ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে উজিজির পথে এগিয়ে চলার বর্ণনা। তরজমায় স্বাতী রায়
৭ই অক্টোবর, শনিবার, শিবির গোটানো হল। মাংস-প্রেমী পেটুক এনগোয়ানাদের খুবই দুঃখ। তারা ভোরবেলা আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য বোম্বেকে ধরেছিল। ওখানে আরও একদিন থেকে যাওয়ার অনুরোধ জানানোর জন্য। সবসময়ই এরকম হয়। মাংস পাওয়া গেলে আর কাজ করতে ইচ্ছে করে না। দু'দিনের ধরে বিশ্রামের সময় গান্ডেপিন্ডে মাংস গেলার পরেও এইরকম আবদার করার জন্য বোম্বে রাম-ধমক খেল। এমনিতেই বোম্বের মেজাজ মোটেই ভাল ছিল না; ক্রমাগত হাঁটা আর তজ্জনিত ক্লান্তির চেয়ে নাদুসনুদুস নারী-শরীর তার বেশি পছন্দের। দেখলাম তার মুখটা বিচ্ছিরি হয়ে গেছে, বিশাল নিচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়ে আছে, যার অর্থ শব্দে প্রকাশ করলে দাঁড়ায় যে, ‘‘বেশ, তাহলে তুমি নিজেই ওদের নড়াও, বাজে কঠোর লোক একটা। আমি মোটেই কোন সাহায্য করব না।’’
কিরনগোজিকে যাত্রা শুরুর সংকেত-শিঙ্গা বাজাতে হুকুম দিলাম। সেই হুকুম শুনে চারদিকে একটা অশুভ নীরবতা নেমে এলো। সব সময় যা গানবাজনা, মন্ত্র পড়া ইত্যাদি শোনা যায়, সব থেমে গেল। সবাই চুপ করে নিজের নিজের বোঝার দিকে ফিরল, আর আমাদের বিশালদেহী পথপ্রদর্শক আসমানি, আমাদের ফান্ডি, গজরগজর করতে লাগল যে কেন যে মরতে আমার দলকে টাঙ্গনিকার পথ দেখানোর কাজে সে যোগ দিয়েছিল! তবে অনিচ্ছা স্বত্বেও রওনা দিল সবাই। বন্দুকধারীদের নিয়ে আমি পিছনে রইলাম, কেউ দল ছেড়ে পালাতে চাইলে তাদের ঠেকানোর জন্য। আধঘণ্টা টাক পরে দেখলাম কাফেলা একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, গাঁটরিগুলো মাটিতে নামানো, লোকেরা জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে আর রাগী ও উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে।
সেলিমের কাঁধ থেকে দোনলা বন্দুকটা নিলাম, আর এক ডজন ছররা গুলি নিলাম, তার মধ্যে দুটোকে ব্যারেলে ঠুসে দিলাম, সেই সঙ্গে আমার রিভলভারটাকে কাজের জন্য বেশ করে বাগিয়ে ধরে, আমি তাদের দিকে এগোলাম। লক্ষ্য করলাম যে যেই আমি এগোচ্ছি , অমনি লোকগুলো তাদের বন্দুক চেপে ধরছে। দলগুলোর মধ্যে ত্রিশ গজ যাওয়ার পরে দেখলাম যে বাঁহাতে ছোট ঢিপিটার উপর দিয়ে দুটো মাথা দেখা যাচ্ছে, তাদের বন্দুকের নলগুলো আলগোছে রাস্তার দিকে ঘোরানো।
ওখানেই দাঁড়িয়ে গেলাম, বন্দুকটা বাঁ কাঁধে লাগিয়ে তারপর, ইচ্ছাকৃত ভাবে তাদের দিকে তাক করলাম, আর সামনে এসে কথা না বললে তাদের মুণ্ডু উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিলাম। এই দুজন হল, দানব আসমানি ও তার চেলা মাব্রুকি, শেখ বিন নাসিবের পথপ্রদর্শক। হুকুম না মানলে কপালে দুঃখ আছে, তাই তারা সুড়সুড়িয়ে বেরিয়ে এলো, আসমানির দিকে ঠায় নজর রেখে আছি - বন্দুকের ট্রিগারে তার আঙুল নড়তে-চড়তে দেখেছি, তার বন্দুকটাও গুলি ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত। আবার আমি আমার বন্দুক তুলে নিলাম, আর তক্ষুনি বন্দুক না ফেলে দিলে তাকে তখনই মেরে ফেলার হুমকি দিলাম।
একটা দেঁতো হাসি মুখে মেখে আসমানি পাশ বরাবর এলো, তবে খলনায়কের চোখ যেমন জ্বলে, তার চোখে স্পষ্ট তেমন খুনে আলো। ইচ্ছে করে বন্দুকে বারুদ ঠাসতে ঠাসতে মাব্রুকি আমার পিছন দিক দিয়ে চুপি চুপি আসছিল, তবে ঝট করে পিছন ঘুরে আমি আমার বন্দুকের নলটা তার শয়তানি-ভরা মুখের থেকে ফুট দুয়েক দূরে ধরলাম আর অবিলম্বে তাকে বন্দুক ফেলে দিতে হুকুম দিলাম। সে তাড়াতাড়ি বন্দুকটাকে হাত থেকে ফেলে দিল। আমার বন্দুক দিয়ে তার বুকে এমন জোরে একটা খোঁচা মারলাম, যে সে ঘুরে কয়েক ফুট দূরে গিয়ে পড়ল। আসমানির দিকে ফিরে তাকে বন্দুক নামাতে বললাম। সেই সঙ্গে আলতো করে ট্রিগার টিপে বন্দুকটাও তাক করলাম। এই সামান্য সময়টুকুতে আসমানির মত মৃত্যুর কাছাকাছি আর কেউ ছিল না। তাকে ঠিক মেরে ফেলতে চাইনি, আর সে সম্ভাবনা এড়াতে সবরকম উপায়ই চেষ্টা করতে রাজি ছিলাম; তবে এই মস্তানকে হাতের মুঠোয় আনতে না পারলে আর কাউকে সামলাতে পারব না। ব্যাপারটা হল এই যে ওরা আরও এগোতে ভয় পাচ্ছিল। এগোতে বাধ্য করার একটাই রাস্তা, তা হল ওদের ওপর জোর ফলানো, আমার ক্ষমতা ও ইচ্ছার প্রয়োগ করা। তাতে তার অবাধ্যতার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডও দিতে হতে পারে। আসমানি বন্দুকটা কাঁধের কাছে তুলতে, আমি যখন ভাবতে শুরু করছি যে আসমানির ধরাধামে থাকার শেষ মুহূর্তটাও পেরিয়ে গেছে, তখন একটা চেহারা পিছন থেকে এসে এক অধৈর্য, বিচলিত ধাক্কায় তার বন্দুকটা একপাশে ফেলে দিল। শুনলাম মাব্রুকি স্পেক আতঙ্কিত ভাবে বলছে,
‘‘আরে কর্তার দিকে বন্দুক তোলার সাহস হয় কি করে?’’ তারপর মাব্রুকি আমার পায়ে পড়ে গেল, পায়ে চুমু খেতে চেষ্টা করল আর কাকুতিমিনতি করতে থাকল যে আসমানিকে যেন মেরে না ফেলি।
‘‘এখন সব মিটে গেছে,’’ সে বলল; ‘‘আর কোন ঝগড়া-ঝামেলা হবে না, সবাই নির্বিবাদে টাঙ্গনিকা পর্যন্ত যাবে; ইনশাআল্লাহ!’’ সে বলে চলল, ‘‘আমরা উজিজিতে বুড়ো সাহেবকে খুঁজে বের করব।’’
‘‘বল, তোমরা সব স্বাধীন মানুষেরা বল, খুঁজে পাব না আমরা? আমরা কি আর ঝামেলা না করে টাঙ্গনিকা অবধি যাব না? কর্তাকে একসঙ্গে বল সবাই।’’
‘‘ইয়া আল্লা! ইয়া আল্লাহ! বানা ইয়াঙ্গো! হামুনা মান্নেনো এমগিনি!’’ যার আক্ষরিক মানে হল, ‘‘হ্যাঁ ঈশ্বরের দিব্বি! আল্লাহর কসম! আমার প্রভু! আর কোন কথাই নেই,’’ সবাই চেঁচিয়ে বলে উঠল।
“মনিবের কাছে ক্ষমা চাও, না হলে যা খুশি করো,’’ মাব্রুকি সাফসাফ ভাবে আসমানিকে বলল: সবার সন্তুষ্টির জন্য আসমানি তাই করল।
বিদ্রোহ ভাল ভাবে ঠান্ডা হয়ে গেছে - এরপর শুধু বাকি রইল সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া। সবাইকেই, শুধু বোম্বে আর আম্বারিকে ছাড়া। তারাই বিদ্রোহে আস্কারা দিয়েছে। আমার অভিযানের নেতা হিসেবে বোম্বে ইচ্ছে করলে একটা কথা বলে শুরুতেই সব মেজাজ দেখানোর নিষ্পত্তি করতে পারত। কিন্তু না, বোম্বে মোটেই ভিতু না, তবে বেজায় আলসে আর ভয়ানক পেটুক, হাঁটতে তার ভারি আপত্তি। তাই একটি বর্শা ছিনিয়ে নিয়ে, তার ডাণ্ডা দিয়ে বোম্বের কাঁধে জোরে জোরে মারলাম, আর তারপর অম্বারির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম, যার বিদ্রূপ-ভরা মুখটা শীঘ্রই অসাধারণভাবে বদলে গেল, তারপর তাদের দুজনকেই শিকল দিয়ে বেঁধে দিলাম, হুমকি দিলাম যে ক্ষমা না চাওয়া অবধি তাদের শিকলেই আটকে রাখা হবে। আসমানি ও মাব্রুকিকে ও বলা হল যে এক চুলের জন্য তারা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, বেঁচে থাকতে চাইলে যেন তারা আর মেজাজ না দেখায়!
আবার যাত্রা শুরু করার ডাক দেওয়া হল, এবং সব্বাই, আশ্চর্য তত্পরতার সঙ্গে, বোঝা তুলে নিল আর দ্রুত দৃষ্টির বাইরে চলে গেল, বোম্বে ও আম্বারি পিছনে শিকলে বাঁধা, সঙ্গে রয়েছে দল-পালানোর চেষ্টা করা কিঙ্গারু ও আসমানি, তাদের মাথায় সবচেয়ে ভারী বোঝা চাপানো। .
গোম্বে থেকে সবেমাত্র ঘণ্টা খানেকের পথ পাড়ি দিয়েছি, বোমবে ও আম্বারী কাঁপা কাঁপা গলায় ক্ষমা চাইতে লাগল, আধা ঘণ্টা চলল সে পর্ব, তারপর তাদের ক্ষমা করলাম। শিকল থেকে মুক্তি দিলাম আর বোম্বেকে ফের পূর্ণ মর্যাদায় নেতার আসনে বসালাম।
কথাটা যখন উঠলই, পরের অধ্যায়গুলোতে যাদের নাম বারবার আসবে আমার দলের সেই সব প্রধান প্রধান লোকদের একটা ছবি দিয়ে রাখি। পদমর্যাদা অনুসারে, তারা হল বোম্বে, মাব্রুকি বার্টন, দলের গাইড আসমানি, চৌপেরেহ, উলিমেঙ্গো, খামিসি, আমবারি, জুমাহ, আমাদের বাবুর্চি ফেরাজ্জি, ন্যামওয়েজি মাগাঙ্গা, আরব ছোকরা সেলিম আর বাচ্চা বন্দুকধারী কালুলু।
বোম্বে বার্টন ও স্পেকের থেকে দুর্দান্ত চরিত্রের বলে প্রশংসা পেয়েছে, কিন্তু আমি দুঃখিত যে সে কখনই আমার থেকে এরকম প্রশংসা পাবে না। বার্টন তাকে বলেছেন ‘‘সততার অবতার’’। আসল কথা হল, বোম্বে না খুব সৎ, না খুব অসৎ, মানে সে কখনো বেশি কিছু চুরি করার চেষ্টাই করেনি। কখনও কখনও মাংস বিতরণের সময় ধূর্ত ভাবে, নিজের খাওয়ার জন্য একটা বড় অংশ লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করত। এই সামান্য অপরাধটার দিকে আমি চোখ বুজে থাকতাম ; দলের নেতা হিসেবে তার অন্যদের চেয়ে বড় অংশ পাওয়ারই কথা। তার দিকে কড়া নজর রাখতে হত, এবং সেই কথাটা বুঝে যাওয়ার পর থেকে সে কদাচিৎ নিজে চাইলে যতটা কাপড় সে অবাধে পেত তার চেয়ে বেশি কাপড় দখল করত। একজন খাশচাকর বা ভ্যালে হিসাবে সে হয়ত সমালোচনার ঊর্ধ্বে, তবে একজন দলনেতা বা জিম্মাদার হিসাবে সে তেমন কাজের না। এই কাজে মাথা লাগে আর অনেক চিন্তা ভাবনা করতে হয়, তার পক্ষে সেটা বড্ড বেশি দায়িত্ব। মাঝে মাঝে সে গাধার মতন কাজ কারবার করত, যাই বলা হত সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যেত, সারাক্ষণ দামী দামী জিনিসপত্র হয় ভাঙছে নয় হারাচ্ছে, মহা তক্কোবাজ আর তড়পাতে ভালবাসত। তার ধারণা যত বজ্জাত সাদা লোক জন্মেছে, হাজ্বী আবদুল্লাহ তাদের একজন, কারণ সে তাকে দেখেছে মানুষের মাথার খুলি তুলে বস্তায় ভরতে। তিনি যেন সেগুলো দিয়ে ভয়ানক কোন ওষুধ তৈরি করবেন। সে জানতে চেয়েছিল যে তার প্রাক্তন প্রভু যা কিছু করেছেন তার সবকিছু লিখে রেখে গেছেন কিনা। যখন তাকে বলা হল যে বার্টন তার হৃদ অঞ্চলের উপর লেখা বইতে কিলওয়াতে মাথার খুলি সংগ্রহ করা নিয়ে কিছুই বলেননি, সে ভেবেছিল যে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি প্রকাশ করলে আমি বেশ একটা ভাল কাজ করব। বোম্বে কখনো না কখনো স্পেকের কবর দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করত।
মাব্রুকি কে বার্টন ডাকত “রাস-বুকরা মাব্রুকি’’ বা গোঁয়ারগোবিন্দ মাব্রুকি বলে। আর দশজন মাব্রুকির থেকে আলাদা করার জন্য আমরা তাকে ডাকি মাব্রুকি স্পেক বলে। আমার মতে সে একজন অত্যন্ত নির্যাতিত ব্যক্তি। বার্টন ও মাব্রুকির একে অপরের সঙ্গে ঝগড়াগুলো প্রসিদ্ধ , দ্বিতীয়জন আমাকে সে রকমই বলেছে। আর তার কথা বিশ্বাস করতে হলে তার মনিব মোটেই সব সময় ভাল হিসেবে প্রতিভাত হননি। এই মহান পর্যটক তাকে আরবিতে সম্ভাষণ করতেন আর বাছাই বাছাই এলো শামের শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করে গালিগালাজ করতেন। ‘‘জিব আল হালীব বিল-আলেক,’’ তাকে এটা প্রায়ই বলা হত বলে মাব্রুকি বলল। এর মানে হচ্ছে, ‘‘দুধ নিয়ে আয়, ব্যাটা--’’ সিরিয়ান আরবি থেকে শেষ শব্দটা অনুবাদ করার মত ব্যুৎপত্তি আমার নেই। তবে কথাটা যে ভয়ঙ্কর কিছু, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই, কারণ এটা এখনও মাব্রুকিকে খেপিয়ে তোলে। মাব্রুকি বলেছে যে সে তার পুরোনো মনিবের সঙ্গে একবার সামনা সামনি লড়াই করতে চায়, তবে সে মনে হয় তার মনিবকে খুব বেশি আঘাত করতে পারবে না। মাব্রুকি আসলে বোকা হলেও বিশ্বস্ত। সে পরিচারক হিসাবে একেবারেই বাতিল, তবে মনে হয় কেরানি হিসেবে ভাল। প্রহরী হিসাবে সে অমূল্য, আর দ্বিতীয় দলনেতা বা ফান্ডি হিসাবে, যার কাজ দলছাড়াদের ধরে বেঁধে আনা, সে দুর্দান্ত। সে কুৎসিত ও গর্বিত, কিন্তু সে মোটেই কাপুরুষ নয়।
(ক্রমশ)