ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনি। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে এক আফ্রিকান গোষ্ঠীর বিরুদ্ধ যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা। তরজমায় স্বাতী রায়
২৯ তারিখ সকালে পঞ্চাশ জন লোকের মাথায় কাপড়ের গাঁটরি, পুঁতি ও তার চাপিয়ে উজিজির জন্য তৈরি হলাম। যখন তারা আমার ঘরের বাইরে যাত্রার জন্য জড়ো হল, তখন একমাত্র বোম্বে অনুপস্থিত। তাকে খুঁজতে লোক পাঠানো হল, সেই সুযোগে অন্যরাও পালাল তাদের কালো ডিলাইলাদের আরও একবার দেখতে, আরও একটিবার জড়িয়ে ধরতে। দুপুর দুটো নাগাদ বোম্বেকে পাওয়া গেল। যে আবেগের বশবর্তী হয়ে সে চলছে, তার ছাপ তার চোখেমুখে স্পষ্ট। উন্যানয়েম্বের দেহ-পসারিণীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দুঃখে, তার তাবোরার ডুলসিনিয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার শোকে, সব আমোদ-আহ্লাদ থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখে সে কাতর- এরপর হাঁটা ছাড়া আর কিছু নেই, কঠিন, লম্বা হাঁটা- তারপর যুদ্ধ- হয়ত মরতেও হতে পারে! এইসব সাত পাঁচ ভেবেই বোম্বের তখন ভারি ঝগড়ুটে মেজাজ- তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বোম্বেকে তার জায়গায় গিয়ে দাঁড়ানোর হুকুম দিলাম। এদিকে সকাল দশটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্য আমার নিজের মেজাজও তখন ভয়ঙ্কর খারাপ। বোম্বের মুখ দিয়ে একটা শুধু শব্দ বেরোল আর সে একবার প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে আমার বেত বোম্বের কাঁধের চারপাশ দিয়ে উড়ে বেড়াতে লাগল, যেন তাকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলা হবে। মনে হয় যে আমার প্রচণ্ড আক্রমণের পিছনে যে দুরন্ত ক্রোধ ছিল, অন্য কোন কিছুর থেকে সেটাই তার গোঁয়ার্তুমিকে ভেঙে দিয়েছিল; তাকে এক ডজন চাবুক মারার আগেই সে ‘ক্ষমা’ চেয়ে কাঁদছিল। ক্ষমার কথা শুনে আমি মারা থামালাম, কারণ এই প্রথমবার সে এই শব্দটা উচ্চারণ করল। শেষ পর্যন্ত বোম্বে বশীভূত হল।
‘চলো!’ বলে হাঁক পেরেই গাইড আগে চলতে শুরু করল, তার পিছনে পিছনে গম্ভীরভাবে সার বেঁধে চলছে তার অনুগামী উনপঞ্চাশ জনের দলটা। প্রত্যেকে নিজের নিজের বন্দুক, হ্যাচেট , গোলাবারুদের থলি আর উগালি রাঁধার পাত্র ছাড়াও বইছে আফ্রিকান অর্থের একটা ভারী বোঝা। চুপচাপ সুশৃঙ্খলভাবে সবাই পথ হাঁটছে- বেশ একটা সম্ভ্রম জাগানো দৃশ্য, তীব্র ঈশানী ঝড় আমাদের দলের পাশ দিয়ে বইছে আর সেই ঝড়ে আমাদের পতাকা উড়ছে আর লোকদের লাল চাদরের পোশাকও তাদের পিছনদিকে উড়ছে।
দলের লোকদেরও মনে হচ্ছিল যে তারা দেখার যোগ্য, কারণ লক্ষ্য করলাম যে বেশ কয়েকজন আরও বেশি বেশি যোদ্ধা সুলভভাবে হাঁটছে- তাদের রাজকীয় জোহো পোশাক হাওয়ায় পিছন দিকে উড়ছে আর তাদের গলায় টান পড়ছে। মাগাঙ্গা নামের এক লম্বা ন্যামওয়েজি, এমন ভাবে হাঁটছিল যেন সে মিরাম্বো আর তার হাজার যোদ্ধাদের সঙ্গে একাই গোলিয়াথের মতো যুদ্ধ করবে। চঞ্চল খামিসি মাথায় বোঝা নিয়ে সিংহের মত হাবভাব করতে করতে এগোচ্ছে , আর ওই এক অসভ্য ভাঁড় - অদম্য উলিমেনগো - বিড়ালের মতো চুপিসারে চলছে। তবে কিনা কতক্ষণ আর চুপ করে থাকবে! তাদের অহংকার বেশ চরিতার্থ হয়েছিল, লাল চাদরগুলো তাদের চোখের সামনে এমন নেচেই যাচ্ছিল যে তারা আরও আধ-ঘণ্টা অত গুরুগম্ভীর ভাব ধরে রাখতে পারলে সেটাই আশ্চর্য ব্যাপার হত।
উলিমেনগোই প্রথম নীরবতা ভাঙল। সে নিজেকে কিরণগোজি বা পথপ্রদর্শক হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছিল আর সে-ই আমেরিকার পতাকা বইত, সবাই ভেবেছিল শত্রুর হৃদয়ে অবশ্যই সে পতাকা ভয়ের জন্ম দেবে। প্রথমে তার বেশ আত্মবিশ্বাস বাড়ল, তারপর তার একটু সাহস বাড়ল, তারপর উল্লসিত হয়ে সে হঠাৎ তার নেতৃত্বাধীন সেনাদের দিকে ফিরে দাঁড়াল আর চেঁচিয়ে উঠল-