ্বেতাঙ্গের কাছে ফিরে যেতে বলল।
কাকুতিমিনতি করে কোন লাভ হল না, ভবি ভুলবার নয়; ফলে দলের লোকরা, খালি পেটে, অত্যন্ত খারাপ মেজাজে, ঘুমোতে যেতে বাধ্য হল। এনজারা নামের দাস ব্যবসায়ী ও মহান শেখ বিন নাসিবের চেলার কথাগুলো মনে পড়ল। “আহ, কর্তা, কর্তা, ওখানকার লোকগুলোকে সামলানো বড্ড কঠিন, আপনাকে ফিরেই আসতে হবে। মান্যারার লোকেরা খারাপ, কোনোঙ্গোরাও খুব খারাপ, জাভিরারা সব থেকে খারাপ। খুবই খারাপ সময়ে এদেশে এসেছেন। সব জায়গাতেই যুদ্ধ।” আর সত্যিই, আমাদের ক্যাম্প-ফায়ারের চারপাশের কথোপকথনের সুর থেকেই সেটা খুব স্পষ্ট। সবাই যেন শিবির ছেড়ে চলে যেতে প্রস্তুত। যাইহোক, তাদের হতাশ না হতে বললাম; বললাম যে সকালে তাদের জন্য খাবার জোগাড় করব।
সেই বাছাই করা কাপড়ের গাঁটরিটা পরের দিন সকালে আবার খোলা হল, এবার চারটে রাজকীয় কাপড় বেছে নেওয়া হল, সেই সঙ্গে দুই ডটি মার্কিনী, অনেক ভাল ভাল কথা আর প্রশংসাবাক্য শিখিয়ে পড়িয়ে বোম্বেকে আবার পাঠানো হল। এই রকম একটা ক্ষমতাবান লোককে শত্রু বানানো যাবে না, আর এরকম একটা গোমড়া মুখো লোকের সঙ্গে সবিনয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা খুব জরুরি। সে যদি উয়োওয়ের দুর্ধর্ষ রাজা মিরাম্বোকে অনুকরণ করবে বলে মনস্থির করে, তাহলে কী হবে! আমার মুক্তহস্ত উদারতার ফল ফলল শীঘ্রই। রাশি রাশি খাবার এসে হাজির হল আমার শিবিরে। এক ঘণ্টাও কাটেনি, এক ডজন গ্রামবাসী মাথায় করে বাক্স বোঝাই চোরোকো, সিম, চাল, মাতামা বা দৌড়া ও ভারতীয় ভুট্টা নিয়ে এলো, আর কিছুক্ষণ পরেই এই পথে পা দেওয়া প্রথম সাদা মানুষের সঙ্গে দেখা করতে সুলতান নিজেই চলে এলো, পিছনে পিছনে প্রায় তিরিশ জন বন্দুকধারী ও কুড়ি জন বর্শাধারী। যোদ্ধাদের পিছনে পিছনে এলো সর্দারের উদার উপহার, তার কাছে পাঠানো উপহারের সম্পূর্ণ সমান মূল্যের, বেশ কয়েকটি বড় বড় খোল বোঝাই মধু, মোরগ, ছাগল আর আমার লোকদের দিন চারেকের খাবারের জন্য যথেষ্ট ছোলা-শিম-বরবটি।
শিবিরের দরজায় আমি সর্দারের সঙ্গে দেখা করলাম, এবং মাথা নিচু করে প্রচুর অভিবাদন জানিয়ে তাকে আমার তাঁবুতে আমন্ত্রণ জানালাম। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এই পরিস্থিতিতে যতটা সম্ভব তাঁবু সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিলাম। পারস্যদেশীয় কার্পেট, ভালুকের চামড়া মাটিতে বিছানো হয়েছিল, একটা টকটকে লাল নতুন কাপড়ের চওড়া টুকরো দিয়ে আমার খাটিয়া বা বিছানা ঢাকা হয়েছিল।
(ক্রমশ...)