ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। এ পর্বে উজিজি থেকে উন্যানয়েম্বে যাত্রার প্রস্তুতি। তরজমা স্বাতী রায়
নিজের চার্টখানা বার করলাম - আমি নিজেই সেটা তৈরি করেছিলাম - তার উপর আমার অটুট ভরসা। উন্যানয়েম্বে যাওয়ার এমন একটা পথ খুঁজে বার করলাম যে পথে একটাও কাপড় নজরানা দিতে হবে না - আর জঙ্গল ছাড়া আর কিছু খারাপ জিনিসও পথে পড়বে না। সেই পথ ধরে চললে ভিনজাদের আর লুঠেরা হহাদের পুরো এড়ানো যায়। আর এই শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ পথটি দক্ষিণে চলেছে জলের ধার দিয়ে দিয়ে, উকারাঙ্গা ও উকাওয়েন্দির উপকূল ধরে কেপ টংওয়ে পর্যন্ত। কেপ টংওয়েতে যেখানে পৌঁছব, সেটা উকাওয়েন্দির ইউসাওয়া জেলার ইটাগা, সুলতান ইমরেরা গ্রামের বিপরীতে; এর পরে আমরা আমাদের পুরানো রাস্তায় পড়ব। যে রাস্তা ধরে আমি উজিজি যাওয়ার জন্য উন্যানয়েম্বে থেকে পাড়ি দিয়েছিলাম। ডাক্তারকে এই রাস্তার কথা বললাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই এর সুবিধা ও নিরাপত্তার ব্যাপারটা বুঝলেন; আর যদি আমরা ইমরেরায় পৌঁছাই, আমার যেমন মনে হয়েছিল, তাহলে তো প্রমাণই হয়ে যাবে যে আমার চার্ট ঠিক না ভুল।
ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে আমরা আমাদের আবিষ্কার-সফর সেরে টাঙ্গানিকার উত্তরে উজিজিতে পৌঁছালাম; এ দিন থেকে ডাক্তার তার অসংখ্য বন্ধুদের কাছে চিঠি লেখা শুরু করলেন। আর টাঙ্গানিকার দক্ষিণ ও পশ্চিমে ভ্রমণের কালে তার সংগৃহীত মূল্যবান তথ্যাদি তিনি ফিল্ড বই থেকে তার বিশালাকায় লেটসের ডায়েরিতে টুকে রাখতে শুরু করলেন। বারান্দায় তার শার্ট পরে বসে হাঁটুর উপর তার লেটস ডায়েরিখানা রেখে তিনি যখন লিখতেন, আমি তার সেই ছবি এঁকে রেখেছিলাম। অন্য পাতায় সে রকম একটা ছবি রইল। সেটা তার একটা প্রশংসনীয় প্রতিকৃতি, কারণ যে শিল্পী আমাকে সাহায্য করেছেন তিনি স্বজ্ঞালব্ধ চোখে আমার ত্রুটিযুক্ত স্কেচটি দেখেছেন; আর এই ছবির সাহায্যে আমি তাঁকে যেমনটি দেখেছিলাম, তেমন রূপেই তাঁকে পাঠকের সামনে হাজির করতে পেরেছি। তিনি তখন তাঁর লং মার্চের সময় যা যা দেখেছিলেন সেসব নিয়ে চিন্তা করেছিলেন।
উজিজিতে আমরা এসে পৌঁছানোর পরপরই, তিনি তার কাগজপত্রের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন আর জেমস গর্ডন বেনেট, এস্কোয়ারকে চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছিলেন। তিনি সেই চিঠি শেষ করার পরে, আমি তাঁকে সেই চিঠিতে "জুনিয়র" শব্দটি যোগ করতে বলেছিলাম। কারণ ছোট মিঃ বেনেটের কাছেই তিনি ঋণী। আমার তো চিঠিটা দারুণ লেগেছিল, আর একটা শব্দও যোগ করার দরকার নেই। তার হৃদয়ের অনুভূতি তার লেখা কৃতজ্ঞ শব্দগুলিতে প্রকাশিত। আর যদি আমি মিঃ বেনেটকে ঠিকমত চিনে থাকে, আমি জানতাম তিনি এতেই সন্তুষ্ট হবেন। কারণ লিভিংস্টোন বেঁচে আছেন না মারা গেছেন সেই খবরের জন্য তিনি যতটা উৎসুক ছিলেন, এইসব খবরে তাঁর ততটা কৌতূহল নেই।
ডিসেম্বরের শেষের দিকে তিনি তাঁর সন্তানদের, স্যার রডারিক মার্চিসন ও লর্ড গ্র্যানভিলের কাছে চিঠি লিখতে বসলেন। আর্ল অফ ক্ল্যারেন্ডনকেও লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিশিষ্ট সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিটির মৃত্যুর খবর তাঁকে জানানোর মতন দুঃখের কাজটার ভার আমারই উপর পড়ল।
এরই মধ্যে আমি উন্যানয়েম্বেতে ফেরার অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম - গাঁটরি, বস্তা, সেই সঙ্গে আমার ও ডাক্তারের বড় বড় টিনের বাক্স আমার নিজের লোকদের মধ্যে ভাগ করে দিচ্ছিলাম; কারণ আমি চেয়েছিলাম যে ডাক্তারের লোকরা যেন সাধারণ যাত্রী হিসাবেই যায়। তাদের মালিকের প্রতি দায়িত্ব তারা খুবই ভালভাবে সম্পন্ন করেছিল।
১২ই ডিসেম্বর সাইদ বিন মাজিদ মিরাম্বোর দেশের দিকে রওনা দিয়েছে। উইলিয়ানকুরুর জঙ্গলে তার ছেলে সৌদকে হত্যা করার জন্য কালো বোনাপার্টের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেছে; সঙ্গে উজিজি থেকে বন্দুকসহ তিনশ জন গাঁটাগোট্টা পালোয়ান। এই কঠিন-হৃদয়ের বৃদ্ধ সর্দারটি রাগে ও বিরক্তিতে ফুটছিল একেবারে। আর সাত ফুট বন্দুক নিয়ে সে যখন রওনা দিল কি দারুণ যোদ্ধাই না লাগছিল তাকে। রুসিজির দিকে রওনা হওয়ার আগেই, যুদ্ধ যাত্রার জন্য শুভেচ্ছা জানালাম, আর আশাও প্রকাশ করলাম যে তিনি মধ্য আফ্রিকান দুনিয়াকে অত্যাচারী মিরাম্বোর হাত থেকে মুক্তি দেবেন।
বিশে ডিসেম্বর প্রবল বৃষ্টি, বজ্রপাত, বজ্রপাত এবং শিলাবৃষ্টি সহ বর্ষা শুরু হল; থার্মোমিটার ৬০° ফারেনহাইটে নেমে গেল। এদিন সন্ধ্যায় আমি আফ্রিকায় আসার পর তৃতীয়বারের মতো আরটিকারিয়া বা "নেটল র্যাশে" আক্রান্ত হলাম, বিচ্ছিরি রকমের ভুগলাম; এটা আবার পালা জ্বরের আক্রমণের অগ্রদূত, সেটা চার দিন ধরে চলল। সে জ্বর ম্যালিগন্যান্ট ধরণের, জাম্বেজি, হোয়াইট নীল, কঙ্গো ও নাইজারের আফ্রিকান অভিযাত্রীদের জন্য মারাত্মক হিসেবে প্রমাণিত! মাথা ভনভন, নাড়ী টনটন, বুক ঝনঝন এইসব চলে, আর রোগীর চিন্তাভাবনাগুলো একটা অদ্ভুত জগতে চলে যায়, যেমনটা শুধুমাত্র একজন অসুস্থ মানুষই কল্পনা করতে পারেন। লিভিংস্টোনের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে এটা ছিল আমার জ্বরের চতুর্থ আক্রমণ। আগে যাত্রার উত্তেজনা ও উচ্চাশা আমার মন জুড়ে ছিল - উজিজির দিকে এগোনোর সময় জ্বরের আক্রমণের থেকে সেটাই আমার শরীরকে প্রায় বাঁচিয়ে রেখেছিল; কিন্তু সেই মহান দায়িত্বটি মেটার দু সপ্তাহ পরে আমার শরীর ছেড়ে দিল, আমার মন শীতল হয়ে গেল আর আমি ফের জ্বরের শিকার হলাম। যাইহোক, যেহেতু আমি কখনই অসংযম বা অন্যান্য দুষ্ট অভ্যাসে অভ্যস্ত ছিলাম না, সেসব শরীরকে একেবারে ধ্বংস করে দেয়। তাই আনন্দের কথা, আমার শরীর, এই ছল রোগের বারংবার আক্রমণের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি।
ক্রিসমাস চলে এলো। ডাক্তার ও আমি ঠিক করেছিলাম যে আশীর্বাদভরা ও সময়-সম্মানিত দিনটি আমরা অ্যাংলো-স্যাক্সন দেশে যেমন করে পালন করা হয়, ঠিক তেমন করেই পালন করব। অবশ্য উজিজিতে ভোজের জন্য যাকিছু পাওয়া যায় তাই দিয়েই ভোজের ব্যবস্থা হবে। আগের রাতে আমার জ্বর একেবারে চলে গেল, আর ক্রিসমাসের সকালে, যদিও খুবই দুর্বল ছিলাম, আমি জেগে গেলাম, পোশাক পরলাম, আর শ্বেতাঙ্গদের কাছে এই দিনের গুরুত্ব সম্বন্ধে আমাদের বাবুর্চি ফেরাজজির কাছে বক্তৃতা দিলাম। এই লাই-পেয়ে-মাথায় ওঠা চকচকে জন্তুটার মাথায় রন্ধনশিল্পের দক্ষতার কিছু রহস্য প্রবেশ করানোর চেষ্টা করছিলাম। উজিজির ও পুরোনো ভরসাস্থল ময়েনি খেরির বাজার থেকে চর্বিওলা চওড়া ল্যাজের ভেড়া, ছাগল, জোগ্গা ও পোম্বে, ডিম, টাটকা দুধ, কলা, সিংওয়ে, দারুণ ভুট্টার ময়দা, মাছ, পেঁয়াজ, মিষ্টি আলু, ইত্যাদি সবই জোগাড় করা হল। কিন্তু হায় ! আমার দুর্বলতারই দায়ী। ফেরাজ্জি রোস্টটা নষ্ট করে দিল, আমাদের কাস্টার্ডও পুড়ে গেল — রাতের খাবারটা পুরো মাঠে মারা গেল। নেহাতই শাস্তি দেওয়ার জন্য আমার হাত আর উঠছিল না, নাহলে ওই মাথামোটা বদমাশটা মার খেয়ে মরত সেদিন। আমার চেহারা ভয়ঙ্কর ও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছিল, আর ফেরাজ্জি ছাড়া অন্য যে কাউকে ধ্বংস করে দিতে পারত। বোকা, নিরেট-মাথার বাবুর্চিটা কেবল হাসল, আর আমার খুব বিশ্বাস যে তার অসাবধানতায় ওই যে পাই, কাস্টার্ড আর রোস্ট ইউরোপিয়ানদের স্বাদের পক্ষে একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেটা খেয়েই সে পরে খুব তৃপ্তি পেয়েছিল।
রওনা দেওয়ার আগে সাইদ বিন মাজিদ আদেশ দিয়ে রেখেছিল যে আমাদের দেশের অভিমুখে ভ্রমণের জন্য তার নৌকাটি যেন ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। আর ময়েনি খেরিও দয়া করে একই উদ্দেশ্যে তার বিশাল জাহাজটি ধার দিয়েছিল। এই অভিযানে এখন ডাক্তার ও তার পাঁচজন ভৃত্য তাদের মালপত্রসহ যোগ দিয়েছেন। তাই আমাদের আরেকটি ক্যানোর দরকার ছিল।
উকাওয়েন্দির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অভিযানের যে চেষ্টা আমি করতে চলেছি, তার জন্য দুধেলা ছাগলের পাল আর মোটা সোটা ভেড়ার ব্যবস্থা করা হল। লিভিংস্টোনের বাবুর্চি, ভালমানুষ হালিমা এক বস্তা মিহি ময়দা বানিয়েছিল, নিজের মনিবের প্রতি কেবলমাত্র অসীম ভালবাসা ভরা ভক্তি থাকলেই তেমনটা বানানো যায়। তার স্বামী হামোয়দাহও, এই গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যটি বানাতে অনেকখানি মনোযোগ দিয়েছিল, সাহায্যও করেছিল। একমাত্র উজিজিতেই গাধা পাওয়া যায়। পাছে ডাক্তার তার প্রাচীন শত্রুর দরুন এই দীর্ঘ যাত্রায় কষ্ট পান, তাই ডাক্তারের জন্য একটা কিনেছিলাম। সংক্ষেপে, আমরা বিলাসবহুলভাবে খাবার, ভেড়া, ছাগল, চিজ, কাপড়, গাধা ও ক্যানো দিয়ে সেজে উঠলাম। দীর্ঘ দূরত্ব পেরিয়ে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সেইসব সরঞ্জাম যথেষ্ট; আমাদের আর কিছুই দরকার ছিল না।
২৭শে ডিসেম্বর এসে গেল; উজিজি থেকে আমাদের প্রস্থানের দিন। সম্ভবত বন্দরটিকে চিরতরে বিদায় জানাতে যাচ্ছি। জায়গাটার নাম চিরকাল আমার স্মৃতিতে পবিত্র হয়ে থাকবে। দারুণ সব গাছের কাঠের গুঁড়ি কুঁদে বানানো ডিঙ্গিনৌকা—ভাল ভাল জিনিসে ভরা; দাঁড়িরা নিজেদের জায়গায় বসা; ডাক্তারের ডোঙ্গাতে ইংল্যান্ডের পতাকা উড়ছে ; আমার নৌকার মাথার উপরে আমেরিকার পতাকা আনন্দে গর্জন করছে, দুলছে; খুবই গর্বের সঙ্গে সেদিকে তাকাচ্ছি - দুটো অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতির প্রতিনিধি আজ এই সুবিশাল অভ্যন্তরীণ সমুদ্র, বন্য প্রকৃতি এবং বর্বরতার সামনে দাড়িয়ে।
বড় বড় আরব বণিকরা, উন্যামওয়েজির সশ্রদ্ধ অধিবাসীরা, জাঞ্জিবারের মুক্তমানুষেরা, বিস্মিত গুহহা ও জিজিরা, এমনকি উগ্র রুন্ডিরা মিলে আমাদের নৌকা অবধি পৌঁছে দিল। রুন্ডিরা অবধি এই দিনে শান্ত, এমনকি দুঃখিত, যে শ্বেতাঙ্গরা চলে যাচ্ছে- তাদের সবার জিজ্ঞাসা, "কোথায় যাচ্ছে?"