ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালা। তরজমা স্বাতী রায়
১৭ ই মার্চ।—কোয়ালাহ নদীর কাছে পৌঁছালাম, রুবুগার একজন স্থানীয় বাসিন্দা এই নদীকে ন্যাহুবা বলে, আরেকজন বলে উন্যাহুহা। মাসিকা ঋতুর প্রথম বৃষ্টিপাত হল এই দিনে; উপকূলে পৌঁছনোর আগেই আমার গায়ে ছাতা পড়ে যাবে। গত বছরের মাসিকা ২৩শে মার্চ শুরু হয়েছিল, আমরা তখন বাগামোয়োতে আর শেষ হল ৩০ এপ্রিল।
পরের দিন উন্যামওয়েজি সীমান্তের পশ্চিম তুরায় অভিযান থামালাম আর ২০ তারিখে পূর্ব তুরায় পৌঁছালাম; অল্প কিছুক্ষণ পরেই, একটা বন্দুকের জোর শব্দ শোনা গেল, আর ডাক্তারের চাকর সুসি ও হামওয়দা এসে হাজির, সঙ্গে উরেডি ও আমার আরেকজন লোক। তারা "স্যার থমাস ম্যাকলার, অবজারভেটরি, কেপ অফ গুড হোপ"-এর জন্য একটি চিঠি নিয়ে এসেছে। আর আমার জন্যও একটা চিঠি আছে। সেটা এইরকম : -
কুইহারা, ১৫ই মার্চ, ১৮৭২।
প্রিয় স্ট্যানলি,
যদি লন্ডনে পৌঁছে আমাকে টেলিগ্রাফ করতে পারেন, তাহলে বিশেষত স্যার রডারিক কেমন আছেন তা জানাবেন দয়া করে?
আপনি গতকাল বিষয়টি ঠিক ধরেছেন, ওই যখন আপনি বললেন না যে আমি এখনও নীল নদের উৎস সম্পর্কে নিঃসন্দেহ নই; তবে যত তাড়াতাড়ি আমি নিজে সন্তুষ্ট হব, ততই তাড়াতাড়ি আমি ফিরে যাব আর অন্য লোকেদের সামনে উপযুক্ত সন্তোষজনক কারণগুলি উপস্থিত করব। ব্যাপারটা একেবারে এইখানেই দাঁড়িয়ে।
স্কচেরা যেমন বলে যে একটা খাড়া চড়াই ভাঙ্গতে হলে একজন শক্তপোক্ত মানুষকে লাগাও, কারণ সে এটা লেগে থেকে করতে পারবে, তার চেয়ে ভাল কথা যদি বলতে পারতাম! আমি কৃতজ্ঞ যে, যাওয়ার আগে, আপনার টানা জ্বরটা ছেড়েছিল - ভাল চেহারা ধরেছিল। লাগাতার জ্বরটা থাকলে আমি অসীম উদ্বেগ ছাড়া আপনাকে যেতে দিতে পারতাম না। আমাদের পরমপিতা, জগদীশ্বরের ভরসায় আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত।
আপনার চিরকৃতজ্ঞ,
ডেভিড লিভিংস্টোন।
কাবুইরে থেকে আবার কাজেম্বে ও তারপর লেক ব্যাঙ্গয়েওলো ফিরে আসার একটানা দীর্ঘযাত্রাকালীন, পর্যবেক্ষণগুলি লিখে রাখতে যতটা সম্ভব কঠোর পরিশ্রম করেছি, আর বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমার বড় পরিসংখ্যানগুলো ফুলস্ক্যাপ কাগজের ছ'টা কাগজ জুড়ে, আর সেগুলো ফের অনুলিপি করতে অনেকদিন লাগবে। ১৮৬৯ সালে যখন উজিজিতে অসুস্থ হয়ে পড়ি, তখন আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছিলাম আর আমাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই, যদিও দেশে বসে লোকেরা অন্ধকারে হাতড়ে মরে। কিছু আরবদের চিঠি এসেছে, আমি সেগুলো আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ডি. এল.
১৬ই মার্চ, ১৮৭২।
পুনশ্চ - আজ সকালে প্রকাশক মিঃ মুরেকে একটি চিঠি দিয়েছি। তিনি ৫০, আলবেমারেল স্ট্রিটে থাকেন। বুকপোস্ট বা অন্য কোন ভাবে জার্নালটি অ্যাগনেসকে পাঠানোর ব্যাপারে আপনাকে দরকারমত সাহায্য করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেছি। আপনি যদি তাঁর সঙ্গে দেখা করেন তো একজন অকপট ভদ্রলোকের দেখা পাবেন। আপনার জন্য একটি আনন্দদায়ক যাত্রা কামনা করি।
ডেভিড লিভিংস্টোন।
হেনরি এম. স্ট্যানলি মহাশয়ের প্রতি, তাঁকে যেখানেই পাওয়া যাবে।
বেশ কয়েকজন এনগোওয়ানা আমাদের ফিরতি অভিযানে যোগ দিতে তুরাতে এসেছিল, তারা নিজেদের ভরসায় উগোগোর মধ্য দিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছে; আরও লোক আসছে বলে জানা গেছে; কিন্তু উন্যানয়েম্বেতে সকলকে যথেষ্ট জানান দেওয়া হয়েছিল যে আমাদের কাফেলা ১৪ তারিখে অবশ্যই রওনা দেবে, আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
২১ তারিখে তুরা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়, আমরা যখন এনঘওয়ালাহ নদীর দিকে এগোচ্ছি, তখন সোসি ও হামোদাহকে ডাক্তারের কাছে ফেরত পাঠানো হল। দু দিন পরে আমরা এনগারাইসো গ্রামের সামনে পৌঁছালাম। আমাদের কাফেলার সর্দার গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কিম্বুরা গায়ের জোরে তাদের বের করে দেয়।
২৪ তারিখে, আমরা জঙ্গলের একটা ফাঁকা জায়গায়, এখানে যাকে বলে "টঙ্গোনি", শিবির করেছিলাম। এটা একটা ভারি রোমান্টিক জায়গা। এই এলাকা এক সময় খুবই সমৃদ্ধ ছিল; অতি উর্বর মাটি; বড় বড় কাঠ, উপকূলের ধারেপাশে তার অনেক দাম। আর আফ্রিকায় যে ব্যাপারটা হাতে চাঁদ পাওয়ার মতন , এখানে অনেক জল আছে। আমরা একটা মসৃণ, প্রশস্ত গোলাকার সায়ানাইটের ঢিবির কাছে শিবির স্থাপন করেছি। পাথরটার একটা দিক, খাড়া একটা বিশাল চৌকো পাথর, আশেপাশের ছোট ছোট গাছপালাদের উপরে মাথা তুলেছে; অন্য প্রান্তে আরেকটি পাথর খাড়া হয়ে আছে, তার আবার গোড়াটা আলগা।
অভিযানের সদস্যরা বড় বড় পাথরের পাতগুলো দিয়ে শস্য পেষার কাজ করছিল। আশেপাশে কোন গ্রাম না থাকলে বা গ্রামের লোকেরা শত্রুভাবাপন্ন হলে, এখানে এমনই দস্তুর।
মার্চের ২৭ তারিখে কিওয়েতে ঢুকলাম। ভোরবেলা যখন এমদাবুরু নদী ছেড়ে চলে আসছি, তখনই আমাদের গম্ভীর সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল যে আমরা এবার উগোগোতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি; আর কানিয়াগা গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পরে, গাইডের ভেরীর শব্দের মতো শিঙাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে আমরা মর্মরিত ভারতীয় ভুট্টার বিশাল ক্ষেতের অন্দরে প্রবেশ করলাম। ভুট্টার শীষগুলি পোড়ানো-ঝলসানোর জন্য যথেষ্ট পাকা। আর সাধারণত, মার্চের শুরুতে, কাফেলাগুলো দুর্ভিক্ষের শিকার হয়, স্থানীয়- মুসাফির কারোরই সে দুর্ভিক্ষের আওতা থেকে রেহাই নেই। তাই ভুট্টাদের চেহারা দেখে অন্তত এই একটা উদ্বেগ দূর হয়েছিল।
আমরা শীঘ্রই গঁদ-গাছের এলাকায় ঢুকলাম। জানতে পারলাম যে আমরা উগোগোতে আছি। এদেশের বনগুলো প্রধানত গঁদ ও কাঁটাওলা গাছ, যেমন মিমোসা ও তামারিস্ক মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি, সঙ্গে প্রায়শই বিভিন্ন ধরণের বুনোফলের গাছও রয়েছে। অঢেল আঙ্গুর, যদিও সেগুলো তেমন পাকেনি; আর ছিল সুলতানা আঙ্গুরের মতন মিষ্টি একটা গোলাকার, লালচে, বৈঁচি-পাতার মতন পাতাওলা ফল। এপ্রিকটের মতন আকারের একরকম ফলের গাছও ছিল, সে আবার হাক্কুচ তেতো।
কাঁটা ঝোপের জড়ানো-মড়ানো জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে কিওয়েহের বিস্তৃত বসতি চোখে পড়ল; আর সর্দারের গ্রামের পূর্ব দিকে, একদল বিশাল বিশাল বাওবাবের ছায়ায় শিবির বানানোর জায়গা পেলাম।
কিওয়েহের জনগণের মধ্যে কিম্বু ও গোগোরা প্রায় সমান অনুপাতে। স্পেক ও গ্রান্টের সমসময়ে যে বুড়ো কিওয়েহ ছিল, সে মারা গেছে, তার ছোট ছেলে এখন এই অঞ্চলের রাজা। এই যুবক আপাতদৃষ্টিতে ন্যায্য রাজা, আর তার অনুগত প্রজাদের গবাদি পশুর সংখ্যাও শত শত, তবুও তার পরিস্থিতি বেশ গোলমেলে। তার কাঁচা বয়স দেখে গোগো সর্দাররা খুবই লোভের চোখে তার রাজ্যের দিকে তাকাচ্ছে।
সবেমাত্র ছাউনি ফেলেছি, আর তখনই গর্জন শোনা গেল, চারদিক থেকে রণভেরি বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ল দিকে দিকে যুদ্ধের চেতাবনী সহ দূত ছুটে যাচ্ছে। প্রথম যখন শুনলাম যে শিঙ্গে ফুঁকে সব মানুষকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে ও যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে বলা হচ্ছে, তখন আমি আধা-সন্দেহ করেছিলাম যে হয়ত আমাদের দলের উপর একটা আক্রমণ হতে চলেছে; তবে "উরুগু, ওয়ারুগু" —(চোর! চোর!) — শব্দগুলো ছড়িয়ে পড়ছিল, তার থেকেই কারণটা বোঝা যাচ্ছিল। এখান থেকে উত্তর-পূর্বে দুদিনের পথ দূরে একটা জনবহুল জায়গার সর্দার হল মুকোনডোকু। পশ্চিম দিকে যাওয়ার সময় সেখানে কিঞ্চিৎ ঝামেলার মুখোমুখি হয়েছিলাম। সেই মুকনডোকু তরুণ রাজা কিওয়েহকে আক্রমণ করতে আসছে। আর কিওয়েহের সৈন্যদের তাই যুদ্ধে ডাকা হচ্ছিল। ছেলেরা সব নিজেদের গ্রামে ছুটে গেল, অল্পক্ষণের মধ্যেই তাদের পুরো লড়াইয়ের পোশাকে সেজে আসতে দেখা গেল। উটপাখি, ঈগলের পালক তাদের সামনে দুলছে, তাদের মাথা ঘিরে জেব্রার কেশর; তাদের হাঁটু ও গোড়ালি থেকে ছোট ছোট ঘন্টা ঝুলছে। তাদের গলার থেকে চাদর ঝুলছে; বর্শা, অ্যাসেগাইস, গেঁটেলাঠি, ও ধনুক তাদের মাথার উপরে দেখা যাচ্ছে, বা ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় তাদের ডান হাতে ধরা। মূল গ্রামের থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিটা বড় বড় দল দ্বিগুণ-দ্রুত তালে দুলতে দুলতে আসছিল, তাদের সকল গোড়ালি, হাঁটুর ঘণ্টা ভারি প্রশংসনীয় ভাবে ঐক্যতানে ধ্বনিত হচ্ছিল। তাদের ঘিরে ছিল লড়াইয়ের মেঘ। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্সাহী যারা, তাঁরা নকল যুদ্ধ করতে করতে ছুটে যাচ্ছিল। প্রতিটি গ্রাম থেকে আসা দলের পর দল সৈন্য আমাদের শিবিরের পাশ দিয়ে ছুটে গেল - সম্ভবত, প্রায় এক হাজার সৈন্য যুদ্ধে গিয়েছিল। জাঞ্জিবার ও উন্যানিয়েম্বের মধ্যে চলা সবচেয়ে বড় কাফেলারও দুর্বলতার দিকটা এই ঘটনার চেয়ে ভাল করে আর কিছু থেকে বুঝিনি।
রাতের বেলা যোদ্ধারা সব জঙ্গল থেকে ফিরে এল; বোঝা গেল বিপদাশঙ্কার কোন ভিত্তি নেই। প্রথমে সাধারণভাবে বলা হয়েছিল যে আক্রমণকারীরা হেহে। চৌর্যবৃত্তির প্রবণতার জন্য তাদের অপমানসূচক ডিরিগো বলেও ডাকা হয়। হেহেরা প্রায়শই উগোগোর বিপুল গবাদি সম্পদের উপর আক্রমণ চালায়। নিজেদের দেশ থেকে দক্ষিণ-পূর্বে যায়, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দিয়ে এগোয়, আর যখন পশুর পালের কাছে আসে, তখন তারা ষাঁড়ের চামড়ার ঢাল দিয়ে নিজেদের ভাল করে ঢেকে বসে পড়ে। গবাদি পশু ও তাদের পালকদের মাঝখানে এসে, তারা আচমকা উঠে দাঁড়ায় আর হৈ হৈ করে গবাদি পশুগুলোকে জঙ্গলের দিকে তাড়াতে শুরু করে, আর আগেই দায়িত্ব দিয়ে রাখা লোকদের হাতে পশুর পালকে তুলে দেয়। তারপর ক্ষিপ্ত রাখালদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য তারা ঢাল বাগিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ।