আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। বাগামোয়ো থেকে ‘উসেগুহহা’-র রাজধানী সিম্বামওয়েন্নিতে পৌঁছে এবারে উগোগো অঞ্চলের চুন্যু (চুন্যো) নামক জনপদের লক্ষ্যে চলেছে স্ট্যানলের কাফেলা। উসেগুহহা বলে কোনো স্থান বা প্রদেশ আজ আর নেই। এমনকি বোঝাও মুশকিল সেই অঞ্চলের বিস্তৃতি ঠিক কী ছিল। তবে সিম্বামওয়েন্নি নামে একটি ক্যাম্প-সাইট এখনও রয়েছে তানজানিয়ার মোরোগোরো শহরের কাছে। আন্দাজ করা যেতে পারে এই সিম্বামওয়েন্নি-র কথাই স্ট্যানলে বলছেন। কাজেই এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই মানচিত্রে নীল বুটি দেওয়া পথের আশেপাশেই।—সম্পাদক
শ অসুস্থ, এই ধসে-পড়া কাফেলাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পুরো দায়িত্ব আমার উপর এসে পড়ল। ওন্যাম্বেয়েজির গাধাগুলি পাঁকের মধ্যে এমন আটকে গেল যেন একেবারে শিকড় গেড়ে বসেছে। একজনকে সেই অনড় অবস্থার থেকে চাবুক মেরে মেরে যেই নড়ানো হয়, অমনি আর-একজন জলের মধ্যে ছেতরে পড়ে—আমি যেন সিসিফাসের মতো কাজে লেগেছি। চাবকিয়ে চামড়া ফাটিয়ে দিলেও বোম্বে আর উলেদি ওই কাদা আর ঝড়ের সামনে দাঁড়াতে পারে না। অথচ ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে তারাই নাকি আমাকে সাহায্য করছিল—সব মিলিয়ে পাগল পাগল লাগছিল। দু-ঘণ্টা ধরে এইরকম পরিশ্রম করে কাফেলাকে মাইল দেড়েক চওড়া সাভানার ওপারে নিয়ে যেতে পারলাম; এহেন সাফল্যের জন্য নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই একটা গভীর গাড্ডার সামনে এসে দাঁড়ালাম। গাধা-ডোবানো গভীর, প্লাবিত সাভানার বর্ষার জলে টইটম্বুর, তীব্র স্রোতে বয়ে গিয়ে মাকাটাতে পড়ছে। গাধাগুলোর পিঠের থেকে বোঝা নামাতে হবে, খরস্রোতের মধ্যে দিয়ে তাদের চালিয়ে নিতে যেতে হবে, আবার অন্য পারে নিয়ে গিয়ে তাদের পিঠে মাল চাপাতে হবে। এই কাজেই পুরো এক ঘণ্টা লাগল।
একটা জঙ্গলের মধ্যে পথ খুঁজে না পেয়ে খানিক ঘুরেফিরে তারপর দেখি আমাদের সামনে পথ আটকে একটা ছোটো ঝর্না, এখন ফুলে ফেপে প্রমাণ চেহারার নদী হয়ে উঠেছে। নদী পেরোনোর সেতু ভেসে গেছে। ফলে সাঁতার কেটে পেরোতে বাধ্য হলাম। সেই সঙ্গে মালপত্রগুলো ভাসিয়ে আনতে হল। আরও দুই ঘণ্টা দেরি হল। দ্বিতীয় নদীটির পার ছাড়ানোর পরে, আমরা জল-কাদা ছেটাতে ছেটাতে, জল ঠেঙ্গিয়ে, মাঝেমাঝে আধা-সাঁতার কাটতে কাটতে, মাকাটার বাম তীরের কাদা, জল-ঝরা ঘাস আর মাতামা-ডাঁটার মধ্যে দিয়ে পাক খেতে খেতে এগোতে লাগলাম, যতক্ষণ না নদীর একটা তীক্ষ্ণ বাঁক আমাদের সেদিনের মতো পথ চলা বন্ধ করল। পরের দিন এটা পার হতে হবে।
এই দুঃখের দিনে মাত্র ছয় মাইল পথ পাড়ি দিয়েছিলাম, যদিও দশ ঘণ্টা সময় লেগেছিল।
যত দূর চোখ যায় শুধু জলা—মাকাটা জলাভূমির পাশে শিবির
ক্লান্তিতে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম। তবু ভালো যে জ্বরও হয়নি, প্রায় যেন জাদুবলেই সেটা এড়ানো গিয়েছিল; কারণ যদি কখনও একটা জেলারও উপরে কম্পজ্বরের অভিশাপ পড়ে, তাহলে মাকাটার প্রান্তর সেই অভিশপ্তের তালিকার প্রথমদিকেই থাকবে। অনচ্ছ্ব কুয়াশায় ঢাকা জল-ঝরানো বনাঞ্চল, বিস্তীর্ণ প্লাবিত এলাকার মাঝে মাঝে বন্যার ঘোলা জলে নুয়ে পড়া টাইগার-ঘাসের টানা তৃণভূমি, পচা গাছ আর বেতবনের ডাঁই করা পাহাড়, ফেঁপে ওঠা নদী আর কাঁদতে-বসা আকাশ—মুকুনগুরুর জন্মের জন্য আর কীই বা চাই! বহু ব্যবহৃত কুঁড়ে ও তার চারপাশের নোংরার স্তূপ কলেরার জন্যও যথেষ্ট!
শুকনো মরসুমে মাকাটা নদী মাত্র চল্লিশ ফুট চওড়া হলেও মাসিকা মরসুমে চওড়ায়, গভীরতায় আর প্রাবল্যে একটা বড়োসড়ো নদী হয়ে ওঠে। আর খুব বেশি বৃষ্টি হলে, দু-পারের বিশাল সমভূমিটিকে প্লাবিত করে—গোটা জায়গাটা একটা বড়ো হ্রদে পরিণত হয়। এটা ওয়ামি নদীর মূল উপনদী, ওয়ামি সাদানি এবং উইন্ডের মধ্যে সমুদ্রে এসে পড়েছে। আমরা যেখান দিয়ে মাকাটা পেরোলাম তার প্রায় দশ মাইল উত্তর-পূর্বে, গ্রেট মাকাতা, লিটল মাকাটা, একটা নামহীন খাঁড়ি আর রুদেয়া নদী এসে মেলেও ওয়ামি নামে পরিচিত হয়। উসাগারা এলাকা জুড়ে অবশ্য ওয়ামি মুকনডকয়া নামে পরিচিত। মাকাটার সমতলের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমদিক জুড়ে আছে চন্দ্রকলার মতো বিস্তৃত উসাগারা পর্বতমালা—তার থেকেই এই জলধারাগুলোর মধ্যে তিনটি বেরিয়েছে, আর একই পর্বতমালার উত্তরতম প্রান্ত থেকে বেরিয়েছে রুদেয়া।
মাকাটার গতি অতি দ্রুত, আর আধাজলে ডুবে থাকা, লটরপটর করা সেতুটাও জিনিসপত্রের সুরক্ষার জন্য এতই বিপজ্জনক যে নদী পারাপার করতে পুরো পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগল। জলে জিনিসপত্রের একটুও ক্ষতি না করে, সব জিনিস নিয়ে আমরা অতি সাবধানে যেই নদীর অন্য পারে পৌঁছেছি, অমনি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে সবকিছু এমন ভিজিয়ে দিল যেন মালপত্রগুলোকে নদীর জলের ভিতর দিয়ে টেনে ওপারে নেওয়া হয়েছে। এক ঘণ্টার বৃষ্টির পরে জলার যা চেহারা হল তাতে সেটা পেরোনোর কথা ভাবাই বাতুলতা। ফলে আমরা এমন জায়গায় শিবির করতে বাধ্য হলাম যেখানে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিরক্তি বাড়ে। কিঙ্গারু নামের একজন স্বাধীন মানুষকে বাগামোয়োতে সেনাদলে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আর-একজনের জিনিসপত্র নিয়ে চম্পট দিয়েছে। আমার দুই গোয়েন্দা উলেদি (গ্রান্টের নিজস্ব নোকর) এবং সারমিয়ানকে তখনই আমেরিকান ব্রিচ-লোডার দিয়ে, তার পিছনে ধাওয়া করতে পাঠানো হল। সুকৌশলে কাজটা করতে যেরকম দ্রুত তারা বেরিয়ে গেল, তার থেকেই তাদের সাফল্যের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। এক ঘণ্টার মধ্যেই তারা পলাতককে নিয়ে ফিরে এল। কিগনডো নামের একজন মেসগুহা প্রধানের বাড়ি নদীর পূর্ব পাড়ের থেকে প্রায় এক মাইল দূরে, সেখানেই লুকিয়ে ছিল সে। কিগনডোও এসেছে উলেদি আর সারমিয়ানের সঙ্গে—আমার থেকে পুরস্কার সংগ্রহ করতে আর ঘটনার বিবরণ দিতে।
কিগনডো বলল যে সে যখন বসেছিল, তখন “আমি দেখলাম লোকটা একটা পোঁটলা নিয়ে জোরে দৌড়াচ্ছে, তখনই বুঝলাম যে ও আপনার দল ছেড়ে পালাচ্ছে।” আমরা (আমার বউ ও আমি) আমাদের পাহারা-কুঁড়েতে বসে ভুট্টাখেতের উপর নজরদারি করছিলাম! রাস্তাটা আমাদের কাছ দিয়েই চলেছে ফলে লোকটা আমাদের কাছে আসতে বাধ্য। সে যখন কাছে এল তখন আমরা তাকে ডেকে বললাম, “গুরু, এত তাড়াতাড়ি কোথায় চললে? তুমি তো মুসুঙ্গুর দলের, আমরা জানি তো, গতকালই তুমি আমাদের থেকে দুই ডটির মাংস কিনেছ। মুসুঙ্গুকে ছেড়ে পালাচ্ছ?”
“হ্যাঁ,” সে বলল “পালিয়েই যাচ্ছি; সিম্বাম্বওয়েনি যাব। নিয়ে যাবে আমাকে? তাহলে একটা ডটি দেব।” আমরা তখন বললাম, “এসো, আমাদের ঘরে এসো—সেখানে শান্তভাবে কথা বলা যাবে।” সে আমাদের বাড়ির ভিতরের ঘরে ঢুকলে, তাকে তালাবন্ধ করে দিলাম। তারপর মেয়েদের ওর দিকে চোখ রাখতে বলে, আমরা আবার খেতের পাহারা-ঘরে চলে গেলাম। জানতাম যে, আপনি যদি ওকে চান, তাহলে ওর পিছনে সৈন্য পাঠাবেন। আমরা পাইপ ধরিয়েছি কি ধরাইনি, দেখলাম দু-জন লোক ছোটো বন্দুক নিয়ে, কোনো বোঝা ছাড়াই এই রাস্তা ধরে আসছে আর মাঝে মাঝেই মাটির দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে, যেন পায়ের দাগ খুঁজছে। বুঝলাম যে এদের জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম; সুতরাং তাদের ডেকে বললাম, “কাউকে খুঁজছ?” তারা বলল, “আমরা আমাদের মনিবকে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া একজনকে খুঁজছি। এখানে তার পায়ের ছাপ আছে। তোমরা যদি এই ঝুপড়িতে অনেকক্ষণ বসে থেকে থাক, তাহলে অবশ্যই তাকে দেখেছ। জান সে কোথায়?” আমরা বললাম “হ্যাঁ; সে আমাদের বাড়িতে আছে। আমাদের সঙ্গে এসো, তাহলে তাকে তোমাদের হাতে তুলে দেব; তবে তোমার প্রভুকে অবশ্যই তাকে পাকড়ানোর জন্য আমাদের কিছু পুরস্কার দিতে হবে।”
কিগনডো যেহেতু কিঙ্গারুকে তাদের হাতে তুলে দেবে বলল, তাই উলেদি এবং সারমিয়ানের আর কিছুই করার ছিল না, তারা শুধুই বন্দির দায়িত্ব নিল আর বন্দি ও তার গ্রেপ্তারকারীদের সঙ্গে করে মাকাটার পশ্চিম তীরে আমার শিবিরে নিয়ে এল। কিঙ্গারুকে দু-ডজন বেত মারা হল আর বেঁধে রাখা হল। তার গ্রেপ্তারকারী বউ-এর জন্য পাঁচ খেটে লাল প্রবালের মালা ছাড়াও একটি ডটি পেল।
(ক্রমশ...)