মুকনডোকওয়া উপত্যকা পেরিয়ে যাওয়ার পরপরই বার্টন একটি মালভূমিতে এসে পৌঁছিয়েছিলেন যার ‘‘শেষ প্রান্তটি পাথরের চাঁই এর মধ্যে দিয়ে তড়বড়িয়ে গিয়ে নেমেছে রুমুমা নদীর অববাহিকায় । এটা মুকনডোকওয়া নদীর একটা দক্ষিণের উপনদী, মুকনডোকওয়ারই একটা অংশ— রুমুমা জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমের পাহাড়ের জল বয়ে নিয়ে যায়। মুকনডোকওয়ার মূল ধারাটির অবশ্য জন্ম ওয়াহুম্বা বা ওয়ামুসাইয়ের উঁচু এলাকায়, সেখানকার জল বয়ে নিয়ে যায় পশ্চিমে।’’
বার্টন এবং স্পেকের পথের থেকে আমার পথ যেখানে আলাদা হয়ে গেছে, সেখান থেকে এগার মাইলও যেতে না যেতে একটি হ্রদ পেলাম। লেক উগোম্বো। চেহারায় ছোটখাট হলেও পূর্ব আফ্রিকার জলব্যবস্থায় এর একটা ছোট ভূমিকা আছে। মাত্র তিন মাইল দৈর্ঘ্যের এই ছোট্ট হ্রদটিতে রুমুমা এসে পড়ে আর একটা সরু খাদের মধ্যে দিয়ে সেই জল বেরিয়ে গিয়ে মুকনডোকওয়াতে পড়ে। 'মূলধারাটি ওয়াহুম্বা বা ওয়ামুসাইয়ের উঁচু এলাকার থেকে জন্মায়নি, অথবা এটি গোটা এলাকার জল পশ্চিমদিকে বয়ে নিয়ে যায় না' বরং এর উদ্ভব কেমা কাগুরু পর্বতমালার থেকে, উগোম্বোর অক্ষাংশের কমপক্ষে ১° উত্তরে। কিসাগরায় জায়গাটার নাম মুন্ডু। উরোংগা বা উলোংগা নদীরও জন্ম এখানেই।
রুমুমা ছাড়াও এই মুকনডোকওয়া নদীর অন্যান্য উপনদীর মধ্যে আছে রুফুটা, কিভিয়া-উদ্ভূত এমডুনকু, এমইয়োম্বো আর এমডুনয়ি।
যে দ্রাঘিমারেখা বরাবর রুবেহো পর্বতমালা, তার পশ্চিমের এলাকার জল অজস্র নালা দিয়ে বয়ে যায়। তবে এই বর্ষাহীন সময়ে সাধারণ শুষ্কতার জন্য সেই জল আর কোন নদীতে গিয়ে পড়ে না। অন্তত আমাদের চলার পথে তাই দেখেছি। উসাগারা পাহাড়ের ওপারের বা পশ্চিমের নিষ্ফলা এলাকা থেকে জল এসে এই সব নালা, বা শুকনো জলখাত, বা সুগভীর পার্বত্য নদীখাতে (যাকে আমরা আমেরিকাতে ‘গাল্চ’ বলি) এসে পড়ে আর নদীখাত সব জল শুষে নেয়। মুকনডোকওয়া নদী উসাগার পর্বতমালার মধ্য দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়, তারপর পূর্ব দিকে ঘুরে যায়— রুফুতা, রুমুমা, এমইয়োম্বো ও এমডুনয়ি ইত্যাদি সব উপনদীর বয়ে আনা জল নিয়ে গিয়ে পূর্বদিকের ভারত মহাসাগরে ফেলে।
উসাগার পশ্চিমে বৃষ্টিপাত এতই কম যে বালুকাময় নদীখাতগুলো কদাচিৎ রুফিজি নদীতে কোন জলের যোগান দেয়। উগোগির পশ্চিম দিক থেকে উন্যামওয়েজির তুরা পর্যন্ত জলনির্গমনের ঢাল দক্ষিণ দিকে, রুহওহা বা রুফিজি নদীতে গিয়ে সব জল পড়ে।
মারেঙ্গা এমকালির উত্তরাংশ, গোটা উগোগো এলাকা ও দক্ষিণ উহুম্বা বা উমাসাই, ইহাঙ্গে ও এমবোগওয়ে নিয়ে গঠিত এই বন্ধ্যা অঞ্চলের কোন জল নিষ্কাশনের পথ নেই। এই এলাকা জুড়ে রয়েছে অজস্র অগভীর জলাশয় বা ছোট হ্রদ, যেটুকু বৃষ্টি পড়ে তার জল সেখানেই জড়ো হয়। শুখা মরসুমে জল থেকে বাষ্প হয়, এবং অদম্য উত্তর-পূর্বের বর্ষা এই সকল জলাশয়ের জল নিয়ে গিয়ে ভিক্টোরিয়া এন’ইয়ানজা-র বিশাল জলাধারে ফেলে আর তারপর সেখান থেকে সেই জল চলে যায় নীল নদে। জল বাষ্পীভূত হয়ে গেলে, নুন বা নাইট্রেট অফ সোডার চাদরে ঢাকা এক বিস্তীর্ণ নিষ্ফলা জমি পড়ে থাকে। আঙ্গারুকা জেলায় চাগার Chaga পশ্চিমে যে জলাশয়গুলো দেখা যায়, কিকুই এর পশ্চিমের বালিবালির লবণাক্ত উপহ্রদ, এবং মিজানজার উত্তরে যে পুকুরগুলো আমি নিজেই দেখেছি, তারা সবাই অবশ্য এই তত্ত্বই প্রতিষ্ঠা করে।
উগোগো ছাড়িয়ে আসার পরে একমাত্র উল্লেখযোগ্য নদী হল এমডাবুরু ও মাবুনগুরু, যা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে কিউয়েহের ১ ডিগ্রি দক্ষিণে বয়ে চলা কিসিগোতে পড়েছে। কিউয়েহের গোগোরা বলেছিল যে এই নদীটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা আর খুব খরস্রোতা, জলহস্তী আর কুমিরে ভরা। কিসিগো গিয়ে পড়ে রুফিজিতে।
সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, উন্যানয়েম্বের উদ্দেশে আমাদের যে পদযাত্রা তার প্রথম পর্যায়টি ছিল কিঙ্গানির অববাহিকা জুড়ে; দ্বিতীয়পর্বে ওয়ামির অববাহিকা ধরে; তৃতীয় পর্বে ওয়ামির জলবিভাজিকা জুড়ে; চতুর্থ পর্যায়ে রুহওয়া অববাহিকার একদম উত্তরের অংশ পেরিয়ে, সে এক জলহীন অঞ্চল; আর পঞ্চম পর্বে, টাঙ্গানিকা হ্রদের জলবিভাজিকার সীমানা ধরে।
এবার, পাঠক জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ‘‘কি লাভ এই সবে— এই সব নদীর ক্লান্তিকর বিবরণ, আর এই সব অদ্ভুদ দুর্বোধ্য নাম!’’— খুব ভুল প্রশ্নও না!
সামান্য ধৈর্য ধরুন! পাঠক; ঠিক এই কথাতেই আমি এবার আসছি।
প্রথমত, আমার মনে হয়েছে যে ওয়ামি নদী বাণিজ্যের জন্য উপযুক্ত। একটা অগভীর তলদেশের স্টিমারের সাহায্যে, যা কিনা দু-তিন ফুট অবধি জলে ডোবে, সহজেই এই নদীপথ ধরে হুইন্ডে বন্দর থেকে উসাগারার এমবুমি পর্যন্ত ২ ডিগ্রি সরলরৈখিক দূরত্ব বা জলপথে প্রায় দু'শ মাইল চলাচল করা যাবে। পথের সকল বাধা - যেমন নদীর দুধারের ম্যানগ্রোভ গাছের বহু দূর ছড়ানো শাখাগুলো কোথাও কোথাও, বিশেষ করে কিগোঙ্গো গ্রামের কাছে, একে অপরকে জড়িয়ে মড়িয়ে একাক্কার - সেসব একটা কুড়ুল দিয়ে সহজেই কেটে সরানো যাবে।
উসাগারা পর্বতের পাদদেশ থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে এমবুমি। উসাগারা পাহাড় হল পূর্ব র্আফ্রিকার স্বাস্থ্যকর জায়গা। হুইন্ডে থেকে এমবুমির যা দূরত্ব তা সহজেই স্টিমারে দিন চারেকে পেরোন যাবে।
আফ্রিকাকে সভ্য করতে চান? হাতির দাঁত, চিনি, তুলা, অর্চিলা-উইড, নীল, আর এই দেশের বিবিধ শস্য পাওয়ার জন্য উসাগাড়া, ইউসেগুহহা, উকুটু, উহেহের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য করতে চান? এই একটা সুযোগ!
স্টিমারে মাত্র চার দিনের যাত্রা মিশনারিদের নিয়ে আসবে আফ্রিকার উঁচু, স্বাস্থ্যকর অঞ্চলে। কোন ভয় বা শঙ্কা ছাড়াই, এখানে তিনি ভদ্র সাগারাদের মধ্যে জীবন কাটাতে পারবেন; সভ্য সমাজের সুবিধাগুলোর থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ও নেই, তিনি সভ্যতার সকল সুবিধাই উপভোগ করতে পারবেন! আর পরিবেশখানাও অপূর্ব সুন্দর ও মনোরম, সে জায়গার সৌন্দর্য একমাত্র কবির কল্পনাতেই ধরা পড়ে। সতেজ শ্যামলিমা, বিশুদ্ধ জল; সুফলা উপত্যকা, তেঁতুল, মিমোসা, গাম -কোপালের জঙ্গল; বিশাল মিউভুল আর রাজকীয় এমপারামুসি, সুন্দর তালগাছ - একমাত্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় আকাশের তলাতেই এমন দৃশ্য দেখা যায়! স্বাস্থ্যকর জায়গা আর প্রচুর খাদ্যের সম্ভার মিশনারির জন্য নিশ্চিত! নির্বিরোধী মানুষের দল তার পদতলে প্রস্তুত তাকে স্বাগত জানাতে। একমাত্র সভ্য সমাজের সঙ্গ ছাড়া, মানুষ আর যা কিছু চায় তার কোন কিছুরই অভাব নেই!
কাদেতমারে গ্রামের আশেপাশে বেশ কিছু দারুণ মিশনের উপযুক্ত জায়গাও আছে। স্বাস্থ্যকর বাতাস, নাগালের মধ্যে প্রচুর জল, চারপাশের জমি অসম্ভব উর্বর, নিরীহ, সচ্চরিত্র মানুষ একে অপরের সঙ্গে, প্রতিবেশী ও অতিথিদের সঙ্গেও মিলেমিশে বাস করে সর্বত্র।
অলিম্পাসের গিরিপথ যেমন ওথমানের দলবলের কাছে পূর্বদেশের সাম্রাজ্যের দরজা খুলে দিয়েছিল; কুমায়লে ও সুরুর গিরিপথগুলো যেমন ব্রিটিশদের আবিসিনিয়ায় ঢোকার পথ করে দিয়েছিল— তেমনই মুকনডোকওয়ার গিরিপথ বর্বর আফ্রিকার হৃদয়ে বাইবেলের গল্প ও তার উপকারী প্রভাবের প্রবেশের পথ করে দিতে পারে।
কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি যে সাদা মানুষেরা এখানকার লোকদের 'মুলুঙ্গু' বা আকাশের দেবতার ভাষা শেখাচ্ছে, তাদের কিভাবে ফসল বপন করতে হয় বা ফসল কাটতে হয় বা বাড়ি বানাতে হয় তা শেখাচ্ছে , শেখাচ্ছে কিভাবে আরও স্বচ্ছন্দে থাকা যায়— মোদ্দা কথা, তাদের সভ্য করে তুলছে। আর পুরোন কাদেতমারের লোকরা সেই দেখে খুশিতে হাত ঘষছে। তবে কিনা সফল হতে গেলে, একজন নাবিককে যেমন দড়িদড়া সামলানো, পাল গোটানো থেকে হাল ধরা অবধি নৌকা চালানোর সব গুণই রপ্ত করতে হয়, মিশনারিকেও তেমন নিজের সব কাজেই পটু হবে। নরম-সরম মেয়েলি মানুষ হলে চলবে না, জার্নাল-লিখিয়ে বা ঝগড়ুটে তার্কিকও চলবে না, রেশমী-পোশাক-প্রিয় পাদ্রী হলেও হবে না— প্রভুর বাগানের একজন উদ্যমী পুরোদস্তুর শ্রমিক হতে হবে তাঁকে – যেন ডেভিড লিভিংস্টোন বা রবার্ট মোফ্যাটের ছাঁচে গড়া।
ওয়ামির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল অন্য নদীটি, রুফিজি বা রুহওহা যার নাম। এটা অনেকটা লম্বা একটা নদী , আর ওয়ামির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ জল নিয়ে গিয়ে ভারত মহাসাগরে ফেলে। উবেনার প্রায় একশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কয়েকটা পাহাড়ের মধ্য থেকে এর জন্ম। পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ৩৫ ডিগ্রির কাছেপিঠে রুহওহার সবচেয়ে উত্তরের ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপনদী কিসিগোর মূল নদীতে মেশার কথা। সমুদ্রসঙ্গম থেকে ধরলে, রুহওহার দৈর্ঘ্য সরাসরি চার দ্রাঘিমাংশ। এই তথ্য নদীটার গুরুত্ব ও পূর্ব আফ্রিকার নদীগুলির মধ্যে এর স্থান বুঝিয়ে দেয়। এর সম্বন্ধে খুব কমই জানা যায়। তবে এইটুকু বলা যায় যে এই নদীতে প্রায় ৬০ মাইল বা আটটি জোয়ার অবধি ছোট নৌকা চলতে পারে; বেনিয়ারা এই দূরত্ব অবধি নদীপথে বাণিজ্য করে, আর তীরবর্তী উপজাতিদের থেকে হাতির দাঁত সংগ্রহ করে।
ক্রমশ…