আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। বাগামোয়ো থেকে ‘উসেগুহহা’-র রাজধানী সিম্বামওয়েন্নিতে পৌঁছে এবারে উগোগো অঞ্চলের চুন্যু (চুন্যো) নামক জনপদের লক্ষ্যে চলেছে স্ট্যানলের কাফেলা। উসেগুহহা বলে কোনো স্থান বা প্রদেশ আজ আর নেই। এমনকি বোঝাও মুশকিল সেই অঞ্চলের বিস্তৃতি ঠিক কী ছিল। তবে সিম্বামওয়েন্নি নামে একটি ক্যাম্প-সাইট এখনও রয়েছে তানজানিয়ার মোরোগোরো শহরের কাছে। আন্দাজ করা যেতে পারে এই সিম্বামওয়েন্নি-র কথাই স্ট্যানলে বলছেন। কাজেই এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই মানচিত্রে নীল বুটি দেওয়া পথের আশেপাশেই।—সম্পাদক
দেখা গেল, মাকাটা নদী পেরোনর দিনে যে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল সেটাই আমাদের মাসিকা মরসুমের শেষ বর্ষা। ২৩ শে মার্চ আমরা প্রথম বৃষ্টি হতে দেখি আর শেষ হল ৩০ শে এপ্রিল। সময়কাল উনচল্লিশ দিন। এই মাসিকাকে নিয়ে বাগামোয়োর ভবিষ্যৎদ্রষ্ট্রারা গম্ভীর ভাবে বলেছিল “চল্লিশ দিন ধরে বৃষ্টি অবিরত ঝরে পড়ে”; যেখানে আমরা কিনা শুধু আঠারো দিনের বর্ষা পেয়েছি। তবে বর্ষা থামায় আমরা খুশীই হয়েছি, কারণ কাপড়ের গাঁঠরিগুলো বার বার শুকানো, যন্ত্রপাতি ও লোহার সরঞ্জামাদিতে তেল মাখানোর কাজ করতে করতে আর কাপড় ও চামড়ার সব জিনিস চোখের সামনে এভাবে নষ্ট হতে দেখে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
মে মাসের এক তারিখে আমরা কাদা আর মাকাটা নদীর জলের মধ্যে যুদ্ধ করছিলাম – এতগুলো নদী পেরোন আর জলা জায়গার উপর দিয়ে হেঁটে বেড়ানোর ধকলে দলের অনেকেই শারীরিকভাবে অসুস্থ। শ মুকুঙ্গুরুর প্রথম আক্রমণের থেকে তখনও ভুগছে, খুবই অপ্রীতিকর পর্ব, নিজের নতুন রূপ চেনাচ্ছিল। অদ্ভুত সব আবদার করছিল, যেগুলো মোটেই অভিযানের সঙ্গে মানায় না। তাছাড়াও তার মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী স্নায়বিক অসুখের অল্পবিস্তর লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছিল, সেটা এমনি সময়েই বিচ্ছিরি, আর অসুস্থ দলবল নিয়ে বৃষ্টি আর জলাজমির সঙ্গে যুঝতে থাকা একটা আফ্রিকান অভিযানের পক্ষে তো রীতিমতো ঘৃণা উদ্রেককারী। জায়েদি, আমাদের এক সৈন্য, বসন্ত রোগে গুরুতর অসুস্থ। কিচুমা-চুমা, লৌহের স্বল্পতাজনিত লিভারের অসুখ বোম্বেকে পেড়ে ফেলেছিল, সে সব রকম কাজের বাইরে চলে গেছে। বোম্বের দেখাদেখি মাবরুক সালিম নামের এক সুস্থসবল ছেলে জোলো-মাটিতে শুয়ে পড়ল, বমি করার নাটক করতে করতে ভান করল যে সে কিছুতেই মাকাটার জলা পেরোতে পারবে না, তবে তার খালি কাঁধের উপর সজোরে একটা পাকানো চাবুক আছড়ে পড়তেই তার পেট থেকে সব বমি-বমি ভাব পালাল। আবদুল কাদের, আমার ‘হিন্দি’ দর্জি ও দুঃসাহসী— পার্থিব দেহধারীদের মধ্যে দুর্বলতম ব্যক্তি— সেও সর্বদাই গায়ের জোরের অভাবে বিব্রত, অবশ্য ফরাসী ভাষায় যা বলত তাতে ‘strength’ টা ‘force’ হয়ে যেত, কখনই কাজ করতে পারত না, অকর্মার ধাড়ি , সব সময়ই অসুখ-অসুখ ভাব দেখাত, এদিকে সারাক্ষণই খাচ্ছে। ক্লান্ত আমি মনে মনে আর্তনাদ করতাম, 'হা ঈশ্বর! আমার অভিযানের সব লোকই যদি এমনটা হত, তাহলে আমি ফিরে যেতে বাধ্য হতাম, তবে তাদের সকলের উপর পুরোপুরি প্রতিশোধ না নিয়ে ফিরতাম না।' এই সব দিনকালে আমি ভাল করে পরীক্ষা করে দেখেছিলাম, একটা ভাল চাবুকের কত গুণ! মনে হয় আবদুল কাদের এই গল্পটা আত্মীয়-পরিজন বা তার জাতের সকলের মধ্যেই ছড়িয়ে দেবে। এটা নিশ্চিত যে সে আর কোনও সাদা লোকের সাথে কখনও আফ্রিকা যাবে না। সলোমন জ্ঞানী ছিলেন, সম্ভবত কিছুটা নিজের বোধে, কিছুটা দেখে শিখে। আমি জ্ঞানী হয়ে উঠলাম অভিজ্ঞতার মাধ্যমে— বাধ্য হয়ে দেখে শিখলাম যে কাদামাটি ও বৃষ্টি যখন আলসে মানুষগুলোর সব শারীরিক শক্তি নিংড়ে নেয়, পিঠে কুকুর-চাবুক পড়লেই আবার সব শক্তি ফিরে আসে, — কখনও কখনও অতিরিক্ত কাজের শক্তিও এনে দেয়।
স্ট্যানলে-র অভিযানের আরও কিছু পরে আঁকা এই মানচিত্র মোটামুটি আন্দাজ দেবে তাঁর বর্তমান পথরেখা। এখন তিনি ৪ নম্বর অঞ্চলে রয়েছেন। যদিও ওপরে ক্রমিক সংখ্যা চিহ্নিত রেখাটি পূর্ব-পশ্চিমের বদলে পশ্চিম-পূর্ব চিহ্নিত হয়েছে। নীচের ম্যাপে মোরোগোরো অঞ্চলটি তাঁর এই সময়ের অবস্থানের জায়গা।— সম্পাদক
আমাদের শিবিরের তিরিশ মাইল দূরে মাকাটার সমতল— সে এক বিশাল জলা জায়গা। জলের গভীরতা গড়ে এক ফুট; কিছু জায়গায় আমরা তিন, চার এমনকি পাঁচ ফুট গভীর গর্তও পেয়েছি। হাঁটা শুরু করার পর থেকেই শুধু ছপাত ছপাত শব্দ শুনতে পাচ্ছি, যতক্ষণ না পরের আস্তানা খুঁজে পেলাম ততক্ষণই সে শব্দ চলল, কুঁড়েগুলো চলার পথের উপরের একমাত্র শুকনো জায়গা দখল করে তৈরি।
স্ট্যানলে যে ভয়ঙ্কর জলার বর্ণনা করছেন তা মোরোগোরো অঞ্চলে। বর্তমানে তার অনেকটাই অন্তর্হিত — বর্তমানে এমকাটা প্রান্তরে (প্লেন্স) চাষজমি হয়ে গেছে। যা রয়ে গেছে ভাঙা ভাঙা জলাজমি হয়ে তার বর্তমান চেহারা ওপরের তিনটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে। — সম্পাদক
রুদেয়া নদীর কাছে পৌঁছানোর আগে অবধি টানা দু'দিন এরকম চলল। রুদেয়া খরস্রোতা নদী , ঝাঁপিয়ে পড়া বর্ষার জলে কানায় কানায় ভরা। রুদেয়ার একটি শাখা অতিক্রম করে এবং পশ্চিম তীরে জটলা করে থাকা স্যাঁতসেতে নলখাগড়া-বেতের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম সামনে বিশাল জলের চাদর বিছানো – জলের উপর দিয়ে গোছা গোছা ঘাসের ঝোপ আর দূরে দূরে ছড়ানো গাছের পাতা দেখা যাচ্ছে – জলের সীমানায় দশ কি বারো মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আছে উসাগাড়া পর্বতমালার পূর্ব ঢাল। রুদেয়া শাখানদীর থেকে পাঁচ মাইল হাঁটার সময় অসুবিধা ও হয়রানি একেবারে চরমে উঠল। মাল বোঝাই গাধা নিয়ে আমি আর আমার এক স্বাধীন সৈন্য যখন হাজির হলাম, তখন দেখি কুলিরা একটা ঢিপির উপর গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা আমাদের শিবির কিনা জানতে চাইলে উত্তর পেলাম, 'না'। 'তাহলে, এখানে থেমেছ কেন?' – ‘উঃ! কী গভীর জল!’ জলের গভীরতা বোঝাতে একজন তাঁর কোমরের কাছে দাগ টানে তো অন্যজন নিজের বুকের সামনে হাত ধরে তো আরেকজন গলা দেখায় আর অন্য একজন নিজের মাথার উপর হাত রাখে, মানে আমাদের সাঁতার কাটতে হবে। এই বেতবনের মধ্য দিয়ে পাঁচ মাইল সাঁতার কাটা! অসম্ভব! তবে এত বিবিধ বয়ানের সবকটাই সত্যি হওয়াও সমান অসম্ভব। তাই নির্দ্বিধায় আমি আমার সঙ্গীকে পশুদের নিয়ে এগিয়ে যেতে বললাম। তিন ঘন্টা ধরে চার ফুট জলের মধ্যে ছপর ছপর করার পরে শুকনো জমিতে পৌঁছালাম - মাকাটার জলাভূমি পেরোন হল। তবে এই জলাভূমির ভয়াবহতা মনে স্থায়ী ছাপ রেখে গেল; এই পথের ক্লান্তি ভুলে যেতে পারবে না কেউ, বা এই পথচলার অভিজ্ঞতা অভিযানের প্রতি যে বিবমিষা জাগিয়েছিল, সেটাও ভোলা কঠিন । এরপরেও, আমাদের স্পষ্টভাবে এই পর্বের স্মৃতিচারণ করতে হবে আর খুবই আফসোস হবে, কেন যে আমরা মাসিকা মরসুমে যাত্রা শুরু করেছিলাম – প্রায় প্রতিদিন দু-তিনটে করে প্রাণী মারা যেত, শেষ পর্যন্ত মাত্র পাঁচটা অসুস্থ, হা-ক্লান্ত প্রাণী বেঁচে ছিল; স্বাধীন কর্মীরা, সৈন্যরা ও কুলিরা বিভিন্ন রোগে কাতর; আর শেষকালে আমি নিজেই তীব্র আমাশয়ের আক্রমণে বিছানা নিলাম, প্রায় মৃত্যুর মুখের থেকে ফিরে এলাম। ঠিকমত ওষুধ খেলে যতটা ভোগা উচিত ছিল তার থেকে বেশিই কষ্ট পেলাম, 'কোলিস ব্রাউনের ক্লোরোডিন' নামের ওষুধের উপর আমার গভীর বিশ্বাসই চিকিত্সা বিলম্বিত করেছিল, শেষ পর্যন্ত বিবেচক মাত্রায় ডোভারের পাউডার ব্যবহার করে সুস্থ হলাম। ডায়রিয়া বা তীব্র আমাশয়ের কোনও ক্ষেত্রেই এই 'ক্লোরোডিন' কোন কাজে আসে নি, - অথচ এই সম্পর্কে এত কিছু বলা ও লেখা হয়েছে, তাও আমি তিন বোতল ওষুধ খেয়ে নেওয়া সত্ত্বেও অসুখের প্রকোপ কিছুমাত্র কমেনি। মাকাটার জলাভূমি পেরোনর সময় যে আমাশার সংক্রমণ হয়েছিল, তাতে কেবল দু'জনই মারা গেল - একজন কুলি আর আমার বেচারা ছোট্ট কুকুর 'ওমর' – ভারতবর্ষ থেকে সে আমার সঙ্গী ছিল।
(ক্রমশ...)