ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। এ পর্বে উরিম্বা জেলা পার হওয়ার কাহিনি। তরজমা স্বাতী রায়
উরিম্বা কাওয়েন্দির একটা বড় জেলা। যদিও একই নামের একটি গ্রামও রয়েছে - সেখানে ইয়োম্বেহের থেকে পালিয়ে আসা লোকেরা থাকে, তারা লোজেরির ব-দ্বীপে বাসা বেঁধেছিল। যদিও রুসিজির দ্বীপের মতোই অস্বাস্থ্যকর জায়গা, তবু তাদের মনে হয়েছিল দক্ষিণ কাওয়েন্দির সুলতান পুম্বুরুর এলাকার আশেপাশের থেকে অনেক বেশি যুতসই। বিজয়ীদের ভালমতো তাড়া তাদের অভ্যাস নাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে হল, কারণ তারা খুব ভীতু আর অপরিচিতদের প্রতি ঘোর অবিশ্বাসী, কোনমতেই তাদের গ্রামে আমাদের ঢুকতে দিল না। অবশ্য সত্য বলতে, যে পচা গলা জায়গাটার উপর তারা আস্তানা গেড়েছিল, সেদিকে এক ঝলক দেখে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আমার ধারণা যে একদম ওই এলাকায় —না, দু'পাশেই কয়েক মাইল জুড়ে —একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষের পক্ষে এক রাত ঘুমানো মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। গ্রামের দক্ষিণে যাওয়ার পথে, আমি টংওয়ে উপসাগরের শেষতম দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, কিভাঙ্গা বা কাকুঙ্গু পাহাড়ের উঁচু চুড়ো থেকে প্রায় দেড় মাইল পশ্চিমে একটি উপযুক্ত ক্যাম্পিং-এর জায়গা পেলাম। ডাক্তার যা মাপজোক নিলেন সেই অনুসারে আমরা ৫° ৫৪' দক্ষিণ অক্ষাংশে অবস্থান করছিলাম।
ওখানকার লোকেরা কেউই আমাদের ডাঙ্গার দলের কথা শোনেনি। লোজেরি ও মোগাম্বাজির ব-দ্বীপটা প্রায় পনেরো মাইল ছড়ানো, আর তার উপর সবচেয়ে দুর্গম জায়গা - পুরো সমতল আর লম্বা লম্বা মাটেটে, এস্কিনোমেনে আর কাঁটা ঝোপে ভরা, জলে প্লাবিত। এমন একটা আতিথেয়তাহীন দেশে স্থলের দলের সন্ধানে আমাদের লোকদের ক্লান্ত করা কাজের কথা না। কোন খাবারদাবারও পাওয়া গেল না, কারণ গ্রামগুলো নিজেরাই অর্ধ-অনাহারে ছিল, বাসিন্দারা ভাগ্যের দয়ায় যেটুকু যা পেত তাই দিয়ে কোনমতে মুখে দুটো তুলত।
উরিম্বা পৌঁছানোর দ্বিতীয় দিনে আমি হরিণের মাংসের সন্ধানে আমার বন্দুকবাহক কালুলুকে নিয়ে ভিতর দিকে গেলাম। সঙ্গে ডাক্তারের দুর্দান্ত দোনলা রাইফেল (একটি ১২ নং "রাইলি")। প্রায় মাইল খানেক হাঁটার পর জেব্রাদের একটা ঝাঁক দেখা গেল। চারপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে আমি তাদের একশো গজের মধ্যে আসতে পেরেছিলাম; কিন্তু জায়গাটা খুব খারাপ -ছোট ছোট কাঁটাঝোপ ভরা; রাইফেলের দৃষ্টি সীমায় সেৎসে মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে। আমার নাক কামড়ে, আমার চোখের মধ্যে ঢুকে গিয়ে, জ্বালিয়ে মারছে। আর সেই সঙ্গে আরও রাগ হচ্ছে যে নিজেকে কাঁটা থেকে আলাদা করার চেষ্টা জেব্রাদের সজাগ করে দিচ্ছে, তারা সবাই ঝোপের মধ্যে সন্দেহজনক বস্তুটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমি একজনের বুকে গুলি চালালাম, কিন্তু, যা ভেবেছিলাম, সেটা লাগল না। জেব্রাগুলো প্রায় তিনশ গজ দূরে পালিয়ে গেল, আমি খোলা জায়গায় এসে পড়লাম, আর দ্রুত বাম হাতের ট্রিগারটি টিপে দিলাম। আমার বন্দুকের লক্ষ্য ছিল একটা ঘাড় তোলা প্রাণী - সে তার সঙ্গীদের সামনে সামনে রাজার মত চলছিল, সৌভাগ্য এই যে তার হৃৎযন্ত্রের মধ্য দিয়ে গুলি চলে গেল। একটা গুলি কপাল করে একটা বড় হাঁসকেও মেরে নামিয়েছিল। হাঁসটার প্রতিটা ডানার সামনের দিকে একটা তীক্ষ্ণ শিংএর মত নখর ছিল। এই মাংসটুকু বস্তুত আমাদের দলের রসদ জোগাড়ের কাজে সাহায্য করল - আমাদের বর্তমান অবস্থান আর কাওয়েন্ডির রুসাওয়াতে অবস্থিত ম্রেরার মধ্যের অজানা এলাকা পাড়ি দেওয়ার রসদ।
উরিম্বাতে আমাদের শিবিরে পৌঁছানোর তৃতীয় দিন না যেতেই আমাদের স্থলযাত্রীদল এসে পৌঁছল। আমাদের শিবিরের বিশাল পতাকাটা টাঙ্গানো হয়েছিল সবচেয়ে উঁচু গাছের উপরে, একটি বিশ ফুট লম্বা বাঁশের ডগায়। তারা পনের মাইল দূরে নেরেম্বের ওপাশের ধারালো উঁচু শৈলশিরার উপরে উঠেছিল আর তখনই এটা চোখে পড়েছিল। প্রথমে ওরা এটা একটা বিশাল পাখি বলে ভেবেছিল; তবে দলের মধ্যে কারোর কারোর ধারালো চোখ ছিল, আর ওই পতাকা দেখে দেখে তারা শিবিরে এসে পৌঁছেছিল, হারিয়ে ফেরত পাওয়া মানুষ যেমন অভ্যর্থনা পায় তেমনই অভ্যর্থনা জানানো হল।
এই শিবিরেই আমার আরেক প্রস্থ জ্বর হল। এই বিচ্ছিরি এলাকার জঘন্য বদ্বীপটাই সেজন্য দায়ী। এটা দেখলেই আমার মনটা ভেঙ্গে পড়ে।
সাতই জানুয়ারী আমরা শিবির গোটালাম। পূর্ব দিকে ফিরলাম, এবার আমার বাড়ি! তাও আফসোস! আমি অবশ্য হ্রদের তীরে যথেষ্ট সুখ ও আনন্দ পেয়েছিলাম - মধুর সামাজিক সাহচর্যও। যথেষ্ট মনোরম দৃশ্য দেখেছি যা শিষ দিয়ে একজনকে শান্ত বিশ্রামের দিকে টানে; শান্ত দৃশ্যাবলী, সেখানে ঝাঁকুনি বা কোলাহল নেই, ঝগড়াও নেই পরাজয়ও নেই, আশাও নেই হতাশাও নেই - শুধু বিশ্রাম আছে - এক তন্দ্রাচ্ছন্ন, অলস, তবুও মনোরম বিশ্রাম শুধু। আর সামান্য কিছুই অসুবিধা। জ্বর ছিল; কোন বই নেই, কোন সংবাদপত্র নেই, রেস্টুরেন্ট নেই, ইস্ট নদীর ঝিনুক নেই, কিমা-পাই নেই, বাক-গমের কেক নেই, এমন কিছুই নেই যা সভ্য মানুষের পছন্দের মতন। তাই, তখনকার শান্ত হ্রদ ও বিশাল নীল পাহাড়কে বিদায় জানাতে গিয়ে, সেগুলো দু'দিকেই পিছিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও নীল হয়ে উঠছিল, আমি অশ্রুহীনভাবে আর একটাও দীর্ঘশ্বাস না ফেলেই সেই ভয়ঙ্কর শব্দটা উচ্চারণ করার সাহস পেলাম।
আমাদের পথ গেছে লোয়াজেরির উপত্যকার মধ্য দিয়ে। তার ব-দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার পরে, উপত্যকাটা ক্রমশঃ সরু হতে হতে শেষে একটা গভীর গিরিখাতে পরিণত হল। সেখানে এখন একটা নদী গর্জন করতে করতে ছুটে চলেছে। জলস্রোতের অস্থিরতার ছোঁয়ায় যেন উপত্যকার বাতাসও ক্ষেপে উঠেছে। এই সংকীর্ণ গিরিসঙ্কটে চলাফেরাই দুষ্কর। তবে একটাই সুবিধা হল যে রাস্তাটায় একটা গোল মতন টিলা পড়ল। তারপর একটা চাতালের মতন জায়গা। তারপর পড়ল একটা পাহাড় আর শেষমেশ দেখা দিল একটা পর্বত। সেখানেই আমরা শিবির করতে থামলাম। আমরা যখন শিবিরের জায়গা খুঁজছি, তখন ডাক্তার নীরবে সামনের দিকে ইশারা করলেন, আর হঠাৎ যেন এক পূর্ণ স্তব্ধতা জড়িয়ে ধরল চারদিক। সকালে কুইনাইন নিয়েছিলাম। মাথার প্রতিটা কোণাতেও যেন তার প্রভাব অনুভব করছি। তারপরেও পুরো তিক্ততা যায়নি, আর যদিও আমি "রেইলি" রাইফেলের ভারী ওজনের নীচে কাঁপছিলাম, তাও ডাক্তার যেদিকে ইশারা করছিলেন সেদিকে এগিয়ে গেলাম।
সামনে একটা খাড়া গিরিখাত নেমে গেছে। তার নিচের দিকে তাকালাম। সেটার অপর তীরে একটা অপূর্ব মোষ হ্যাঁচর প্যাঁচর করে উপরের দিকে উঠছে। সে সবেমাত্র চূড়ায় এসে পৌঁছেছিল, আর শত্রুকে জরিপ করার জন্য ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। তখনই আমি কাঁধের তলায়, মেরুদণ্ডের কাছাকাছি একটা গুলি লাগাতে সফল হলাম। ব্যথায় জন্তুটা কঁকিয়ে উঠল। "গুলি লেগেছে! ওর গুলি লেগেছে!" চিৎকার করে উঠলেন ডাক্তার; "আপনি যে ওকে ঘায়েল করেছেন সেটা পরিষ্কার।" দলের সবাইও মাংস পাওয়ার আশায় হল্লা করে উঠল। তার শিরদাঁড়ায় দু নম্বর গুলিটা গেঁথে দিতে সে হাঁটু মুড়ে পড়ে গেল আর তৃতীয় গুলিটা তাকে খতম করল। আরেক দফা রসদের বন্দোবস্ত হল। মাংস কেটে, আগুনে শুকিয়ে, এনগোয়ানারা যেমন করে থাকে, সঙ্গে নেওয়া হবে। সামনের নির্জন প্রান্তরে অনেকদিনের ভরসা। ডাক্তার ও আমার জন্য, তার জিভ, কুঁজ ও আরও কটা পছন্দের অংশ লবণে ভেজানো হল। কয়েক দিনের মধ্যেই দারুণ কর্নড গরুর মাংস তৈরি হয়ে যাবে। এটা অবশ্য বললে ভুল হবে না যে ওয়াংওয়ানারা শিকারির চেয়ে রাইফেলের প্রশংসাতেই বেশি পঞ্চমুখ হল।