বিশ জনকে বইতে পারে আর সেইসঙ্গে নৌকাযাত্রার প্রয়োজনীয় মালপত্রও ধরে এমন একটা বড়ো নৌকা আশি ডলার দিয়ে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের থেকে কেনা হয়েছিল। আর-একটা ছোটো নৌকা কেনা হল আর-একজন আমেরিকান ভদ্রলোকের কাছ থেকে, চল্লিশ ডলারে। পরেরটাতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখার জায়গা ছাড়াও আরামসে ছয় জন ধরবে।
নৌকাগুলোকে আস্ত নিয়ে যাব বলে ভাবিনি, তাদের একদম নীচের পাটাগুলো খুলে ফেলে, কেবল কাঠের টুকরো আর বসার তক্তাগুলো সঙ্গে নেব বলে ঠিক করলাম। পায়ের তলার পাটার বিকল্প হিসেবে, আমি প্রতিটি নৌকোকে দু-পোঁচ আলকাতরা মাখানো ক্যানভাস দিয়ে ঢেকে দেবার প্রস্তাব দিলাম। এই নৌকা খুলে ফেলার আর তাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার কাজটা আমার উপর বর্তালো। পাঁচদিন লাগল এইটুকু কাজ সারতে। বাঁধাছাদাও করে দিলাম, কুলিদের জন্য। প্রত্যেকটি বোঝা সযত্নে ওজন করেও দেখা হল, কোনোটাই ওজনে ৬৮ পাউন্ডের বেশি নয়।
ঊনবিংশ শতকের সাতের দশকে জাঞ্জিবারে ব্যবহৃত নানা মাপের নৌকা। ১৮৭৩ সালের প্রিন্ট। (সূত্র https://africageographic.com)
জন শ ক্যানভাসের নৌকার বাবদে দারুণ কারিগরি দক্ষতা দেখাল; কাজটা শেষ হলে দেখা গেল যে, ফ্রেমগুলিতে সেগুলো একদম খাপে খাপে বসে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ শন-দড়ির তৈরি তিন নং ক্যানভাসের ছটা গোটা থান লুধা দামজির থেকে আনা হয়েছিল, তিনি এগুলো সুলতানের গুদাম থেকে সরবরাহ করেছিলেন।
আফ্রিকায় দ্রুত ভ্রমণের ক্ষেত্রে একটি অনতিক্রম্য বাধা হল কুলির অভাব; যেহেতু আমার অভিযানের জন্য গতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আমি যথাসম্ভব এই অসুবিধা কমানোর চেষ্টা করেছিলাম। আমার কুলিদের কেবলমাত্র মূল ভূখণ্ডের বাগামোয়ো পৌঁছানোর পরেই কাজে লাগানো যাবে। আমার কাছে কুড়িটারও বেশি ভালো গাধা তৈরি ছিল আর আমার মনে হয়েছিল আফ্রিকার পায়ে চলার পথগুলির জন্য বিশেষভাবে গাড়ি তৈরি করাতে পারলে সেটাও বেশ কাজে লাগতে পারে। সেইমতো একটি গাড়ি তৈরি করিয়েছিলাম, আঠারো ইঞ্চি চওড়া আর পাঁচ ফুট লম্বা, একটি হালকা আমেরিকান ওয়াগনের সামনের দুটি চাকা তাতে লাগান হল, মূলত সরু গোলাবারুদের বাক্সগুলো বহন করার জন্য। ধরে নিয়েছিলাম যে একটা গাধা যদি উন্যানয়েম্বে অবধি চার ফ্রাসিলা বা ১৪০ পাউন্ডের মাল বহন করতে পারে, সে এইরকম গাড়িতে আট ফ্রাসিলার জিনিসও বহন করতে পারবে, যেটা কিনা চার জন গাঁট্টাগোট্টা মুটের বহন ক্ষমতার সমান। পরবর্তীকালের ঘটনা প্রমাণ করবে আমার হিসাব বাস্তবে কতটা কাজে লেগেছিল।
কেনাকাটা শেষ হলে দেখলাম, ধাপে ধাপে সারি সারি জিনিস পাহাড়ের মতো জড়ো হয়েছে; এখানে এক বোঝা রান্নার বাসন, ওখানে দড়ির বান্ডিল, তাঁবু, জিন, এক গাদা চামড়ার দু-ভাগওলা ব্যাগ ও বাক্স যার মধ্যে মানুষ যা কিছু কল্পনা করতে পারে তার সবকিছুই রয়েছে। নিজেই নিজের দুঃসাহসে কেমন বিহ্বল হয়ে পড়লাম। এখানে অন্ততপক্ষে ছয় টন মালপত্র রয়েছে! খুবই চিন্তায় পড়লাম, “সমুদ্র এবং আফ্রিকার বিশাল হ্রদ-অঞ্চলের মাঝের জায়গাটা তো বিশাল বড়ো, কীভাবে এই ওজনকে ওই বিস্তৃত প্রান্তরের উপর দিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়া হবে? ধুস, এত ভেবে কী করব—কাজে লাগা যাক বরং। আজকের ভাবনাটুকু আজ ভাবি—কালকের কথা কাল ভাবা যাবে।”
অন্যান্য দেশে পর্যটকরা যেভাবে চলাফেরা করতে অভ্যস্ত হন, এই বিস্তৃত আফ্রিকান ভূখণ্ডে, যার আবার মাঝখানে একটি হ্রদ রয়েছে, সেখানে চলাফেরার নিয়মকানুন সম্পূর্ণ আলাদা। একটা জাহাজ লম্বা সফরে যাওয়ার সময় যা কিছু আবশ্যিক জিনিসপত্র সঙ্গে নেয়, সেই সবই নিতে হবে। স্লপ চেস্ট১, কৌটো-ভরা সুখাদ্যের সম্ভার, ওষুধ-পত্তর তো লাগবেই, এ ছাড়াও পর্যাপ্ত বন্দুক, বারুদ আর গুলি সঙ্গে নিতে হবে যাতে দরকার পড়লেই একের পর এক ভালো মতো যুদ্ধ করা যায়। এই সব হরেক রকম জিনিসপত্র বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় কুলি চাই। আর যেহেতু একজন মানুষ ৭০ পাউন্ডের বেশি মাল বহন করে না, ১১000 পাউন্ড বহন করতে প্রায় ১৬০ জন কুলির প্রয়োজন।
আফ্রিকা অভিযানে ব্যবহৃত সোয়াহিলি ও শেনজি কুলির দল। প্রত্যেকের মাথায় মেপে ৬০ পাউন্ড ওজনের মাল। ১৯১৮-র ছবি। (সূত্র https://dockraydiary.wordpress.com/2015/01/20/addendum-new-things-seen-in-africa-part-2/)
আফ্রিকার তুলনায় ইউরোপ ও প্রাচ্যদেশ, এমনকি আরব এবং তুর্কিস্থানেও ভ্রমণের ব্যবস্থাদি রাজকীয়। সে সব দেশে ধাতব মুদ্রা গ্রহণ করা হয়, ফলে পর্যটকরা টাকাপয়সা নিজের কাছেই রাখতে পারেন। পূর্ব এবং মধ্য আফ্রিকায়, এক সেন্টের বদলে চায় একটা হার; আধ ডলার বা এক ফ্লোরিনের বদলে চায় দু-গজ আমেরিকান কাপড় আর স্বর্ণমুদ্রার বদলে চায় এক কিটিন্ডি২ মোটা পিতলের তার।
পর্যটকরা আফ্রিকার অন্দরে প্রবেশের জন্য ওয়াগন, উট, ঘোড়া বা খচ্চর কিছুই ভাড়া করতে পারেন না। তাঁর একমাত্র ভরসা কেবল কালো, উলঙ্গ মানুষ, উন্যানয়েম্বে অবধি যেতে তারা প্রতি সত্তর পাউন্ড মালের জন্য কমপক্ষে মাথাপিছু ১৫ ডলার চায়।
আমার পূর্বসূরিরা পরের পর্যটকদের জন্য একটা গুরুত্বপুর্ণ তথ্য বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। সেটা হল, কেউ যেন সোনার মুদ্রা ছাড়া অন্য কোনো ভাবে অর্থ নিয়ে জাঞ্জিবারে আসার কথা না ভাবেন। লেটার অফ ক্রেডিট, সার্কুলার নোট বা এই জাতীয় সভ্য জগতের জিনিস জাঞ্জিবারে এসে পৌঁছাতে এখনও একশো বছর বাকি!
১৮৭০ সালে মুদ্রিত সোনার মুদ্রা—১০ মার্কিন ডলার
আমি কাগজপত্রের ভিত্তিতে যত ডলার তুলেছিলাম, প্রতি ডলারে কুড়ি থেকে পঁচিশ সেন্ট কেটে নেওয়া হয়েছে—একে আমার সবচেয়ে বাজে স্মৃতি যদি নাও বলি, এই অভিজ্ঞতা আমার বাজে স্মৃতিগুলোর অন্যতম, মাথায় একেবারে গেঁথে আছে। জাঞ্জিবার ইউরোপীয় বাণিজ্যের সকল সুযোগসুবিধার থেকে অনেকটা দূরে— ধাতব মুদ্রার এখানে ভয়ানক দাম। যতই কথা বলুন, সনির্বন্ধ অনুনয় করুন, যতই ড্রাফট, চেক, লেটার অফ ক্রেডিট, সার্কুলার নোট সঙ্গে থাকুক, দরকার মতো যে-কোনো জিনিস পাওয়ার অনুমতিপত্র থাকুক সঙ্গে, প্রতি ডলারে বিশ, পঁচিশ এমনকি ত্রিশ সেন্ট অবধি কেটে নেওয়াই দস্তুর। এটাই শুনলাম আর দেখলামও। খুবই দুঃখের ব্যাপার যে এখানে কোনো ব্যাংকের শাখা নেই!
একটু চুপিচুপিই আফ্রিকার ভিতরে চলে যেতে চেয়েছিলাম। তবু একজন শ্বেতাঙ্গ, এমনকি একজন আমেরিকানও যে আফ্রিকাতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে সে খবরটা খুব শীঘ্রই গোটা জাঞ্জিবারে ছড়িয়ে গিয়েছিল। রাস্তাঘাটে, দোকানপাটে, শুল্কবিভাগে সব জায়গায় এই নিয়ে কথা হত। জাঞ্জিবার ছেড়ে না বেরোনো পর্যন্ত স্থানীয় বাজারে এ নিয়ে দিনরাত আলোচনা চলত। সব বিদেশিরা এমনকি ইউরোপীয়রাও আমার অভিযানের সুবিধা-অসুবিধা জানতে চাইত।
সব রকমের প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তরে আমার একটাই জবাব ছিল। আমি আফ্রিকার অন্দরে যাচ্ছি। যদিও আমার কার্ডে পরিষ্কার লেখা ছিল—হেনরি এম স্ট্যানলে, নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড।
আমার ধারণা খুব কম লোকই ‘ডক্টর লিভিংস্টোন’-কে খোঁজার সঙ্গে ‘নিউইয়র্ক হেরাল্ড’ নামটাকে একসঙ্গে ভাবতে পারতেন। সেটা নিশ্চয়ই আমার দোষ না!
উফ! একা একা একটা অভিযান শুরু করা যে কী কঠিন পরিশ্রমের কাজ! প্রচণ্ড কড়া রোদে পুড়ে পুড়ে এক দোকান থেকে আর-এক দোকানে ঘুরে বেড়ানো। রেগে-লাল হয়ে যাওয়া হিন্দুস্তানিদের সঙ্গে অসীম, অটল ধৈর্যের সঙ্গে দর কষাকষির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। ধূর্ত বানিয়াদের কাছে না ঠকার জন্য, দুর্বৃত্ত গোয়ানদের উপর চোখরাঙানোর জন্য সাহস ও বুদ্ধি সঞ্চয় করা। সারা দিন ধরে জিনিসপত্র মাপা। এস্টিমেট সংশোধন করা, হিসাব রাখা, কেনা জিনিসপত্র ঠিকমতো এসে পৌঁছাল কি না তার তদারকি করা, সেসব জিনিসের মাপজোখ-ওজনাদি করা যাতে সব কিছু জিনিস ঠিকমতো মাপে, ওজনে এল কিনা তা বোঝা যায়। শ্বেতাঙ্গ ফারকুহর ও শ গাধার জিন, পাল, তাঁবু, নৌকার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত—তাদের উপর নজরদারি করা। দিনের শেষে মনে হত, হাত-পা-মাথাগুলোর এবার একটু বিশ্রাম নেহাতই প্রাপ্য! এক মাস ধরে সারাক্ষণ আমার এই রকম পরিশ্রম গিয়েছিল।
কাপড়, পুঁতি, তার, গাধা ও আরও হাজারটা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দরুণ কয়েক হাজার ডলারের জন্য মি. জেমস গর্ডন বেনেটের নামের ড্রাফট জমা করলাম। অভিযানের শ্বেতাঙ্গদের আর কৃষ্ণকায় দেহরক্ষীদের বেতনের আগাম দিলাম। ক্যাপটেন ওয়েবকে ও তার পরিবারকে প্রস্তুতিপর্বের হাজারটা ঝামেলায় কি বিরক্তই না করেছি! তাদের ঘরদোর অভিযানের মালপত্রে বোঝাই করে রাখা। এবার বাগামোয়ো রওনা হওয়ার আগে সব ইউরোপিয়ানদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানানো ছাড়া আর কিছু বাকি নেই। সেই সঙ্গে বাকি আর একটা কাজ—যারা আমাকে এই প্রস্তুতি পর্বে অনেক সাহায্য করেছেন তাদের ও সুলতানকে ধন্যবাদ জানানো।
জাঞ্জিবার থেকে বিদায় নেওয়ার আগের দিন, আমেরিকান রাষ্ট্রদূত, একটা কালো রঙের কোট গায়ে চাপিয়ে সেজেগুজে, তার সাথে একটা কালো টুপিও মাথায় চাপিয়ে, যাতে পোশাকটা বেশ জমকালো আনুষ্ঠানিক গোছের বলে মনে হয়, আমাকে সঙ্গে নিয়ে সুলতানের প্রাসাদে চললেন। প্রিন্স আমার প্রতি সদয় ছিলেন; তিনি আমাকে একটি আরবি ঘোড়া উপহার দিয়েছিলেন। তা ছাড়াও আমার হাতে তাঁর এজেন্ট, সামন্ত ও দেশের ভিতরের প্রতিনিধিদের নামে লেখা পরিচয়পত্র দিয়েছিলেন, আরও অনেক উপায়ে বুঝেছিলাম যে তিনি আমার প্রতি প্রসন্ন।
স্ট্যানলে জাঞ্জিবারের সুলতানের এই প্রাসাদটিতেই গিয়েছিলেন। ১৮৯৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে ধ্বংস হওয়ার পরের ছবি।
প্রাসাদটি বিশাল, প্রশস্ত, উঁচু, বর্গাকার—দুর্গের কাছেই অবস্থিত, প্রবাল দিয়ে তৈরি, চুনসুরকি দিয়ে মোটা প্লাস্টার করা। আধা-আরবি আধা-ইতালীয় চেহারার। উজ্জ্বল সবুজ রঙের পাল্লাগুলি খড়খড়ি-ওলা—সাদা চুনকাম করা দেয়ালের পাশে এক চোখ ধাঁধানো বৈপরীত্য। বিশাল, মস্ত উঁচু, চওড়া দরজার সামনের খিলান দুটি অর্ধচন্দ্রাকারে দাঁড়িয়ে আছে, বাঁকা তরোয়াল এবং গন্ডারের চামড়ার ঢাল হাতে, সার সার বালুচ ও পারসিক মাইনে-করা সৈন্যের দল। গোড়ালি ছোঁয়া সাদা সুতির জামা, কোমরে জড়ানো চামড়ার উপর রুপোর বোতাম বসানো কটিবন্ধ।
আমরা কাছে আসতেই, প্রবেশদ্বারের ভিতরের কারোর কাছে সংকেত চলে গেল।
রুদ্ধশ্বাসে ধারাবাহিকটি পড়ছি, যদিও সব সময় মন্তব্য করা হয় না। অনুবাদ বেশ ঝরঝরে।
পুরো লেখা বই আকারে প্রকাশ হলে কেনার বাসনা রাখি। আগাম বুকিং দিলাম
আগ্রহ সহকারে পড়ছি .
অনবদ্য।