আমরা যখন সুলতানের প্রাসাদের দরজার গজ-কুড়ির মধ্যে, দেখি সুলতান দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। আমাদের দেখা মাত্র ডান হাত প্রসারিত করে, হাসি মুখে সিঁড়ি দিয়ে, সৈন্যদলের মাঝখান দিয়ে, আমাদের স্বাগত জানাতে নীচে নেমে এলেন। আমরা টুপি তুলে অভিবাদন জানালাম ও তাঁর সঙ্গে হাত মেলালাম। তারপরে, তিনি আমাদের যেমন বললেন সেই মতো আমরা এগিয়ে গিয়ে দরজার সর্বোচ্চ ধাপে দাঁড়ালাম। তিনি আমাদের এগিয়ে যেতে ইশারা করলেন; আমরা মাথা নোয়ালাম, এগিয়ে গিয়ে একটি সরু, রংহীন সিঁড়ির সামনে পৌঁছালাম। আবার সুলতানের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, “এগিয়ে যান”, আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম, খানিকটা হতবাক হয়েই, কারণ আমার ঠিক পিছনেই সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন তিনি—একজন সার্বভৌম সুলতানের জন্য অবস্থানটি ভারী আপত্তিজনক। রাষ্ট্রদূত দেখলাম পাশ ফিরে উপরে উঠলেন, শালীনতা এবং মর্যাদা দুয়ের মধ্যে একটা সমঝোতা করে ওপরে ওঠার প্রচেষ্টা। সিঁড়ির ওপরে উঠে আমরা অপেক্ষা করছিলাম, প্রিন্স তখনও সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন, তাঁর দিকে মুখ করে। আবার তিনি উদারভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে বললেন কারণ সংবর্ধনা কক্ষ ও সিংহাসন কক্ষ সিঁড়ির ঠিক সামনেই। দূরতম প্রান্তের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম যে ঘরটা বিশাল উঁচু, আরবি কায়দায় সাজানো, পুরু পারস্যের গালিচা, আসবাবপত্রের মধ্যে ডজনখানেক সোনায় মোড়া চেয়ার ও একটি ঝাড়বাতিও চোখে পড়ল।
আমরা বসলাম; বৃদ্ধ, সম্ভ্রান্ত-দর্শন, শুল্ক-সংগ্রাহক বানিয়া, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান মুখশ্রীর লুধা দামজি সুলতানের ডানদিকে বসেছিলেন। তাঁর পাশে ছিলেন বিখ্যাত মহামেডান বণিক তারিয়া টোপন। তিনি যে কেবল মহিমান্বিত সুলতানের পরামর্শদাতা বলেই সেই সাক্ষাত্কারে উপস্থিত ছিলেন তা নয়, আমেরিকান অভিযানের প্রতিও তাঁর খুবই আগ্রহ ছিল। লুধার বিপরীতে বসেছিলেন ক্যাপটেন ওয়েব। এবং তাঁর পাশে আমি, তারিয়া টোপনের বিপরীতে। সুলতান আমেরিকানদের ও তাঁর পরামর্শদাতাদের মাঝে একটি স্বর্ণমণ্ডিত চেয়ারে বসেছিলেন। দোভাষী জোহরি সুলতানের সামনে বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সুলতানের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা শুরু হলেই তা ভাষান্তর করতে প্রস্তুত ও উদ্গ্রীব।
জাঞ্জিবারের সুলতান বরগশ বিন সয়ীদ অল-বুসয়ীদ, মাঝখানে বসে। ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে তারিয়া টোপন। সঙ্গে অন্যান্য সভাসদগণ।
পোশাক দেখলে সুলতানকে মিংগ্রেলিয়ান১ মনে হতেও পারে, তবে পাগড়িটি ব্যতিক্রম। লাল, হলুদ, বাদামি ও সাদা রঙের পর পর ভাঁজগুলি তাঁর মাথাটি ঘিরে ছিল। গাঢ় রঙের লম্বা পোশাক, কোমর ঘিরে মূল্যবান কোমরবন্ধ, তাতে সোনা-মোড়ানো খাপে ঝুলছে সোনার হাতলওলা তলোয়ার। তার পা খালি ও প্রকাণ্ড চেহারার। তিনি জাঞ্জিবারের অদ্ভুত অভিশাপে ভুগছিলেন—এলিফান্টিয়াসিস অর্থাৎ গোদ। তাঁর পায়ে পুরু তলাযুক্ত ওয়াটা (আরবি ভাষায় চপ্পল)—সেটির পাদপৃষ্ঠের উপর দিয়ে একটি শক্ত চামড়া দেওয়া। তাঁর উজ্জ্বল গায়ের রং এবং সঠিক, ধীমান, সুগঠিত আকৃতি আরব আভিজাত্যের সাক্ষ্য দেয়। অবশ্য তাঁর আভিজাত্য আর তাঁর যে উচ্চ বংশে জন্ম সে ছাড়া তাঁর চেহারা থেকে আর কোনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই বোঝা যায় না। কেবলমাত্র একটা অমায়িকতার ছাপ দেখা যায়, সেই সঙ্গে নিজের ও চারপাশের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ পরিতুষ্টি।
প্রিন্স বা সৈয়দ বরগশ, জাঞ্জিবার, পেম্বা ও আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের, সোমালিল্যান্ড থেকে মোজাম্বিক পর্যন্ত এলাকার সুলতান। আমার চোখে তিনি এমনভাবেই ধরা দিয়েছিলেন।
সোনার আবরণীর মধ্যে বসানো কাপে কফি এল, সঙ্গে নারকেলের দুধ আর কড়া মিষ্টি শররত। কথোপকথনের শুরু হল মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উদ্দেশে প্রশ্নে, “কেমন আছেন?”
—ভালো আছি। ধন্যবাদ। মহিমান্বিত সুলতান কেমন আছেন?
সুলতান, “বেশ ভালো!”
আমার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, “আপনি ভালো আছেন?”
উত্তর দিলাম, “বেশ ভালো আছি, ধন্যবাদ!”
দূতমহোদয় এবার কাজের কথা পাড়লেন, এবং মহামহিম সুলতান আমার ভ্রমণ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করলেন—“পারস্য কেমন লাগল?”, “কারবালা, বাগদাদ, মাসর, ইস্তাম্বুল দেখলেন?”, “তুর্কদেশে কি অনেক সৈন্য দেখলেন?”, “পারস্যে কত সৈন্য আছে?”, “পারস্যের জমি কি উর্বর?”, “জাঞ্জিবার কেমন লাগল?”
প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে আমি যা বললাম, তাতে মহামহিম সন্তুষ্ট হলেন, তারপর তিনি তাঁর বাগামোয়োর ও কাওলের কর্মচারীদের উদ্দেশে আমার পরিচয় দিয়ে লেখা চিঠি আমার হাতে তুলে দিলেন। আরও একটা সাধারণ পরিচয়পত্রও দিলেন সব আরব বণিকদের উদ্দেশে, যাদের সঙ্গে আমার রাস্তায় দেখা হতে পারে। আর শেষকালে বললেন যে আমার অভিযানের যাই উদ্দেশ্য হোক না কেন, সেই কাজে যেন আমি অবশ্যই পুরোপুরি সফল হই।
ঢোকার সময় যেভাবে মাথা নীচু করে অভিবাদন করেছিলাম, সেই একই ভাবে অভিবাদন করতে করতে আমরা সুলতানের থেকে বিদায় নিলাম। সুলতান নিজে ওই বিশাল প্রবেশ দ্বার অবধি আমাদের সঙ্গে এলেন।
সালামের মি. গুডহু একজন আমেরিকান বণিক, জাঞ্জিবারের বহু পুরোনো বাসিন্দা। তাঁকে বিদায় জানাতে গেলে, তিনি আমাকে একটি রক্ত-লাল ঘোড়া উপহার দিয়েছিলেন। ‘কেপ অফ গুড হোপ’ থেকে আনানো ঘোড়াটার দাম জঞ্জিবারে কমপক্ষে ৫০০ ডলার হবে।
ফেব্রুয়ারি মাসের চার তারিখে, আমার জাঞ্জিবারে পা রাখার আঠাশ দিন পরে, ‘নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড অভিযানের’ সকল জিনিসপত্র কেনা ও সব ব্যবস্থাপনা শেষ হল; তাঁবু, জিন সব বানানো সারা, নৌকাও পাল খাটিয়ে ভাসার জন্য প্রস্তুত, গাধা ডাকছে, ঘোড়ারাও চিঁহিহি করছে—সবাই যাত্রা শুরু করতে উদ্গ্রীব।
জাঞ্জিবার বন্দরে মাল ওঠা-নামার দৃশ্য। সৌজন্য মেরি ইভান্স পিকচার লাইব্রেরি
ভদ্রতার খাতিরে জাঞ্জিবারের সকল ইউরোপিয়ান আর আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আবার দেখা করলাম আর সবাইকে বিদায় জানালাম।
পাঁচ তারিখে, আমেরিকান কনসুলেটের সামনে চারটে ধাও নোঙর করা হল। একটি নৌকায় দুটি ঘোড়া তোলা হল, পরের দুটিতে সব গাধাদের, চার নম্বর নৌকা যেটা সবচাইতে বড়ো তাতে আমাদের কৃষ্ণাঙ্গ দেহরক্ষীদের আর অভিযানের পাহাড় প্রমাণ মালপত্র তোলা হল।
জাহাজ ছাড়ার ঠিক আগে দেখা গেল, শ্বেতাঙ্গ ফারকুহর ও শ বেপাত্তা। জোর তল্লাশি চালিয়ে এক শুঁড়িখানায় তাদের খোঁজ মিলল, জনা বারো চ্যালাচামুণ্ডার মাঝে বসে আফ্রিকা অভিযানের মাহাত্ম্য বর্ণনায় ব্যস্ত। যদিও নতুন দেশের দারুণ দারুণ দৃশ্য তাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠার অপেক্ষায়, তবু অজানা জায়গায় যদি এমন কিছু থাকে...? মনের মধ্যে মাঝেমধ্যেই বুড়বুড়িয়ে ওঠা এইসব সহজাত দুশ্চিন্তাকে হুইস্কির সাহায্যে ভুলে থাকার চেষ্টায় ব্যস্ত।
—এক্ষুনি নৌকায় ওঠো। চুক্তি সই-টই করার পরে এসব কী! আমি হুকুম দিলাম। বোম্বে ও চার-পাঁচজন সদ্য-নিযুক্ত দেহরক্ষীর সঙ্গে টলমল করতে করতে তারা নৌকার দিকে চলল।
—কিছু মনে করবেন না স্যার, ইয়ে মানে বলছিলাম কি যে আপনি কী মনে করেন যে আপনার সঙ্গে আফ্রিকা যাব বলে কথা দিয়ে আমি কি ঠিক কাজ করেছি? খুবই দুঃখিত আর বাধবাধ-ভাবে শ প্রশ্ন করল।
—আগাম নিয়েছ না? চুক্তি সই করেছ না? আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম; “এখন পালাতে চাইছ? যাও যাও নৌকায় ওঠো, এখুনি। আমাদের সবার এখন একটাই লক্ষ্য, ডুবি কি ভাসি, মরি কি বাঁচি—কেউই নিজের দায়িত্ব ছেড়ে পালাব না।”
দুপুরের একটু আগেই আমরা রওনা দিলাম। সহৃদয়া মিসেস ওয়েব আমাদের অভিযানকে একটি আমেরিকান পতাকা উপহার দিয়েছিলেন। জাহাজের মাস্তুলের ডগায় সেটি ওড়ানো হল। রাষ্ট্রদূত, তাঁর স্ত্রী, ও তাঁদের ছোট্ট সন্তানেরা, মেরি আর চার্লি খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে বাড়ির ছাদে উঠে তারাওয়ালা আমেরিকার পতাকা, টুপি ও রুমাল নাড়তে নাড়তে আমাকে আর আমাদের অভিযানকে বিদায় জানালেন। সুখী মানুষ, ভালো মানুষ! তাদের, আমাদের সবার ভালো হোক; ঈশ্বরের আশীর্বাদ আমাদের সকলের উপর ঝরে পড়ুক!
বই টা এলেই সংগ্ৰহ করব।
অপূর্ব অভিযাত্রা, ইতিহাসের পরিভ্রমণ