ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালার শেষ পর্যায়। তরজমা স্বাতী রায়
মিঃ নিউ এর থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ বিদায় নিলাম। তাঁর মহৎ, উচ্চ মার্গের পেশাযাপনের নিরিখে তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে আমার ধারণা উচ্চ। বন্ধুত্বপূর্ণ, সমালোচনার মাধ্যমে তাঁর ছোটখাটো ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিলে নিশ্চয় তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন। উপরের চিঠি থেকে পাঠক ঠিকই বুঝবেন যে ডসন, হেন এবং নিউ-এর সম্পর্ক বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, জাঞ্জিবারে বর্তমান খবরাখবর থেকে যে কোন অপরিচিত লোক ধারণা করবেন যে এই তিনজন ভদ্রলোক পরস্পরের দিকে ছুরি উঁচিয়েই আছেন। তবে এসব আপাত বিরোধ, উপরিতলের ঝামেলা, কোনও গভীর শত্রুতা নয়। সত্যিকারের ঝগড়া হওয়ার মতন সময় তখনও আসেনি। যখন তারা সবাই একজন নিশ্চিত, শক্ত নেতার অধীনে একত্রিত, তখন তুচ্ছ বিদ্বেষগুলোও নিষ্ক্রিয় হয়ে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু, যেই না তাদের নেতা লেঃ ডসন অবসর নিলেন, অমনি ঈর্ষা-বিষ জেগে উঠল। মিঃ ডসনের একটি প্রশ্নই গোটা ব্যাপারটা উস্কে দিয়েছিল। ডসন যখন ত্রাণের প্রয়োজন হলে, নিউ নেতৃত্বভার নিতে রাজি হবেন কিনা জানতে চেয়েছিলেন, তখনই এই বিষ-চারার জন্ম। মিস্টার নিউ নেতৃত্বের কথা বিবেচনা করবেন বলে বলেছিলেন; কিন্তু আমাদের এও মনে রাখতে হবে যে মিঃ হেনও আসলে তাই চেয়েছিলেন আর তিনি যখন অভিযানের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন সেও না ভেবে চিন্তে বলা মুখের কথা। কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে তিনি তখনও পৌঁছাননি। দুই দিন ধরে ভাবার পরে , মিঃ নিউ নিজেকে "নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্তুত" বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু, ঠিক এই একই সন্ধিক্ষণে, মিঃ হেনও ত্রাণ অভিযানের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার বাবদে তার সংকল্প প্রকাশ করেছেন; আর, যেহেতু তিনি সহকারী নেতা ছিলেন, তাই সেই অধিকার খুশিমত প্রকাশ করা বা ছাড়া তাঁর এক্তিয়ারেই পরে। আর অনেকেই নিজ নিজ চুক্তিমত তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। অন্য পক্ষে মিঃ নিউ নিজ বক্তব্য অনুসারে পদত্যাগ করেন। অজুহাত হিসাবে তিনি বলেছেন যে "অভিযানটি আর আগের মত ছিল না;" কিন্তু তিনি যখন বলেন যে এর গঠন বদলে গেছে, তখন তিনি অসঙ্গতিপূর্ণ কথার দিকে ঝুঁকেছেন। অভিযানের সাবেক নেতা অবসর নিয়েছিলেন তা সত্যি; কিন্তু, তার নিজের ভাষ্য অনুসারে, তিনি লেঃ ডসন দুর্ঘটনার দরুণ কার্যোক্ষম হয়ে পড়লে লেঃ হেনকে মান্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমার উপস্থিতির মত "দুর্ঘটনা"র থেকে কম কিছু ঘটেনি। আর লেঃ ডসন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে নিজেকে অক্ষম প্রমাণ করেছিলেন, স্বেচ্ছায় নেতৃত্বদানের ক্ষমতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছিলেন; অতএব, লেঃ হেনেরই নেতা হওয়ার অধিকার। আর মিস্টার চার্লস নিউ তাকে মানতে বাধ্য ছিলেন। "দুর্ঘটনার কারণে যদি লেঃ ডসন নেতৃত্বদানে অক্ষম হন, আমি লেঃ হেনকে অভিযানের নেতা হিসেবে মেনে নিতে ও তাঁর অধীনে কাজ করতে রাজি।" এই চুক্তিতে আদি পরিকল্পনার কোন উল্লেখ নেই। মিঃ নিউ আরও জুড়েছেন যে, এটা একটা উন্যানয়েম্বে যাওয়া-আসার "তুলনামূলক নগণ্য ট্রিপ হয়ে দাঁড়িয়েছে , যেকোন দু'জন সাধারণ রকমের প্রকৃত আগ্রহী লোক, উপযুক্ত মনের জোর ও অধ্যবসায় থাকলেই সম্পন্ন করতে পারবে।" আমি এবিষয়ে একমত। দুজনও নয়, একজন হলেই কাজ চলবে; আর দুজন পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া করা লোকের জায়গায় একাই অনেক ভালোভাবে কাজটা শেষ করতে পারবে। তবে এই অভিযানের তুলনামূলক তুচ্ছতা সম্পর্কে আমি তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত। আমি বলব যে একটি অভিজ্ঞ দলকে নিয়ে উন্যানয়েম্বে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার চাইতে একটা অনভিজ্ঞ দলের পক্ষে কাফেলাসহ উন্যানয়েম্বে অবধি যাওয়ার কাজটা অনেকটাই বেশি কঠিন । দল যতক্ষণে উন্যানয়েম্বে পৌঁছাবে, ততদিনে তারা অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে আর তার পরের যাত্রাগুলোর সঙ্গে এক নতুন জায়গায় প্রথম পা রাখার অভিজ্ঞতার কোন তুলনাই হবে না। অন্তত, আমি তো সেরকমই দেখেছি। কাফেলা নিয়ে উন্যানয়েম্বে যেতে যা ঝামেলা হয়েছে, অন্য সব যাত্রার সব কষ্ট একসঙ্গে জুড়লেও তত কষ্ট হবে না। প্রথম ভাগের হাঁটার সময় যে অভিজ্ঞতা আমি অর্জন করেছি তাই দিয়ে আমি অন্যান্য সব যাত্রা সহজে দ্রুত সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছি। একটি অনভিজ্ঞ দলের কাছেও একজন আফ্রিকান অভিযাত্রী হিসেবে মিঃ চার্লস নিউ-এর অভিজ্ঞতার যা দাম, সেটা কেবল উপকূল থেকে উন্যানয়েম্বে অবধিই। উন্যানয়েম্বে ছাড়িয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তার নেই।
উন্যানয়েম্বে পৌঁছানোর পর, বলা যায় যে লেঃ হেন ও মিস্টার লিভিংস্টোন মিস্টার নিউকে ছাড়াই যে কোনো দিকে কাফেলা নিয়ে যেতে পারতেন। হাঁটার সময়ের অভিজ্ঞতার থেকে পাওয়া শিক্ষার জোরে তাঁকে তাঁরা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করতে পারত। না; বলা উচিত যে যদি মিস্টার নিউ, "সামান্য দ্বিধার অন্তে" দলকে তাঁর অভিজ্ঞতার সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ডসনের মতন লোকের নেতৃত্বে দলে যোগ দিতে রাজি হলেন, আর ডসন অবসর নেওয়ার পরে তাঁর মনে হল যে হেন দায়িত্ব পালনে অক্ষম, তাহলে তো তাঁর নিজ অভিজ্ঞতা দিয়ে হেন ও লিভিংস্টোনকে সাহায্য করাই উচিত ছিল, যতক্ষণ না তাঁরা তাঁকে ছাড়া অভিযান চালাতে শিখে উঠতে না পারে; তারপর মিস্টার নিউ নিজের ইচ্ছামত সসম্মানে অবসরে যেতেন নাহয়। সকল সঠিক-ভাবনার লোকজন এমনটাই ভাববে।
শিকার তো আর অভিযানের আসল লক্ষ্য নয়। অভিযানের মূল উদ্দেশ্যের প্রতি নিবিষ্ট হয়ে অনুগতভাবে হেনকে অনুসরণ করা, পরামর্শ দেওয়া ও উৎসাহ দেওয়াই মিস্টার নিউয়ের দায়িত্ব ছিল। অভিযানের প্রতি সেই দায়িত্ব পালনেই তাঁরা সকলে অঙ্গীকার করেছিলেন। হেনের প্রধান উদ্দেশ্য যদিবা হাতি ও মোষ শিকার করাও হয়, তবু সে কারণে মিস্টার নিউ নিজের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন না। লেফটেন্যান্ট হেন স্বভাবত অস্থিরমতি; তবে তাঁর উদ্দেশ্য শিকার করা হলেও তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য বাগামোয়োতে গিয়ে বেশি চারিত্রিক সঙ্গতির প্রমাণ দেখিয়েছিলেন। মিস্টার নিউ, কিন্তু বাগামোয়ো ছেড়ে যাওয়ার পর আর নিজের পূর্বদায়িত্বে ফিরে আসেননি। বরং নিজের পদ থেকে ইস্তফা দেন। তারপর আবার সাহায্যের প্রস্তাব দিয়ে পরে ফের প্রত্যাহার করেন। তার একমাত্র কারণ হল যে হেন না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে তাকে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল আর হেন আবার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, খানিকটা তাঁর স্বাভাবিক অধিকার হিসেবেই নেতৃত্বভার তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল। রেভারেন্ড চার্লস নিউকে নয়। মিঃ নিউয়ের স্বীয় বক্তব্য অনুসারে নেতার পদটি যতই লোভনীয় হোক না কেন, তাঁর উচিত ছিল হেনের অধীনে অভিযানে অংশগ্রহণ করা। সেরকমই তিনি শপথ নিয়েছিলেন। তারপর, হেন যদি ডাঃ কার্কের ভবিষ্যদ্বাণীটি সত্যি প্রমাণ করত, তখন তিনি সসম্মানে নেতৃত্বের আসনে বসতে পারতেন।
এই "কিভাবে কাজ করতে নেই" নামের ক্ষুদ্র হাস্যনাটিকায় মিস্টার নিউয়ের ভূমিকা যদিও মোটেই ঈর্ষণীয় নয়, প্রথম পর্বে তিনি কিন্তু খানিকটা নায়কোচিত ঔজ্জ্বল্য দেখিয়েছেন। একজন সৎ, আন্তরিক ও সাহসী হৃদয়ের মানুষ হিসেবে আমি তাঁকে যথেষ্ট সম্মানও করি। নয় বছর আফ্রিকায় থাকার পরে, তিনি যখন স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য ইংল্যান্ডে ফিরছেন, ফেরার ঠিক আগে তাঁর কাছে অনুবাদক হিসেবে এই ইংরেজ খোঁজ অভিযানের সঙ্গে যোগ দেওয়ার অনুরোধ যায়। সামান্য দ্বিধার পরে তিনি কিন্তু পূর্ণ সহযোগিতা করেন। নিজের পূর্ণ সামর্থ্য দিয়ে গুটিকতক ইংরেরেজের এই সহৃদয় কর্মটিকে লক্ষ্যপূরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যতক্ষণ না তিনি আমার লোকদের থেকে শুনেছেন যে লিভিংস্টোনকে খুঁজে পাওয়া গেছে ও তাঁকে রসদ জোগানো হয়েছে, ততদিন অবধি তিনি পুরোদমে কাজ করেছেন। জাঞ্জিবার থেকে মোম্বাসা গিয়ে অভিযানের প্রহরী হিসেবে কাজ করার জন্য কুড়িজন সৈন্য নিয়ে এসেছেন। তাঁর কর্মনিষ্ঠা ও আনুগত্য দিয়ে তিনি সকলের মন জয় করেছেন। জাঞ্জিবারের ইউরোপিয়ানরা তাঁর সম্বন্ধে খুব ভাল ধারণা পোষণ করে। আর তাঁরা সকলেই একমত যে আমি উপকূলে ফিরে না এলে তিনি খুবই সুষ্ঠুভাবে এই বিশাল ও ব্যয়সাপেক্ষ অভিযান চালনা করতেন। একথাও নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে তাঁর উৎসাহী স্বভাব ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে তিনি এই কাজের জন্য একদম সঠিক রকমের যোগ্য।
কিন্তু এই দলের গঠনের একটা বড় দোষ ছিল যে এতজন পরস্পর বিরোধী চরিত্রের মানুষকে এই অভিযান একসুতোয় বাঁধার চেষ্টা করেছিল। একজন সদস্যেরও স্বভাবগতভাবে অন্য কারোর সঙ্গে মিল নেই। একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ইতিবাচক মানসিকতার, সেইসঙ্গে ধৈর্যহীন ও আক্রমণাত্মক স্বভাবের। আরেকজন অস্থিরমতি, আবেগী, অসঙ্গতিপূর্ণ চরিত্রের । আরেকজন সহজে বিচলিত , উদ্যমী, ধার্মিক আর বড়ই ঠোঁটকাটা; অন্যজন বিনয়ী, আন্তরিক ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। নিউ আর লিভিংস্টোন যথেষ্ট ভালভাবেই সফল হতেন। ডসন, একাই একশ। হেনকে একা দায়িত্ব দিলে সসম্মানে নিজের দায়িত্ব পালন করতেন, কারণ সাহস ও কর্তব্যপরায়ণতা তাঁর চরিত্রের দুটি প্রধান উপাদান। কিন্তু সকলে মিলেজুলে একত্রে কাজ করতে হলে যে সমন্বয়ের উপাদানগুলির প্রয়োজন, তাঁদের তিনজনের মধ্যেই তার বড় অভাব। ঝগড়া বাঁধলে একজন কোনপক্ষেই যোগ দেবে না, শুধু দলাদলির নির্লিপ্ত সাক্ষী হয়ে থাকবে । তারা একত্রে অভিযানে গেলে দলে নিশ্চয়ই ঝগড়া হতো; আর মোটেও না যাওয়ার চেয়ে সেটা আরও খারাপই হত। তাই ইংরেজদের সম্মানের কাছে আমার আগমন সৌভাগ্যের বিষয়। আমার উপকূলে এসে পৌঁছানো তাদের অভিযানকে আগেই ভেঙ্গে যেতে সাহায্য করেছিল আর দেশের ভিতরে গিয়ে দল ভেঙ্গে যাওয়ার বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়েছিল।
ক্রমশ…