ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে লিভিংস্টোনের কাছাকাছি থাকার সম্ভাবনার খবর। তরজমা স্বাতী রায়
৩ নভেম্বর। এই তিন দিনে আমরা যে কোন রকম বিবাদের সাক্ষী হইনি?! উভিনজায় পা রাখার পর থেকে এমন কোন উদ্বেগ আছে কী যাতে আমরা ভুগিনি?! ভিনজারা গোগোদের থেকেও খারাপ, আর তাদের লোভ মেটে না কিছুতেই। গাধাটাকে পার করানোর জন্য একজন এমগাঙ্গা বা ওঝার সাহায্য পেয়েছিলাম। সে নদীর কাছেই গজানো একটা গাছের পাতা খানিকটা চিবিয়ে মুখের থেকে বার করে গাধাটার গায়ে লাগিয়ে দিল। আমাকে বলল যে এই চিবানো পাতা গায়ে ঘষে সে যে কোনও সময়, দিনে বা রাতে নদী পেরিয়ে যায়- এটা খুবই কাজের ওষুধ বলে তার বিশ্বাস।
সকাল ১০টা নাগাদ উজিজির দিক থেকে আশিজন গুহহার একটা কাফেলা এসে হাজির হয়েছিল। এই উপজাতির লোকেরা টাঙ্গানিকা হ্রদের দক্ষিণ-পশ্চিমের একটা এলাকায় থাকে। আমরা খবর জানতে চাইলাম, শুনলাম যে একজন শ্বেতাঙ্গ লোক সদ্য মান্যুয়েমা থেকে উজিজিতে এসেছেন। খবরটা শুনে আমরা সবাই চমকে উঠলাম।
একজন সাদা মানুষ?' আমরা জিজ্ঞেস করলাম। ‘হ্যাঁ, একজন সাদা মানুষ,’ তারা উত্তর দিল। ‘পরনে কেমন পোশাক?’ ‘কর্তারই মত,’ আমাকে দেখিয়ে বলল.. ‘জোয়ান, নাকি বুড়ো?’ ‘বুড়ো, সাদা দাড়ি, আর অসুস্থ।’
‘কোথা থেকে এসেছেন?’
‘উগুহহা ছাড়িয়ে অনেক দূরের দেশ থেকে, জায়গাটার নাম মা ন্যুয়েমা।’
‘আচ্ছা! তিনি কি এখনও উজিজিতে আছেন?’
‘হ্যাঁ, আমরা তাঁকে প্রায় আট দিন আগে দেখেছি।’
‘কি মনে হয়, আমাদের সঙ্গে দেখা না হওয়া অবধি তিনি কি সেখানেই থাকবেন?’
‘সিজোই (জানি না)’।
‘তিনি কি আগে কখনো উজিজিতে এসেছিলেন?’
‘হ্যাঁ, অনেকদিন আগেই চলে গিয়েছেন।’
হুররে! এই তো লিভিংস্টোন! নিশ্চয়ই লিভিংস্টোন! আর কেউ হতেই পারে না; তবে কিনা - অন্য কেউ হতেও তো পারে - পশ্চিম উপকূলের থেকে আগত কেউ - বা হয়তো তিনি বেকার! উঁহু; বেকারের মুখে তো সাদা দাড়ি নেই। কিন্তু এবার আমাদের দ্রুত এগোতে হবে, পাছে আমরা আসছি শুনে তিনি আবার পালিয়ে যান।
দলের সবাইকে ডেকে বললাম, একটুও না থেমেই তারা উজিজির উদ্দেশে যাত্রা করতে রাজি কিনা, আর তারপর তাদের প্রতিশ্রুতি দিলাম যে, যদি তারা আমার কথায় রাজি হয় তো তারা প্রত্যেককে দু ডটি করে কাপড় দেওয়া হবে। সবাই হ্যাঁ বলল, তারাও সকলে আমার মতোই খুশি। তবে আমি একেবারে খুশিতে পাগল হয়ে গেছি, তীব্ররকমের উৎসুক এই জ্বলন্ত প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য , ‘ইনিই কি ডাঃ ডেভিড লিভিংস্টোন?’ হে ভগবান আমাকে ধৈর্য দাও, এখানে যদি একটা রেলপথ, বা, নিদেনপক্ষে ঘোড়াও থাকত। তাহলে ঘোড়া ছুটিয়ে আমি ঘণ্টা বারো সময়ের মধ্যে উজিজিতে পৌঁছিয়ে যেতাম।
তখনই মালাগারাজির তীর থেকে রওনা হলাম, উসেঙ্গে, সেই ফেরিঘাটের বুড়োর দেওয়া দু'জন পথপ্রদর্শক রয়েছে আমাদের সঙ্গে। নদী পারের পর্ব শেষ হয়ে হওয়ার পর সে যেন আমাদের প্রতি একটু বেশি সদয় হয়েছে । প্রায় একঘণ্টা একটা লবণাক্ত সমভূমির উপর দিয়ে হেঁটে আমরা সুলতান কাটা লাম্বুলার ইসিঙ্গা গ্রামে পৌঁছলাম, আমরা যতই ভিতর দিকে এগোচ্ছি, সেই লোনা মাটির এলাকা ততই উর্বর, সুফলা হয়ে উঠছে। শিবির তৈরির পরে আমাদের সতর্ক করে দেওয়া হল যে আগামীকালের পথ সাবধানে চলতে হবে। এনযোগেরার এক বড় সর্দার মাকুম্বির অধীনে ভিনজাদের একটা দল যুদ্ধ থেকে ফিরে আসছিল। মাকুম্বির রীতি ছিল জয়ের পরে সেখানে আর কিছুই না রেখে আসা। জয়ের নেশায়, সে এমনকি তার নিজের উপজাতির গ্রামগুলোতেও আক্রমণ করেছিল, জীবিত সবকিছু, দাস ও গবাদি পশু সব কিছুই ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। লোকান্দা-মীরার বিরুদ্ধে এক মাস ব্যাপী অভিযানের ফল হল দুটো বিধ্বস্ত গ্রাম, এক গ্রামের সর্দারের বাচ্চাদের একজনকে মেরে ফেলা, আরও বেশ কয়েকজনকে মারা; মাকুম্বিও অবশ্য মালাগারাজির দক্ষিণের একটা লবণাক্ত মরুভূমি পেরনোর সময় তার দলের তৃষ্ণার্ত পাঁচজনকে হারিয়েছে।
৪ নভেম্বর। ভোর ভোর খুব সাবধানে একদম চুপচাপ আমরা রওনা দিলাম। গাইডদের আগেই পাঠানো হয়েছে, একজন আরেক জনের থেকে প্রায় দুশো গজ সামনে, যাতে আমরা সময়মত সতর্ক হতে পারি। একটা ছোট ছোট গাছের পাতলা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শুরুর দিকটা গেলাম, জঙ্গল পাতলা থেকে আরও পাতলা হতে হতে শেষ পর্যন্ত একদম গোটাগুটি অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরা উহহাতে পৌঁছলাম। একটা সমতল দেশ। দৌরা ও ভুট্টার লম্বা রোদ-জ্বলা ডাঁটির ফাঁক দিয়ে অনেক অনেক গ্রাম দেখা যাচ্ছে। কখনও তিন, কখনও পাঁচ, দশ বা বিশটা মৌচাকের আকৃতির কুঁড়েঘর মিলে একটা গ্রাম। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে হাহারা নিটোল নিরাপত্তায় অভ্যস্ত। কারণ আফ্রিকান গ্রামের চারপাশে প্রথামাফিক যেরকম সুরক্ষার বেড়া থাকে, তাদের একটা গ্রামেও তেমন ছিল না। উহহা আর উভিঞ্জার মধ্যে শুধু একটা সরু শুকনো খাদের সীমানা। উহহাতে প্রবেশ করার পরে আর মাকুম্বির ভয় নেই।
আমরা কাওয়াঙ্গায় থামলাম, এখানকার সর্দার একটুও সময় নষ্ট না করে আমাদের বোঝাতে বসল যে সে হল রাজার অধীনে কিমেন্যির সবথেকে বড় সর্দার। আর সেই কিহা রাজাদের জন্য উপঢৌকন সংগ্রহ করে। সে ঘোষণা করল যে উহহার পূর্বদিকের গোটা এলাকায়, অর্থাৎ কিমেন্যিতে সেই একমাত্র লোক যে নজরানা আদায় করতে পারে; আর এটা তার পক্ষেও সুবিধার, আর আমাদের জন্যও ঝামেলা হীন হবে , যদি আমরা এখনই তার বারোটা ভালো কাপড়ের দাবি মিটিয়ে দিই। স্থানীয় আফ্রিকানদের চরিত্র ভালই বুঝে গেছি। কাজেই সামনে এগোনর পন্থা হিসেবে এটা মোটেই আমাদের সব থেকে ভাল রাস্তা বলে মনে হল না। তাই আমরা তখনই পরিমাণ কমানোর জন্য দরাদরি করতে শুরু করলাম; কিন্তু, ছয় ঘণ্টা ধরে গরম গরম ঝগড়ার পরে, সর্দার মাত্র দুই ডটি কমাল । তখন দাবি মেনে নেওয়া হল, এই রকম বোঝাপড়া হল যে উহহার মধ্যে দিয়ে রুসুগি নদী পর্যন্ত আমরা আর কোনরকম খেসারৎ না দিয়েই চলে যেতে পারব।
৫ নভেম্বর। খুব ভোরে কাওয়াঙ্গা ছেড়ে বেরলাম। অসীম সমতলের উপর দিয়ে হাঁটছি। জায়গাটা যেন উত্তপ্ত নিরক্ষীয় সূর্যের তেজে সাদা হয়ে গেছে, আমরা পশ্চিম দিকে যাচ্ছি, মন আশায়, আনন্দে ভরপুর। এইবার বুঝি আমাদের কষ্টের শেষ হবে! মনের আনন্দে নিজেরাই নিজেদের অভিনন্দন জানাচ্ছি যে আর মাত্র পাঁচদিনের মধ্যেই যা দেখার জন্য সভ্যতা থেকে এত দূরে, হরেক অসুবিধা পুইয়ে আসা, তা দেখতে পাব। একদল গ্রাম পেরিয়ে চলে যাচ্ছিলাম প্রায়, কারোর আর কোন দাবি দাওয়া নেই বা কেউ কিছু বলতে পারবে না এটা জানা থাকলে মানুষ যেমনটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে থাকে, আমরাও তেমন যাচ্ছিলাম। গ্রামের মানুষরা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ দেখি দুজন লোক ওই ভিড়ের থেকে বেরিয়ে অভিযানের মাথার দিকে ছুটে যাচ্ছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে যে তারা কাফেলাকে আর এগোতে দেবে না ।
কাফেলা থেমে গেল, আর আমি এগিয়ে গেলাম। দুই স্থানীয়ের থেকে কার্যকারণ বোঝার জন্য। দুই হাহা আমাকে নম্র ভাবে সম্ভাষণ জানাল, চিরাচরিত ‘ইয়াম্বোস’ বলে। আর তারপর জানতে চাইল, ‘উহহার রাজাকে সেলাম না ঠুকেই আর কোন নজরানা না দিয়েই সাদা-মানুষ কেন গ্রামের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছেন? সাদা মানুষ কি জানেন না যে এখানে উহহার রাজা থাকেন, এনগোয়ানা ও আরবরা যাওয়ার অনুমতি নেওয়ার জন্য তাকে সর্বদা কিছু না কিছু ভেট দেয়?’
‘কেন, আমরা তো গতরাতে কাওয়াঙ্গার সর্দারকে ভেট দিয়েছি, সে তো আমাদের বলেছে যে তাকেই উহহার রাজা টোল আদায়ের দায়িত্ব দিয়েছে।’
‘কত দিয়েছেন?’
‘দশ ডটি ভাল কাপড়।’
‘ঠিক?’
‘একদম ঠিক। তাকে জিজ্ঞেস কর, সেও তাই বলবে।’
‘বেশ’, হাহাদের একজন , এক সুন্দর, সুদর্শন, বুদ্ধিমান চেহারার যুবক বললো, ‘এর সত্যতা যাচাই না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে এখানে আটকে রাখা রাজার প্রতি আমাদের কর্তব্য। আপনি কি আমাদের গ্রাম অবধি হেঁটে যাবেন ও আমাদের গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করবেন যতক্ষণ না আমরা কাওয়াঙ্গায় বার্তাবাহক পাঠাতে পারি?’
‘না; সূর্য মাত্র এক ঘণ্টা উঠেছে, আমাদের অনেক দূর যেতে হবে; তবে, আমরা যে সঠিক কর্ম না করে তোমাদের দেশের মধ্যে দিয়ে চলে যেতে চাই না সেটা তোমাদের দেখানোর জন্যই আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানেই আমরা বিশ্রাম নেব, আর তোমাদের দূতের সঙ্গে আমাদের দুজন সৈন্য পাঠাব, যারা তোমাদের দেখিয়ে দেবে যে কাকে আমরা কাপড় দিয়েছি।’
খবর আনতে লোক গেল। তবে, তারমধ্যেই, ওই সুদর্শন ছেলেটা, জানা গেল সে রাজার ভাইপো, একটা ছেলেকে কিছু আদেশ দিল, সে অবিলম্বে হরিণের গতিতে দ্রুত যে গ্রামগুলি আমরা সবে পেরিয়ে এসেছি সেদিকে ছুট লাগাল। এই সামান্য কাজের ফল হল এই যে, অল্প সময়ের মধ্যেই দেখলাম, প্রায় পঞ্চাশ জন যোদ্ধার একটা দল এসে হাজির হল। তাদের নেতৃত্বে একজন লম্বা, সুদর্শন পুরুষ। জোহো নামের একটা গাঢ় লাল রঙের পোশাক তার পরনে, কাপড়ের দুই প্রান্ত বাম কাঁধে একটা গিঁট দিয়ে বাঁধা। একটা নতুন আমেরিকান কাপড়ের টুকরো ভাঁজ করে বানানো পাগড়ির মত একটা জিনিস তার মাথায়, আর একটা পালিশ করা হাতির দাঁতের বড় বাঁকা টুকরো তার গলার থেকে ঝুলছে। সে ও তার দলের সকলেরই সঙ্গে রয়েছে বর্শা, তীর-ধনুক। আর তারা এমন ধীর ভাবে এগিয়ে এলো যেন যে কোনোরকম সমস্যাই হোক না কেন, তা সামলানোর মতন আত্মবিশ্বাস তাদের আছে ।
পম্বওয়ের স্রোতের পূর্ব দিকে আমাদের থামানো হয়েছিল। উহহার কিমেন্যির লুকোমো গ্রামের কাছেই।
চমৎকার পোশাক-পরা সর্দারটি দেখতে অসাধারণ। ডিম্বাকৃতি মুখ, উঁচু হনু, গর্তে ঢোকা চোখ, একটি লক্ষণীয় রকমের উঁচু কপাল, সুন্দর নাক আর বেশ সুন্দর গড়নের মুখ; লম্বা চেহারা আর পুরোপুরি প্রতিসম।
আমাদের কাছে এসে পৌঁছালে সে আমাকে এই শব্দে অভিনন্দন জানাল, ‘ইয়াম্বো, বানা? - কেমন আছেন, কর্তা?’
আমিও আন্তরিকভাবে উত্তর দিলাম, ‘ইয়াম্বো, মুটওয়ার? - কেমন আছ, সর্দার?’
আমি নিজে ও আমার দলের সবাই , তার যোদ্ধাদের সঙ্গে সৌজন্যালাপ সারলাম; সেই মোলাকাত যে আদৌ বিদ্বেষমূলক, প্রথম পরিচয়ে সেরকম কোন ইঙ্গিতই ছিল না।
সর্দার গোড়ালির উপর নিতম্ব রেখে বসল, তীর-ধনুক পাশে নামিয়ে রাখল, তার দলের লোকেরাও তাই করল ৷
(ক্রমশ...)