ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালার শেষ পর্যায়। তরজমা স্বাতী রায়
জাঞ্জিবার থেকে ফেরার উপায় খুবই সীমিত। আমার ফিরে আসার পরের সকালেই এইচ এম এস 'ম্যাগপাই' সমুদ্রযাত্রায় রওনা হয়েছিল। আর পরে বুঝলাম যে তাদের সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানোই উদ্দেশ্য ছিল। আরেক যুদ্ধ-জাহাজের মাধ্যমে সেশেলস ও ইংল্যান্ডে চিঠি পত্র পাঠিয়ে দিয়েছিল। যেমন শুনেছি তাই যদি সত্য হয়, একটি ইংরেজ যুদ্ধজাহাজ এমনকি ডাঃ লিভিংস্টোনের জন্যও এক ঘণ্টাও অতিরিক্ত অপেক্ষা করত না। অতএব আমার দুঃখ পাওয়ার কোন কারণ নেই যে লিভিংস্টোন সম্পর্কে ছোট্ট একটা খবরও পাঠানোর সময় সে আমাকে দেয়নি । কিন্তু একই সঙ্গে আমার এটাও আশ্চর্য মনে হয়েছিল এক যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেন যদি শিকারের দলের জন্য তার জাহাজকে বাগামোয়োতে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে আরেক ক্যাপ্টেন লিভিংস্টোনের নিরাপত্তার কথা জানিয়ে একটা চিঠি পাঠানোর জন্য কয়েকটা মিনিটও দেরি করতে পারল না।
একজন ইংরেজ পাদ্রীর মুখে শুনেছি যে ডক্টর লিভিংস্টোন নিজে জাঞ্জিবারে হাজির হলেও, একটা ব্রিটিশ জাহাজ তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক ঘণ্টা বেশি দাঁড়িয়ে থাকবে না; তবে একটা ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজের প্রথামাফিক শৃঙ্খলাবোধ যে এমন ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেও একটুও শিথিল করা হবে না এটা আমার বোধের অতীত।
আমার নিজের অভিযানের দলকে ভেঙে দেওয়ার পর, ডাঃ লিভিংস্টোনের অনুরোধ অনুযায়ী আমি আরেকটা অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ইংরেজ অভিযানে যা কিছু ছিল না, সেগুলো আমি মিঃ অসওয়াল্ড লিভিংস্টোনের দেওয়া অগ্রিম অর্থ থেকে কিনেছিলাম। ইংরেজ অভিযানের ভাণ্ডার থেকে পঞ্চাশটি বন্দুকও নেওয়া হল। সেই সঙ্গে ছিল গোলাবারুদ, উপঢৌকনের বাবদে কাপড়। গোগোদের নজরানা দেওয়ার জন্যও, আবার অভিযানের দলের রসদ যোগানোর জন্যও। মিঃ লিভিংস্টোন তাঁর বাবার স্বার্থে কঠোর পরিশ্রম করেছেন ও তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী আমাকে সাহায্য করেছেন। তিনি আমাকে ১৮৭২, ১৮৭৩ আর ১৮৭৪ সালের সামুদ্রিক পঞ্জিকা সরবরাহ করলেন; এছাড়া ডাঃ কার্কের কাছে থাকা একটি ক্রোনোমিটারও এনে দিলেন। এটা আগে ডাঃ লিভিংস্টোনের ছিল। এছাড়া এর পাশাপাশি খাতা, খাম, নোট-বই, লেখার কাগজ, ওষুধ, টিনবন্দী ফল ও মাছ, অল্প মদ, কিছু চা, ছুরি-কাঁটা-চামচ ও খাবার পরিবেশনের পাত্রাদি , সংবাদপত্র, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ও পুলিন্দাসকল টিনের মুখ-আঁটা বাক্সে হাওয়া-রোধক ভাবে পোরা হল। সেইসঙ্গে 100 পাউন্ড ভালো আমেরিকান ময়দা, ও সোডা বিস্কুটের কিছু বাক্সও দেওয়া হল।
১৯ মে পর্যন্ত জানা ছিল যে মিঃ অসওয়াল্ড লিভিংস্টোন তার বাবার জন্য পাঠানো কাফেলার দায়িত্ব নেবেন; কিন্তু এই সময় নাগাদ এ সম্পর্কে তিনি মন বদল করলেন, একটি হাতচিঠি দিয়ে আমাকে জানালেন যে তিনি উন্যান্যেম্বে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণগুলো তাঁর বিবেচনায় সঠিক ও যথেষ্ট। আমি তো অবাক! আগ বাড়িয়ে তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলাম যে তিনি যেহেতু জাঞ্জিবার অবধি চলেই এসেছেন কাজেই যাওয়াটা তাঁর কর্তব্য; কিন্তু অচিরেই স্পষ্ট হল যে তিনি যেটা সবচেয়ে ভালো বুঝেছেন সেভাবেই কাজ করেছেন। আর ডক্টর কার্ক তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে নিজের স্বাস্থ্যের ক্ষতি না করতে ও নিজের পড়াশোনা নষ্ট না করতে। বিশেষত কাফেলাটিতে তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানের ততটা দরকার নেই। এই পরামর্শের বিষয়টি বিবেচনা করে আমি মনে করি তাঁর পদত্যাগ করার সিদ্ধান্তই বেশ সঠিক কাজ । ডাঃ কার্ক ছিলেন তার পিতার বন্ধু, জাম্বেজিতে তাঁর পিতার প্রাক্তন সহচর; এবং তরুণ মিঃ লিভিংস্টোনের তার পরামর্শের উপর প্রচুর বিশ্বাস ও আস্থা ছিল, এমনকি নিজের বোধবুদ্ধির চেয়েও ডাঃ কার্কের কথার উপর তাঁর বেশি ভরসা ছিল । কাজেই এটাই স্বাভাবিক যে তিনি তাঁর পিতৃবন্ধুর পরামর্শ গ্রহণ করবেন।
এমতাবস্থায়, আমার দায়িত্ব ছিল ডাঃ লিভিংস্টোনের নির্দেশন অনুসারে, উন্যানয়েম্বে অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন ভালো এবং দক্ষ আরব নেতা জোগাড় করা ; আর এই ভেবেই আমি ডক্টর কার্কের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলাম, সুলতানের উপর তাঁর প্রভাব খাটানোর অনুরোধ জানিয়ে। আমি ডাঃ কার্কের কাছ থেকে যে উত্তর পেলাম তা এইরকম:
"ব্রিটিশ এজেন্সি, জাঞ্জিবার, ২০ মে, ১৮৭২।
"প্রিয় মহাশয়,
"ডাঃ লিভিংস্টোনের লেখা চিঠিটি সৈয়দ বুরগাশকে অনেক আগেই প্রেরণ করা হয়েছে ও তাকে বিশদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কিন্তু আমি তখন বলেছিলাম যে আপনি চিঠিতে লেখা দায়িত্বশীল নেতার জন্য তাঁকে আর বিরক্ত করার কথা ভাবছেন না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, মি. ডব্লিউ. ও. লিভিংস্টোন পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করার চিন্তা ত্যাগ করায়, আমি সুলতানের বাবদে আপনাকে সাহায্য করতে পেরে খুবই খুশি হব। আর আপনি চাইলে, অবিলম্বে লোক পাঠাব আর তাঁকে জানাব যে আপনার জন্য অবশ্যই উপযুক্ত লোক বেছে দিতে। তারপর আপনি অবশ্য ভাল করে বাজিয়ে দেখে নেবেন, যেমন ভাল মনে করেন সেই মত সেই লোককে গ্রহণ- প্রত্যাখ্যান করবেন।
একান্তই আপনার,
(স্বাক্ষরিত)
জন কার্ক।"
সুলতানের কাছে ডাঃ কার্কের পাঠানো আবেদন ব্যর্থ হয়েছিল, সেরকমই তিনি পরে আমাকে জানান; একথা জানার পর, আমি অন্য দিক দিয়ে একজন নেতা খুঁজতে শুরু করলাম, এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে শেখ হাশিদের কাছ থেকে একজনের সম্বন্ধে বড় মাপের সুপারিশ পেলাম। তাঁকেই আমি 100 ডলার অগ্রিম দিয়ে কাজে লাগালাম। এই আরব যুবকটি খুব উল্লেখযোগ্যরকমের বুদ্ধিমান ছিল না। তবে মনে হয়েছিল, সে সৎ , কাজটা করতেও পারবে। তবে ডাঃ লিভিংস্টোনের কাছে উন্যানয়েম্বে পৌঁছানোর পরে, তিনিই ঠিক করবেন যে সে যথেষ্ট বিশ্বাসের যোগ্য কিনা আর তার পরের কাজ পাওয়াও সে বিষয়ের উপরই নির্ভর করবে।
২৫ তারিখে লেফটেন্যান্ট. ডসন রওনা দিলেন। ক্যাপ্টেন রাসেলের দায়িত্বে নিউইয়র্কগামী আমেরিকান জাহাজ, মেরি এ. ওয়েতে চেপে সেই দিন জলে ভাসলেন। আমি তাঁর হাতে নিউইয়র্কে আমার এক বন্ধুর পরিচয়পত্র দিয়েছিলাম। পরম সৌহার্দ্যের সঙ্গে ও পারস্পরিক ভাল ধারণা নিয়ে আমরা আলাদা হলাম। আমার তাঁকে অত্যন্ত সাহসী ভদ্রলোক বলেই মনে হয়েছিল। ২৬ তারিখ সকালে, ডাঃ কার্ক আমেরিকান কনস্যুলেটে তাঁর বন্ধু মিঃ ওয়েবের সঙ্গে দেখা করতে ডেকেছিলেন এবং সেই সময়ে আমি তাকে বলার সুযোগ পেলাম, "ডক্টর, আমি ভয় হচ্ছে যে আমি মিঃ লিভিংস্টোনের উদ্দেশ্যে যে অভিযান পাঠানোর কথা ভেবেছি, সেটা যত তাড়াতাড়ি পাঠাতে চেয়েছিলাম তেমনটা সম্ভব হবে না। যে স্টিমারে মিঃহেন, মিঃ লিভিংস্টোন আর আমি টিকিট কেটেছি, সেটা যদি আমি অভিযান রওনা করিয়ে দেওয়ার আগেই যাত্রা শুরু করে, তাহলে আপনাকেই এটির দায়িত্ব নিতে বলব।"
জবাবে ডাঃ কার্ক বললেন, "আপনি বললে আমাকে সে অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে হবে। আমি আর নিজেকে অযথা অপমানের মুখে ফেলতে চাই না১। আমি ব্যক্তিগত ক্ষমতায় ডাঃ লিভিংস্টোনের জন্য আর কিছু করতে পারব না।সরকারীভাবে যে কোন ব্রিটিশ প্রজার জন্য যা করার সেটুকুই করব। "
"অকারণ অপমান, কী বলেছেন আপনি, ডাঃ কার্ক?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম-
"হ্যাঁ।"
"কি ব্যাপার, জিজ্ঞাসা করতে পারি?"
"তিনি তাঁর কাছে কাফেলা না পৌঁছানোর জন্য আমাকে দোষারোপ করেছেন । কাফেলার ভার ক্রীতদাসদের হাতে ছাড়ার জন্য আমাকে দায়ী করেছেন। যদি লোকেরা তার কাছে না পৌঁছায়, তবে আমি কি করতে পারি?"
"মাপ করবেন, ডাঃ কার্ক, কিন্তু আপনি যদি ডাঃ লিভিংস্টোনের জায়গায় থাকতেন তবে আপনি নিজেই সেই অভিযোগ করতেন। আপনার শ্রেষ্ঠ বন্ধুকেও যদি একের পর এক কাফেলার সর্দাররা জানিয়ে যেত যে, তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রাজদূত নির্দেশ দিয়েছেন আর কোন অবস্থাতেই তাঁর সঙ্গে কোথাও না যেতেও বলে দিয়েছেন, তাহলে তিনিও সম্পর্কের শীতলতার কথাই ভাবতেন।"
"কিন্তু তিনি তো চুক্তিপত্রে দেখতেই পেতেন যে তাঁর পছন্দমত দিকে তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্যই তাদের কাজে লাগানো হয়েছিল। তিনি যদি নিগ্রো ও দোআঁশলা দের কথায় বেশি বিশ্বাস করতে পছন্দ করেন, আর আমার কথা ও আমার অফিসিয়াল যোগাযোগে সন্দেহ করেন, তবে তিনি একজন বোকা; আমার এটুকুই কেবল বলার।"
“কিন্তু মশাই, ডঃ লিভিংস্টোন কিভাবে চুক্তির বিষয়ে সন্দেহ করবেন? সবাই যে তার কাছে শপথ নিয়ে বলেছে যে আপনি তাদের আদেশ করেছেন, তাঁকে ফিরিয়ে আনতে! তাদের হাজার অনুরোধ করেও কাজ হয়নি , আর গোটা ব্যাপারটাই শেষ হচ্ছিল তাঁকে তাঁর আবিষ্কারের বাসনা পরিত্যাগ করে জোর করে ফিরে যেতে বাধ্য করার চেষ্টা দিয়ে। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটাকিছু গণ্ডগোল আছে, এই বিশ্বাস করা ছাড়া তাঁর আর কি করার ছিল ? দেশের গভীরে পথ চলতে চলতে সবজায়গায় তিনি একই গল্প বারবার শুনেছেন, আপনি তাঁকে ফিরে আসার নির্দেশ দিয়ে একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন। "
"তেমন ভাবলে আমি আর কি করতে পারি? যাই হোক, তিনি আমাকে যেমন চিঠি পাঠিয়েছেন আমিও তাঁকে তার একটি যথাযথ প্রত্যুত্তর লিখেছি।"
"হুম," আমি বললাম, "অর্থাৎ জাঞ্জিবারে কাফেলা রেখে আমার ফিরে যাওয়া চলবে না। যে করেই হোক আমাকেই তাদের রওনা করিয়ে দিতে হবে।"
পরের দিন আমি সব লোকদের একত্রে ডাকলাম । তাদের শহরে ঘোরাঘুরি করতে দেওয়া বিপজ্জনক বলে, আমি তাদের একটা উঠোনে আটকে রাখলাম আর সেখানেই তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল, যতক্ষণ না প্রতিটি লোক, সংখ্যায় মোট ৭৭ জন, তাদের নিজের নিজের নামে সাড়া দিতে শেখে।
জাঞ্জিবার থেকে ফেরার উপায় খুবই সীমিত। আমার ফিরে আসার পরের সকালেই এইচ এম এস 'ম্যাগপাই' সমুদ্রযাত্রায় রওনা হয়েছিল। আর পরে বুঝলাম যে তাদের সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানোই উদ্দেশ্য ছিল। আরেক যুদ্ধ-জাহাজের মাধ্যমে সেশেলস ও ইংল্যান্ডে চিঠি পত্র পাঠিয়ে দিয়েছিল। যেমন শুনেছি তাই যদি সত্য হয়, একটি ইংরেজ যুদ্ধজাহাজ এমনকি ডাঃ লিভিংস্টোনের জন্যও এক ঘণ্টাও অতিরিক্ত অপেক্ষা করত না। অতএব আমার দুঃখ পাওয়ার কোন কারণ নেই যে লিভিংস্টোন সম্পর্কে ছোট্ট একটা খবরও পাঠানোর সময় সে আমাকে দেয়নি । কিন্তু একই সঙ্গে আমার এটাও আশ্চর্য মনে হয়েছিল এক যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেন যদি শিকারের দলের জন্য তার জাহাজকে বাগামোয়োতে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে আরেক ক্যাপ্টেন লিভিংস্টোনের নিরাপত্তার কথা জানিয়ে একটা চিঠি পাঠানোর জন্য কয়েকটা মিনিটও দেরি করতে পারল না।
একজন ইংরেজ পাদ্রীর মুখে শুনেছি যে ডক্টর লিভিংস্টোন নিজে জাঞ্জিবারে হাজির হলেও, একটা ব্রিটিশ জাহাজ তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক ঘণ্টা বেশি দাঁড়িয়ে থাকবে না; তবে একটা ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজের প্রথামাফিক শৃঙ্খলাবোধ যে এমন ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেও একটুও শিথিল করা হবে না এটা আমার বোধের অতীত।
আমার নিজের অভিযানের দলকে ভেঙে দেওয়ার পর, ডাঃ লিভিংস্টোনের অনুরোধ অনুযায়ী আমি আরেকটা অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ইংরেজ অভিযানে যা কিছু ছিল না, সেগুলো আমি মিঃ অসওয়াল্ড লিভিংস্টোনের দেওয়া অগ্রিম অর্থ থেকে কিনেছিলাম। ইংরেজ অভিযানের ভাণ্ডার থেকে পঞ্চাশটি বন্দুকও নেওয়া হল। সেই সঙ্গে ছিল গোলাবারুদ, উপঢৌকনের বাবদে কাপড়। গোগোদের নজরানা দেওয়ার জন্যও, আবার অভিযানের দলের রসদ যোগানোর জন্যও। মিঃ লিভিংস্টোন তাঁর বাবার স্বার্থে কঠোর পরিশ্রম করেছেন ও তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী আমাকে সাহায্য করেছেন। তিনি আমাকে ১৮৭২, ১৮৭৩ আর ১৮৭৪ সালের সামুদ্রিক পঞ্জিকা সরবরাহ করলেন; এছাড়া ডাঃ কার্কের কাছে থাকা একটি ক্রোনোমিটারও এনে দিলেন। এটা আগে ডাঃ লিভিংস্টোনের ছিল। এছাড়া এর পাশাপাশি খাতা, খাম, নোট-বই, লেখার কাগজ, ওষুধ, টিনবন্দী ফল ও মাছ, অল্প মদ, কিছু চা, ছুরি-কাঁটা-চামচ ও খাবার পরিবেশনের পাত্রাদি , সংবাদপত্র, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ও পুলিন্দাসকল টিনের মুখ-আঁটা বাক্সে হাওয়া-রোধক ভাবে পোরা হল। সেইসঙ্গে 100 পাউন্ড ভালো আমেরিকান ময়দা, ও সোডা বিস্কুটের কিছু বাক্সও দেওয়া হল।
১৯ মে পর্যন্ত জানা ছিল যে মিঃ অসওয়াল্ড লিভিংস্টোন তার বাবার জন্য পাঠানো কাফেলার দায়িত্ব নেবেন; কিন্তু এই সময় নাগাদ এ সম্পর্কে তিনি মন বদল করলেন, একটি হাতচিঠি দিয়ে আমাকে জানালেন যে তিনি উন্যান্যেম্বে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণগুলো তাঁর বিবেচনায় সঠিক ও যথেষ্ট। আমি তো অবাক! আগ বাড়িয়ে তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলাম যে তিনি যেহেতু জাঞ্জিবার অবধি চলেই এসেছেন কাজেই যাওয়াটা তাঁর কর্তব্য; কিন্তু অচিরেই স্পষ্ট হল যে তিনি যেটা সবচেয়ে ভালো বুঝেছেন সেভাবেই কাজ করেছেন। আর ডক্টর কার্ক তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে নিজের স্বাস্থ্যের ক্ষতি না করতে ও নিজের পড়াশোনা নষ্ট না করতে। বিশেষত কাফেলাটিতে তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানের ততটা দরকার নেই। এই পরামর্শের বিষয়টি বিবেচনা করে আমি মনে করি তাঁর পদত্যাগ করার সিদ্ধান্তই বেশ সঠিক কাজ । ডাঃ কার্ক ছিলেন তার পিতার বন্ধু, জাম্বেজিতে তাঁর পিতার প্রাক্তন সহচর; এবং তরুণ মিঃ লিভিংস্টোনের তার পরামর্শের উপর প্রচুর বিশ্বাস ও আস্থা ছিল, এমনকি নিজের বোধবুদ্ধির চেয়েও ডাঃ কার্কের কথার উপর তাঁর বেশি ভরসা ছিল । কাজেই এটাই স্বাভাবিক যে তিনি তাঁর পিতৃবন্ধুর পরামর্শ গ্রহণ করবেন।
এমতাবস্থায়, আমার দায়িত্ব ছিল ডাঃ লিভিংস্টোনের নির্দেশন অনুসারে, উন্যানয়েম্বে অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন ভালো এবং দক্ষ আরব নেতা জোগাড় করা ; আর এই ভেবেই আমি ডক্টর কার্কের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলাম, সুলতানের উপর তাঁর প্রভাব খাটানোর অনুরোধ জানিয়ে। আমি ডাঃ কার্কের কাছ থেকে যে উত্তর পেলাম তা এইরকম:
"ব্রিটিশ এজেন্সি, জাঞ্জিবার, ২০ মে, ১৮৭২।
"প্রিয় মহাশয়,
"ডাঃ লিভিংস্টোনের লেখা চিঠিটি সৈয়দ বুরগাশকে অনেক আগেই প্রেরণ করা হয়েছে ও তাকে বিশদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কিন্তু আমি তখন বলেছিলাম যে আপনি চিঠিতে লেখা দায়িত্বশীল নেতার জন্য তাঁকে আর বিরক্ত করার কথা ভাবছেন না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, মি. ডব্লিউ. ও. লিভিংস্টোন পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করার চিন্তা ত্যাগ করায়, আমি সুলতানের বাবদে আপনাকে সাহায্য করতে পেরে খুবই খুশি হব। আর আপনি চাইলে, অবিলম্বে লোক পাঠাব আর তাঁকে জানাব যে আপনার জন্য অবশ্যই উপযুক্ত লোক বেছে দিতে। তারপর আপনি অবশ্য ভাল করে বাজিয়ে দেখে নেবেন, যেমন ভাল মনে করেন সেই মত সেই লোককে গ্রহণ- প্রত্যাখ্যান করবেন। ।
একান্তই আপনার,
(স্বাক্ষরিত)
জন কার্ক।"
সুলতানের কাছে ডাঃ কার্কের পাঠানো আবেদন ব্যর্থ হয়েছিল, সেরকমই তিনি পরে আমাকে জানান; একথা জানার পর, আমি অন্য দিক দিয়ে একজন নেতা খুঁজতে শুরু করলাম, এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে শেখ হাশিদের কাছ থেকে একজনের সম্বন্ধে বড় মাপের সুপারিশ পেলাম। তাঁকেই আমি 100 ডলার অগ্রিম দিয়ে কাজে লাগালাম। এই আরব যুবকটি খুব উল্লেখযোগ্যরকমের বুদ্ধিমান ছিল না। তবে মনে হয়েছিল, সে সৎ , কাজটা করতেও পারবে। তবে ডাঃ লিভিংস্টোনের কাছে উন্যানয়েম্বে পৌঁছানোর পরে, তিনিই ঠিক করবেন যে সে যথেষ্ট বিশ্বাসের যোগ্য কিনা আর তার পরের কাজ পাওয়াও সে বিষয়ের উপরই নির্ভর করবে।
২৫ তারিখে লেফটেন্যান্ট. ডসন রওনা দিলেন। ক্যাপ্টেন রাসেলের দায়িত্বে নিউইয়র্কগামী আমেরিকান জাহাজ, মেরি এ. ওয়েতে চেপে সেই দিন জলে ভাসলেন। আমি তাঁর হাতে নিউইয়র্কে আমার এক বন্ধুর পরিচয়পত্র দিয়েছিলাম। পরম সৌহার্দ্যের সঙ্গে ও পারস্পরিক ভাল ধারণা নিয়ে আমরা আলাদা হলাম। আমার তাঁকে অত্যন্ত সাহসী ভদ্রলোক বলেই মনে হয়েছিল। ২৬ তারিখ সকালে, ডাঃ কার্ক আমেরিকান কনস্যুলেটে তাঁর বন্ধু মিঃ ওয়েবের সঙ্গে দেখা করতে ডেকেছিলেন এবং সেই সময়ে আমি তাকে বলার সুযোগ পেলাম, "ডক্টর, আমি ভয় হচ্ছে যে আমি মিঃ লিভিংস্টোনের উদ্দেশ্যে যে অভিযান পাঠানোর কথা ভেবেছি, সেটা যত তাড়াতাড়ি পাঠাতে চেয়েছিলাম তেমনটা সম্ভব হবে না। যে স্টিমারে মিঃহেন, মিঃ লিভিংস্টোন আর আমি টিকিট কেটেছি, সেটা যদি আমি অভিযান রওনা করিয়ে দেওয়ার আগেই যাত্রা শুরু করে, তাহলে আপনাকেই এটির দায়িত্ব নিতে বলব।"
জবাবে ডাঃ কার্ক বললেন, "আপনি বললে আমাকে সে অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে হবে। আমি আর নিজেকে অযথা অপমানের মুখে ফেলতে চাই না। আমি ব্যক্তিগত ক্ষমতায় ডাঃ লিভিংস্টোনের জন্য আর কিছু করতে পারব না।সরকারীভাবে যে কোন ব্রিটিশ প্রজার জন্য যা করার সেটুকুই করব। "
"অকারণ অপমান, কী বলেছেন আপনি, ডাঃ কার্ক?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম.
"হ্যাঁ।"
"কি ব্যাপার, জিজ্ঞাসা করতে পারি?"
"তিনি তাঁর কাছে কাফেলা না পৌঁছানোর জন্য আমাকে দোষারোপ করেছেন । কাফেলার ভার ক্রীতদাসদের হাতে ছাড়ার জন্য আমাকে দায়ী করেছেন। যদি লোকেরা তার কাছে না পৌঁছায়, তবে আমি কি করতে পারি?"
"মাপ করবেন, ডাঃ কার্ক, কিন্তু আপনি যদি ডাঃ লিভিংস্টোনের জায়গায় থাকতেন তবে আপনি নিজেই সেই অভিযোগ করতেন। আপনার শ্রেষ্ঠ বন্ধুকেও যদি একের পর এক কাফেলার সর্দাররা জানিয়ে যেত যে, তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রাজদূত নির্দেশ দিয়েছেন আর কোন অবস্থাতেই তাঁর সঙ্গে কোথাও না যেতেও বলে দিয়েছেন, তাহলে তিনিও সম্পর্কের শীতলতার কথাই ভাবতেন।"
"কিন্তু তিনি তো চুক্তিপত্রে দেখতেই পেতেন যে তাঁর পছন্দমত দিকে তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্যই তাদের কাজে লাগানো হয়েছিল। তিনি যদি নিগ্রো ও দোআঁশলা দের কথায় বেশি বিশ্বাস করতে পছন্দ করেন, আর আমার কথা ও আমার অফিসিয়াল যোগাযোগে সন্দেহ করেন, তবে তিনি একজন বোকা; আমার এটুকুই কেবল বলার।"
“কিন্তু মশাই, ডঃ লিভিংস্টোন কিভাবে চুক্তির বিষয়ে সন্দেহ করবেন? সবাই যে তার কাছে শপথ নিয়ে বলেছে যে আপনি তাদের আদেশ করেছেন, তাঁকে ফিরিয়ে আনতে! তাদের হাজার অনুরোধ করেও কাজ হয়নি , আর গোটা ব্যাপারটাই শেষ হচ্ছিল তাঁকে তাঁর আবিষ্কারের বাসনা পরিত্যাগ করে জোর করে ফিরে যেতে বাধ্য করার চেষ্টা দিয়ে। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটাকিছু গণ্ডগোল আছে, এই বিশ্বাস করা ছাড়া তাঁর আর কি করার ছিল ? দেশের গভীরে পথ চলতে চলতে সবজায়গায় তিনি একই গল্প বারবার শুনেছেন, আপনি তাঁকে ফিরে আসার নির্দেশ দিয়ে একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন। "
"তেমন ভাবলে আমি আর কি করতে পারি? যাই হোক, তিনি আমাকে যেমন চিঠি পাঠিয়েছেন আমিও তাঁকে তার একটি যথাযথ প্রত্যুত্তর লিখেছি।"
"হুম," আমি বললাম, "অর্থাৎ জাঞ্জিবারে কাফেলা রেখে আমার ফিরে যাওয়া চলবে না। যে করেই হোক আমাকেই তাদের রওনা করিয়ে দিতে হবে।"
পরের দিন আমি সব লোকদের একত্রে ডাকলাম । তাদের শহরে ঘোরাঘুরি করতে দেওয়া বিপজ্জনক বলে, আমি তাদের একটা উঠোনে আটকে রাখলাম আর সেখানেই তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল, যতক্ষণ না প্রতিটি লোক, সংখ্যায় মোট ৭৭ জন, তাদের নিজের নিজের নামে সাড়া দিতে শেখে।