ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালা। তরজমা স্বাতী রায়
কুলাবি ছেড়ে, আমরা একটা ন্যাড়া, লাল, দোআঁশ মাটির সমতল পেরোলাম। উসাগারার পর্বতশ্রেণী এখন সামনে নীলচে-কাল জমাট বাঁধা রূপে ঠেলে উঠছে। সেখানে থেকে বাতাস এসে এই সমতলের উপর দিয়ে ভয়ানক আর্তনাদ করতে করতে বয়ে যায়। বাতাসের ঝাপটা যেন স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ, সূক্ষ্মভাবে শরীর ভেদ করে প্রবেশ করে। নিজেদের ফিনফিনে গজের টুকরো বলে বোধ হয়। এই পরাক্রমশালী 'পেপ্পো'-ঝড়ের বিরুদ্ধে সাচ্চা মরদের মতন লড়াই করে আমরা মুকামওয়ার মধ্যে দিয়ে পাড়ি দিলাম। একটা জলধারার বিস্তীর্ণ বালুকাময় খাত পেরিয়ে আমরা এমভুমিতে ঢুকলাম। উগোগোর শেষ নজরানা আদায়কারী সর্দারের মুলুক এটা।
৪ এপ্রিল, আট ডোটি বা বত্রিশ গজ কাপড় দিয়ে বোম্বে ও আমার দোস্ত মগোগোকে পাঠালাম সুলতানকে বিদায়কালীন শ্রদ্ধা জানাতে। তারপর আমরা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ছুটলাম। পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে আমরা "মারেঙ্গা মকালি", সেই "কষটে," তেতো বা হালকা লোনা, জলের বিজন প্রান্তরের সীমান্তে পৌঁছে গেলাম।
আমাদের শিবির থেকে, আমেরিকান কনসালের কাছে চিঠি দিয়ে তিনজনকে জাঞ্জিবারে পাঠিয়েছিলাম, সেই সঙ্গে 'হেরাল্ড'-এর কাছে টেলিগ্রাফ পাঠানোর জন্যও। রাজদূতকে অনুরোধ করেছিলাম যে তিনি যেন একটা-দুটো ছোট বাক্স ভরে কিছুমিছু বিলাসদ্রব্য দিয়ে লোকদের ফেরত পাঠান যা ক্ষুধার্ত, জীর্ণ, ছ্যাতলাধরা মানুষজন তারিফ কুড়াবে। বার্তাবাহকদের বৃষ্টি- অনাবৃষ্টি, নদী- বন্যা কোনো কিছুর জন্যই থামতে বারণ করা হয়েছিল - যাতে তারা তাড়াহুড়ো করল না আর তারা উপকূলে পৌঁছানোর আগেই আমরা তাদের ধরে ফেললাম এমন ঘটনা না ঘটে। প্রবল উৎসাহে "ইনশাআল্লাহ, বানা" বলে তারা রওনা দিল।
৫ তারিখে, সকলে জোরে, প্রাণোচ্ছ্বল ভাবে, উল্লসিতভাবে "হুররেহ!" বলে উঠলাম। এবার এক চিরন্তন নীরব ও নির্জন প্রান্তরে ঢুকে পড়েছি, গোগো গ্রামের শ্রুতিকটু, অসংলগ্ন ঝুটঝামেলার চেয়ে এই জনহীনতা অনেক বেশি পছন্দের। এই নোনা জলাভূমিতেতে হিংস্র গণ্ডার , ভীতু কোয়াগগা ও হরিণের পাল ভিড় করে আছে। সেখানে ঘোর শোরগোলের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু করে, নয় ঘণ্টা ধরে আমরা হাঁটলাম। ৭ তারিখে, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির মধ্যে, আমরা এমপওয়াপওয়াতে ঢুকলাম, যেখানে আমার স্কচ সহকারী, ফারকুহার মারা যায়।
১৪ মার্চ থেকে ৭ই এপ্রিলের মধ্যে, চব্বিশ দিনে আমরা প্রতিদিন চোদ্দ মাইলের কিছু বেশি হিসেবে মোট ইংরেজি হিসেবে ৩৩৮ মাইলের এক অসামান্য পদযাত্রা করেছি।
এমপওয়াপওয়াদের সর্দার লিউকোলের কাছে আমি ফারকুহারকে ছেড়ে এসেছিলাম, সে ফারকুহারের মৃত্যুর নিম্নলিখিত বিবরণ দিয়েছে—
"আপনি তাঁকে রেখে চলে যাওয়ার পরে সাদা লোকটির শারীরিক উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয়েছিল, তবে পঞ্চম দিনে তিনি উঠে তাঁবুর বাইরে আসার চেষ্টা করছিলেন, তখন পড়ে যান; আর তারপর থেকেই তাঁর অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। বিকেলে তিনি মারা গেলেন, ঠিক যেন ঘুমাচ্ছেন। তাঁর পা ও পেট অনেকটা ফুলে গিয়েছিল, আর আমার মনে হয়, যখন তিনি পড়ে গিয়েছিলেন তখন তাঁর কিছু একটা ভেঙেও গিয়েছিল, কারণ তিনি খুব লেগেছে এমন ভাবে চিৎকার করছিলেন, ও তার চাকর বলেছিল, 'প্রভু বলছেন যে তিনি মারা যাচ্ছেন।'
আমরা তাঁকে একটা বড় গাছের নীচে নিয়ে গিয়েছিলাম, আর তাঁকে পাতা দিয়ে ঢাকা দিয়ে রেখে আমরা চলে এসেছিলাম। তাঁর ভৃত্য তাঁর সকল জিনিসপত্র, রাইফেল, জামাকাপড় ও কম্বল নিজের হেফাজতে নিয়েছিল এবং কিসোকওয়ের কাছে এক ন্যামওয়েজি টেম্বেতে চলে গিয়েছিল, যেখানে সে তিন মাস বেঁচে ছিল, তারপর সেও মরে যায়। মরার আগে সে তার প্রভুর রাইফেলটা দশ ডটির (চল্লিশ গজ কাপড়ের) বিনিময়ে এক উন্যানয়েম্বেগামী আরবের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল । আমি শুধু এটুকুই জানি।"
পরে যেখানে ফারকুহারের মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয়েছিল, আমাকে সেই গর্তটা সে দেখাল। তাঁর অস্থি কখানাকে ভালমতন কবর দেওয়ার জন্য আমরা বেশ তন্নতন্ন করে খুঁজলামও। কিন্তু তাঁর হাড়ের কোন চিহ্নও দেখতে পেলাম না। আমরা উন্যানয়েম্বে ছেড়ে যাবার আগে পঞ্চাশ জন লোককে পাথর বওয়ার জন্য দু'দিন কাজে লাগিয়েছিলাম। তাদের সাহায্যে শ'র কবরের চারপাশে একটা বেশ শক্তপোক্ত স্থায়ী স্তূপ তৈরি করেছিলাম, সেটা আট ফুট লম্বা আর পাঁচ ফুট চওড়া, উন্যামওয়েজিতে মারা যাওয়া প্রথম শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির কবর সেটি। ডাঃ লিভিংস্টোন বলেছিলেন, সেটা শত শত বছর টিকে থাকবে। তবে যদিও আমরা বেচারা ফারকুহারের কোন দেহাবশেষ আবিষ্কার করতে পারিনি, তবু আমরা প্রচুর পরিমাণে পাথর সংগ্রহ করেছিলাম আর তার মৃতদেহের শেষশয্যার জায়গাটা মনে রাখতে জলস্রোতের তীরে একটা ঢিবি গড়ে তুলতে পেরেছিলাম।
মুকন্ডোকোওয়া নদীর উপত্যকায় প্রবেশ না করা অবধি মাসিকার কারণে তেমন একটা দুঃখ বা কষ্ট বুঝিনি। এখানে জলধারা বজ্রধ্বনি করছে, সগর্জনে বয়ে যাচ্ছে। একটা প্রবল ঘোলা বন্যারাশি বল্গাছেঁড়া হয়ে মোহনার দিকে ছুটে যাচ্ছে। নদী কানায় কানায় ভরা, চওড়া নালাগুলো জলে পরিপূর্ণ আর ক্ষেতগুলো প্লাবিত। তারপরও ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। সমুদ্র-উপকূল অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় কীরকম আশা করতে পারি সে সম্পর্কে যেন আমাদের সতর্ক করেছিল। তবুও, প্রতিটি মুহূর্ত দামী ভাবা মানুষের মতন পদক্ষেপে আমরা এগিয়ে চলছিলাম - যেন একটা প্রলয় আমাদের ধাওয়া করেছে। তিনবার আমরা এ পাড় থেকে ও পাড় অবধি গাছে বাঁধা দড়ির সাহায্যে এই ভয়ঙ্কর বন্যার মাঝের ঘুর্ণি পার হয়েছি।
১১ এপ্রিল আমরা, একদল কাতর, দুর্দশাগ্রস্ত লোক কাদেতামারেতে পৌঁছালাম, মাউন্ট কিবওয়ের উল্টোদিকে, নদীর ডানদিকে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা একটা পাহাড়ে তাঁবু খাটানো হল। এই পাহাড়টা এই পাহাড়শ্রেণির সবচেয়ে উঁচু চূড়াগুলির মধ্যে একটি।
১২ এপ্রিল ছয় ঘণ্টা ধরে হাঁটার পরে আমরা মুকন্ডোকওয়া গিরিপথের মুখে পৌঁছলাম। এখানে নদীটি মাকাতার সমভূমিতে মিশেছে। এই পদযাত্রাটি এযাবৎ আমার অভিজ্ঞতার সবচেয়ে ক্লান্তিকর হাঁটা। জানতাম যে এবছর এই সময়টা একটু অস্বাভাবিক। এই দেশের অবস্থা আগের বছরই যথেষ্ট খারাপ হলেও, এই বছরের তুলনায় সে কিছুই ছিল না। ফেনিল, ক্রুদ্ধ উচ্ছ্বসিত জলরাশির পাশ দিয়ে দিয়ে আমাদের পথ চলেছে, মাঝে মাঝেই সেই জলধারা গভীর খাদের মধ্য দিয়ে বইছে, সেখানে কখনও কোমর-জলে, কখনও কখনও গলা-অবধি-ডোবা জলে আমরা নিজেদের খুঁজে পাচ্ছি। পাছে বর্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই গ্রামের একটিতে ক্যাম্প করে থাকতে হয় সেই ভয় ছিল। অতএব জরুরী তাগিদ আমাদের আমরা সামনের দিকে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা চলতেই থাকলাম, জলাভূমির ওপর দিয়ে, হাঁটু অবধি কাদা ঠেলে, জঙ্গল-সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জলে ভিজে, আবার কখনো ঢালু বগল অবধি ডুবে যাওয়া গর্তে নেমে গিয়ে। প্রতিটি নালা জলে ভরে উপচে উঠেছে, তবুও বৃষ্টি ঝরেই পড়ছে, নদীর বুকে বৃষ্টি সজোরে ঝরে হলদে ফেনার জন্ম দিচ্ছে, বৃষ্টির ধাক্কায় আমাদের প্রায় দম আটকে যাওয়ার দশা। আধাদিন ধরে এই সব সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে আমরা পৌঁছালাম নদীর ওপারে, নিরানন্দে নিমজ্জিত এমভূমি গ্রামে।
কালো, ক্ষুধার্ত মশার ঝাঁকের সাথে বীরের মত লড়াই করতে করতে আমরা রাত কাটালাম, তবে দেহের চূড়ান্ত ক্লান্তির কারণে ঘুমের কোলে বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা আংশিকভাবে সফলও হল।