ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে আছে দুরন্ত শিকারের কাহিনিও। তরজমায় স্বাতী রায়
যেই পোশাক পরা শেষ হল, অমনি স্রোতের বর্তমান ঘৃণ্য রূপের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমার শিবিরের দিকে হেঁটে হেঁটে আসতে গিয়ে দু'জন আদিবাসী চোখে পড়ল, ভাল করে তাদের চারপাশটা দেখলাম আর আমার বাচ্চা সঙ্গীদের একদম চুপ করে থাকতে বলে, আমি তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। একটা ঝাঁকড়া ঝোপের আড়াল দিয়ে, সবার নজর এড়িয়ে, তাদের কয়েক ফুটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। দেশের তখনকার অশান্ত পরিস্থিতিতে এই গভীর অরণ্যে তাদের অব্যাখ্যাত উপস্থিতিও অস্বস্তির কারণ- আমার উদ্দেশ্য ছিল আচমকা তাদের সামনে হাজির হওয়া আর তাদের ভাবান্তর নজর করা, যদি অভিযানের প্রতি কোন প্রতিকূলতার পরিচয় মেলে তো আমার দো-নলা বন্দুকের সাহায্যে, নির্ঝঞ্ঝাটে সঙ্গে সঙ্গে একেবারে নিষ্পত্তি করে ফেলব।
যেই ঝোপের একপাশে পৌঁছেছি, তখন দু'জন সন্দেহজনক চেহারার দেশিয় লোক ঝোপের অন্য পাশে এসে পৌঁছল- আমাদের দূরত্ব মাত্র কয়েক ফুট। যেই ঘুরেছি, অমনি তাদের মুখোমুখি। হঠাৎ উদয় হওয়া সাহেবের দিকে আদিবাসীরা এক ঝলক তাকাল, এক মুহূর্তে জন্য যেন ভয়ে পাথর হয়ে গেল, কিন্তু তারপর, সামলে নিয়ে, চিল্লিয়ে উঠল, ‘‘কর্তা মশাই, কর্তা মশাই, আপনি আমাদের চেনেন না। আমরা হলাম কোনঙ্গোর লোক, সেই যে এমরেরাতে আপনার শিবিরে এসেছিলাম, আমরা মধু খুঁজছি।’’
‘‘ওহ্, আচ্ছা, তোমরাই সেই কোনঙ্গোর লোক। আচ্ছা, তাহলে তো ঠিক আছে, আমি ভেবেছিলাম তোমরা হয়তো রুগা-রুগা।’’
দুই পক্ষ একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ-টুদ্ধ না করে হাসিতে ফেটে পড়ল। কোনঙ্গোর লোকেরা খুব মজা পেল। প্রাণের আনন্দে হাসতে হাসতে তারা বুনো মধু খুঁজতে এগিয়ে গেল। এক টুকরো গাছের ছালে করে তারা অল্প একটু আগুন নিয়ে যাচ্ছিল- ওই আগুন দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে তারা বিশাল এমটুনডু গাছের মধ্যের মৌচাক থেকে মৌমাছিদের তাড়াবে।
সেদিনের মত অভিযান শেষ। আকাশের নীলাভ মরা ধূসর রঙে বদলে গেছে; গাছের মাথার উপরে সদ্য চাঁদ উঠেছে; গোম্বের জল একটি রূপালী ফিতের মত দেখাচ্ছে; খাঁড়ির ধারের ব্যাঙগুলি কর্কশ রবে সজোরে ঘ্যাঁঙ্গাচ্ছে; উঁচুতম গাছের মাথায় বসে শঙ্খচিলেরা যেন রুদালী গাইছে; এল্যান্ডরা চিঁ হিহি রবে জঙ্গলের মধ্যের পশুর দলকে সতর্ক করে দিচ্ছে; মাংসাশী প্রাণীরা আমাদের শিবিরের বাইরের অন্ধকার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চুপি চুপি ঘুরছে। শিবিরের চারপাশে আমরা ঝোপ ও কাঁটাগাছের উঁচু বেড়া তুলে দিয়েছিলাম। সেই ঘেরা জায়গায় উচ্ছলতা, হাসি আর উজ্জ্বল, আনন্দময় আরাম উপচে পড়ছে। জায়গায় জায়গায় আগুন জ্বলছে আর প্রতিটি আগুন ঘিরে উবু হয়ে বসে আছে কালো মানুষের দল: কেউ স্বাদু হাড় চিবাচ্ছে; কেউ বা জেব্রার পায়ের হাড়ের মজ্জা চুষছে; কেউ আবার জ্বলজ্বলে আগুনে বিশাল কাবাব জড়ানো লাঠিটাকে এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে, আরেকজন একটা বড় পাঁজরাকে আগুনে ঝলসাচ্ছে; অন্যরা বড় বড় কালো পাত্রে উগালি রান্নায় ব্যস্ত, সিদ্ধ হতে থাকা মাংসের দিকে উদ্বিগ্ন ভাবে তাকিয়ে আছে আর স্যুপের ফুটে ওঠা দেখছে। আগুনের শিখা দপদপ করছে, যেন বীর দর্পে নাচছে, উলঙ্গ মানুষগুলোর গায়ে উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর সেই আলোতে শিবিরের মাঝখানের লম্বা তাঁবুটাকে লাল রঙের দেখাচ্ছে, যেন কোনো রহস্যময় দেবতার পবিত্র মন্দির; শিবিরের উপরে ছড়িয়ে থাকা গাছের বিশাল বিশাল শাখাতে আলোর প্রতিফলন হচ্ছে, আর তাদের ঘন পাতা নিকষ অন্ধকারে, এক আশ্চর্য ছায়ার খেলা জমে উঠেছে। সব মিলিয়ে একটা ভারি বন্য, রোমান্টিক ও মনভোলানো ছবি। তবে আমার লোকরা এইসব ছায়া, চাঁদের আলো, লাল-আভা বা মন্দির-সদৃশ তাঁবুর পরোয়া করে কম - তারা সবাই যে যার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প করতে ব্যস্ত, আর হামলে পড়ে আমাদের বন্দুকের সাহায্যে পাওয়া অঢেল মাংসের সদ্ব্যবহার করছে । একজন বলছিল যে সে কীভাবে একটা বন্য শুয়োরকে ধাওয়া করেছিল, আহত ক্ষিপ্ত প্রাণীটি কিভাবে তার দিকে তেড়ে এসেছিল। সে তো বন্দুক ফেলে ছুটে গিয়ে একটা গাছে চেপে বসেছিল উঠেছিল, পুঁচকে জন্তুটার ভয়ানক চেহারা তার মাথায় গেঁথে গেছে। আর সে যেভাবে নকল করে দেখাচ্ছিল তাতে গোটা আকাশটাই যেন হাসির হররা ছোটাচ্ছিল। আরেকজন একটা মোষের বাচ্চা মেরেছিল। অন্য আরেকজন একটা হার্ট-বিস্টকে গুলি করেছিল; কোনোঙ্গোর লোকেরা বনের মধ্যে আমার সঙ্গে তাদের হাস্যকর মোলাকাতের কথা বলেছিল, এবং বনের মধ্যে যে কতই না মধু আছে সে কথা পাঁচ মুখে বলছিল; এদিকে এই গোটা সময়টা সেলিম আর তার দলবলেরা একটা ছোট শূকরের মাংস খেয়ে যাচ্ছিল। শুয়োরটাকে একজন শিকারি মেরেছে কিন্তু অন্য কেউ সেটা খাবে না, কারণ মুসলমানরা শূকর খায় না- এটা তাদের নিগ্রো বর্বরতা থেকে জাঞ্জিবারের স্বাধীন মানুষের উপযুক্ত বশ্যতায় পরিবর্তনের সময়ের অর্জন।
পরের দু'দিন এখানেই ছিলাম, আর এই দারুণ জায়গাটার পশুর দলের উপর মাঝে মাঝেই অভিযান চালিয়েছিলাম। প্রথম দিন শিকারে আবার মোটামুটি সফল হলাম। গোটা কতক হরিণ, দারুণ বাঁকানো শিং ওলা একটা কুডু (এ. স্ট্রেপসিরোস), আর একটা পাল্লা-বাক (এ. মেলাম্পাস) শিকার করলাম, পাল্লা-বাক একটা লালচে বাদামী প্রাণী, লম্বায় প্রায় সাড়ে তিন ফুট, পশ্চাদ্দেশ বেশ চওড়া। ল্যাঙ্কাস্টার, রেইলি, বা ব্লিসেটের তৈরি অভ্রান্ত, ভারী রাইফেলগুলোর, যাদের প্রতিটা গুলি কথা কয়, তাদের মধ্যে কোনও একটা হাতে থাকলে সেদিন আমি ডজন ডজন প্রাণী শিকার করে আসতাম। একমাত্র আমার হালকা মসৃণ নলের বন্দুকটা ছাড়া অন্য অস্ত্রগুলো আফ্রিকায় শিকারের অনুপযুক্ত। আমার অস্ত্রগুলো বরং মানুষের জন্য কাজের। উইনচেস্টার রাইফেল আর স্টারের কারবাইন দিয়ে, দুশ গজের মধ্যের যে কোনও কিছুকেই আঘাত করা সম্ভব, কিন্তু জন্তুরা আহত হলেও, ছুরি নাগাল থেকে বেশ পালিয়ে যাচ্ছিল, এইসব দেখে মটরদানা-গুলির প্রতি বিরক্তি জন্মে গেল। এই দেশের জন্য একটা ভারি গোছের বন্দুক চাই- হাড় গোড় ভেঙ্গে দেওয়া ১০ বা ১২ নম্বর গুলির বন্দুক- যে গুলি খেলে প্রত্যেকটা প্রাণী নিজের জায়গাতেই লুটিয়ে পড়বে, ফলে সকল ক্লান্তি আর হতাশা এড়ানো যাবে। এই দুই দিনে এক একটা প্রাণীর পিছনে খুবই কষ্ট করে বহুক্ষণ ধাওয়া করে আর অনেকক্ষণ মাটিতে হামাগুড়ি দেওয়ার পরেও বার বার হতাশ হয়েছি। একবার আচমকা একটা ইল্যান্ডের সামনে আসি, তখন আমার হাতে একটা উইনচেস্টার রাইফেল। আমিও অবাক, ইল্যান্ডটাও অবাক। মাত্র পঁচিশ গজের বেশি দূরে নয়, জন্তুটার বুকে গুলি চালালাম, আর বুলেটটা তার লক্ষ্যে অবিচল থেকে, দ্রুত গতিতে শরীরের অনেকটা ভিতরে চলে গেল। ক্ষত থেকে রক্ত বেরিয়ে এলো: তার কয়েক মিনিটের মধ্যে সে অনেক দূরে চলে গেল, আর তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে খুবই হতাশ হতে হল। এইরকম কয়েকটা দুর্ঘটনার পরে প্রাণীদের পিছনের ধাওয়া করার সব আনন্দ উবে গেল। যেখানে জায়গাটার উপর দিয়ে হাজার হাজার হরিণ চড়ে বেড়াচ্ছে, সেখানে একটা গোটা দিনের শিকার মাত্র দুটো হরিণ?
তিনদিন ধরে শিকার করে দুটো মোষ, দুটো বুনো শুয়োর, তিনটে হার্ট বিস্ট, একটা জেব্রা আর একটা পাল্লা শিবিরে আনা হয়েছিল। এছাড়াও মারা হয়েছিল আটটা গিনি-ফাউল, তিনটে ফ্লোরিকান, দুটো শঙ্খচিল, একটা পেলিকান। একজন কয়েকটা বড় বোয়াল মাছও ধরেছিল। নির্জন প্রান্তরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পদযাত্রা রয়েছে আমাদের সামনে। সেই পথের জন্য লোকেরা মাংসের এই সুবিশাল ভাণ্ডার কেটে, টুকরো টুকরো করে ও শুকিয়ে নিচ্ছিল।
(ক্রমশ)