সারমেয় সংবাদ। (নাটক)
চরিত্রলিপি–
বাঘা - একটি পথবাসী সারমেয় ।
চার্লি – একটি যত্নে পালিত গোল্ডেন রিট্রিভার সারমেয়।
নিশুতি রাত।চারিদিক নিস্তব্ধ। কেবল থেকে থেকে ঝি ঝি পোকার পাখনা ঘষার শব্দ ভেসে আসে। এপাশে ওপাশে ভালো করে নজরদারি করে একটা কানা গলির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে বাঘা। অন্ধকারে গায়ের পাটকেল রঙ ঠিকমতো বোঝা যায় না। সন্তর্পনে ধীর পায়ে রাস্তা পার হয়ে মুখার্জি ম্যানসনের একতলার বারান্দার সামনে এসে দাঁড়ায়। গ্রিল ঢাকা বারান্দায় একটা সতরঞ্চির ওপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে খানদানি সারমেয় চার্লি। বাঘা ঠিক বারান্দার সামনে আসে আর তারপর মৃদু কন্ঠে বলে —
বাঘা - এই চালিয়াৎ, চালিয়াৎ। জেগে আছিস্ , নাকি ভরপেট গিলে কুটে ভসভসিয়ে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছিস? এই চালিয়াৎ,চালিয়াৎ…..
চার্লি -[ নিঁচু স্বরে ডাকে] ভোউ । আমি তোর্ সঙ্গে কথা বলবো না।
বাঘা – কেন,কেন ? আমি কী অন্যায় করলুম?
চার্লি – একথা আবার জিজ্ঞেস করছিস্? আমার নামটাই তো ঠিক করে প্রোনাউন্স করতে পারিস্ না। আমার নাম হলো চার্লি। আর তুই আমাকে ডাকিস চালিয়াৎ বলে। ছিঃ। তুই আমাকে এমন নামকরণ করেছিলেন শুনলে ম্যাডোনা আমার কাছে আর আসবে ভেবেছিস্ ?
বাঘা – ওহ্! এই বেত্তান্ত! আমি তো ভাবলুম কি না কি ভুল বললাম। আরে,তুই একটা ইস্টুপিড। কোনো মজাই ধরতে পারিস না।
চার্লি – কি ? তুই আমাকে গাল দিচ্ছিস? আর কথাটা মোটেই ইস্টুপিড নয় স্টুপিড। এস . টি .ইউ . পি . আই . ডি . এটা একটা ইংলিশ শব্দ। এর মানে হলো বোকা। বুঝলি হাঁদারাম?
বাঘা – [ স্বগোতোক্তি ] দেখো কাণ্ড ! এক বোকা আর এক বোকাকে বোঝাচ্ছে ! [ তারপর বেশ গদগদ হয়ে বলে ] তুই কতো জানিস্ রে চালিয়াৎ থুরি চাল্লি। ভালো পরিবেশে, নেকাপড়া জানা মানুষ জনের সঙ্গে দিনভর ওঠাপড়া করলে চেহারা চরিত্তিরে কেমন একটা জলুস লাগে ! আমি হলাম পথে পথে খেটে খাওয়া,খুঁটে খাওয়া এক সামান্য শ্রমজীবী সারমেয় । সারাদিন লোকের ঠেলা গুঁতো খাই, আমি কি করে তোর্ মতো জানবো বল?
চার্লি – পথে এসো বাছাধন,পথে এসো। এ কথা প্রথমেই মেনে নিলে হতো ! আমি হলাম সোনালি রিট্রিভার। জন্মসূত্রে আমি খাঁটি স্কটিশ বুঝলি ? এজন্যই না এ বাড়ির লোকজন এতো খাতির যত্ন করে রাখে আমাকে।
বাঘা – তা আর বলতে! [ একটু খাটো গলায় বলে ] গলা বাড়িয়ে এই কথা আর জোর করে বলতে হবে না, গলায় দামি বকলসের দগদগে দাগ দেখে সহজেই খাতিরের বহর দিব্যি টের পাওয়া যায়।
চার্লি – [ সামান্য রাগত কন্ঠে বলে ] বাঘা , তুই বড়ো কুচুটে স্বভাবের। আমার এমন সুন্দর সোনালী পশমে ঢাকা শরীর ছেড়ে শেষমেশ তুই আমার গলার দাগ নিয়ে পড়লি? তোর্ সাথে আর কথা কইবোনা। হু ! [ বিরক্ত হয়ে স্বগোতোক্তি ]
মিস্ ম্যাডোনা কি সাধে এই street proletariat দের সঙ্গে কথা কইতে বারণ করে ! সময়গময়ের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই, এই দুকুর রাতে উনি এয়েছেন পিরীতি করতে! যা ভাগ্ ।
বাঘা – সে তো যাবোই। আমার তো আর গলায় বাঁধা শেকলের টান নেই! আমি বিলকুল স্বাধীন। তাই যেখানে খুশি, যখন খুশি যাইতে পারি। আমার কোনো পিছুটান নেই। এতোদিন এদেশে আছিস,অথচ মনটাকে এখনো এখানকার মতো করে গড়েপিটে নেবার চেষ্টা করলি না। কোন্ কালে সাহেবদের পিছু পিছু এদেশে এসেছিল তোদের বাপ - ঠাকুদ্দা। সে গপ্পো এখনও ভেজে যাচ্ছিস্! আরে বাপু!তুই না হলি, ঘরকা না ঘাটকা! তোরা সব ট্রেসপাসার।
চার্লি – এই বাঘা, আমাকে অন্য ভুঁই এর ডগি পেয়েছিস বলে আবোলতাবোল কিছু বলবিনা কিন্তু! তোকে বারণ করেছি।
বাঘা – বোঝো ঠ্যালা! এই একটু আগে নিজের স্কটিশ পেডিগ্রি নিয়ে কত কথাই না বললি,আর এখন ট্রেসপাসার্ কথাটা শুনে ভিরমি খাচ্ছিস? তাজ্জব কি বাত বড়ে মিঞা।
চার্লি – না, আমরা মোটেই অনুপ্রবেশকারী নই। আমরা হলাম, আমরা হলাম….. অতিথি, গেস্ট। অনুপ্রবেশকারী আর অতিথি – কথা দুটোর ফারাক বুঝিস্ ? থাকিসতো রাস্তায়, চাল নেই, চুলো নেই , বাঁধা ঠিকানা নেই – ভবঘুরেদের মতো এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে ঘুরে বেড়াস্ , লোকজনের ফেলে দেওয়া এঁটো খাবার খাস্ , নিজেদের মধ্যে অহেতুক মারামারি, খেয়োখেয়ি করিস্ , আর লোকজনকে কামড়ে দিয়ে বিপদ বাঁধাস্ !
বাঘা – একদম ঠিক কথা বলেছিল। আমাদের তো আর গলায় বকলস্ পরে, মালিকের করুণার ক্রীতদাস হয়ে থাকতে হয়না। আমরা সবাই শ্রমজীবী এবং পুরোদস্তুর সংগ্রামী। লোকজনের অফুরান ভালোবাসাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। অবশ্য সবাই তো আর সমান ভালো সারমেয় নয়। তার ওপর শিক্ষা ও সংস্কৃতির স্তরে বিস্তর ফারাক রয়েছে। তাই কখনোসখনো মারধর আর লাঠির বাড়ি খেতে হয় বৈকি! তবুও যখন দেখি আমাদের নড়াচড়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে তোর্ ঐ ঘোঁতন দাদার মতো কেউ নেই, তখন কপালে জুটে যাওয়া লাথি- গুঁতোর কথা বেমালুম ভুলে যাই, বুঝলিরে চালিয়াৎ!
চার্লি – তোরা আর বদলাবি না। নিজেদের গুমরে গুমরিয়েই বেঁচে থাকতে হবে তোদের। এই তো শুনলাম রাস্তা থেকে তোদের ধরে নিয়ে যাবার ফরমান জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এবার বুঝবি ঠ্যালা! কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে খালি খালি রাস্তায় রাস্তায় বেলেল্লাপনা করে বেরানো তোদের।
বাঘা – বুকের মধ্যে থাকা বড়ো নরম দুঃখের জায়গায় ধাক্কা দিলিরে ভাই , বড়ো দুঃখের জায়গায় ঘা দিলি। তোর্ আর দোষ কোথায় বল্? সারাদিন ঐ ঘোঁতনা ঘোষের তদারকিতে থাকিস। ওতো নিজেই নিজেকে বড়ো মুরুব্বি ভাবে। ভালো কথা ওর মুখে আসেনা। ঐসব ছাইপাঁশ খায় ।আর তাই যতোসব ময়লা, নোংরা শব্দ ওর মুখ থেকে এখন তোর মুখে এসে বাসা বেঁধেছে। আমাদের মতো তুইও যে পরিস্থিতির শিকার, সেকথা কি আর বুঝিনা ভেবেছিস্ ? খুব বুঝতে পারি। তবে একথা বলেছিস্ বলে পাল্টা কোনো কুকথা আমি কইবোনা তোকে। বাঘা এখন অনেক অনেক বদলে গেছে।
চার্লি – সরি ভাই। আমি তোকে দুঃখ দিতে চাইনি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। আসলে আমিও যে খুব বেশি সুখে নেই। সারাদিন একা একা থাকতে হয়। ম্যাডোনকে আমার কাছে ঘেঁষতে দেয়না । কারও সঙ্গে যে মন খুলে একটু সুখ দুখের কথা কইবো তারও জো নেই। তোরা বাঁচিস্ দুঃখের সঙ্গে লড়াই করে করে, আর আমাদের টিকে থাকতে হয় দুঃখটাকে আড়াল করে। ফারাক শুধু এটুকুই।
বাঘা – জানিস চার্লি , অনেক অনেক বার ভেবেছি এই মহল্লা ছেড়ে দূরে, অনেক দূরের কোনো আস্তানায় ঠাঁই নিই।পারিনি, কেন পারিনি জানিস?
চার্লি – কেন পারিস্ নি রে বাঘা ?
বাঘা – কীকরে এতো এতো বন্ধুর ভালোবাসার বাঁধনকে ছিঁড়ে চলে যাবো বলতো? আমাদের সঙ্গে থাকে ডজন খানেক মার্জার আর মার্জারি। ওরাতো আমাদের মতো মারকুটে স্বভাবের নয় । তাই ওদের নিয়ে হৈচৈ কম। এই আমাকেই দেখ।কেষ্ট ঠাকুরের অষ্টোত্তরো শত নামের মতো আমারই তো কত নাম। এগুলো তো আমাকে ভালোবাসে বলেই দিয়েছে।
চার্লি – বলিস্ কিরে বাঘা! অনেক নাম!
বাঘা – এই দেখনা! এ পাড়ায় তোরা সবাই আমাকে ডাকিস্ বাঘা বলে ; যেই এই গলি ছেড়ে পাশের গলিতে ঢুকবো অমনি আমার নাম হয়ে যাবে সদাশিব। আবার কেউ ডাকবে ডাকু বলে। আসলে আদর আর ভালোবাসা তো কোনো একটা বিশেষ নামের মধ্যে ডুবে থাকেনা, তার বিস্তার অনেকটা এলাকা জুড়ে। আমি ভাগ্যবান যে এতোজনের ভালোবাসার টানে আমি এখানেই আটকে রয়েছি এতো এতো কাল।
আমরা সারমেয়রা হলাম মানুষের প্রথম বশ্য,বুনো থেকে গৃহপালিত হয়ে ওঠা প্রথম সহচর।
চার্লি – তাহলে মানুষেরা তোদের মানে আমাদের এমন করে তাড়িয়ে দিতে চাইছে কেন ? কেন বলছে দেশের রাজধানী শহরের রাস্তা থেকে ডগিদের বিদায় দিতে হবে ?
বাঘা – এটাই তো দুঃখের বিষয়। এটা তো এতোদিনের সহাবস্থানের আদর্শকেই বিসর্জন দেবার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ? আমরা নাকি নিজেদের মধ্যে মারামারি করি,এতে নাকি রাস্তায় লোকজন চলাচল করতে পারে না। আরে বাপু! যাকে তোমরা মারামারি বলে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছো সেটাতো আমাদের শ্রেণি সংগ্রাম – class struggle.
চার্লি – এই, এই, এই বাঘা তুই কি বললি রে ? আরেক বার বলনা! এই কথাটা নতুন শুনছি বলে মনে হচ্ছে।
বাঘা – ব্যাপারটা জটিল। জানতে চাইছিস যখন তখন নিশ্চয়ই বলবো। তবে কী করে বোঝাব তোকে বলতো? আসলে শ্রেণি সংগ্রাম হলো একটা লড়াই, বোঝাপড়ার লড়াই। প্রত্যেক সমাজেই এমন লড়াই চলছে। আমাদের সমাজের কথাই ধর। আমাদের মধ্যে কিছু বন্ধু আছে যারা কর্তাদের বিশেষ অনুগ্রহ পায়। এদের কপালে রোজই ভালোমন্দ জোটে। রাজানুগ্রহ পুষ্ট এইসব স্বজাতীয়দের সঙ্গেই আমাদের সংগ্রাম, বেঁচে থাকার লড়াই। এমন লড়াই তোমরা লড়ো না নিজেদের ক্ষমতাকে জাহির করতে?
চার্লি – এই ব্যাপার? না শুনছিলাম তোরা লোকজনের ওপর হামলা করেছিস্ ? তাতে মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে মানুষের !
বাঘা – মানুষদের মতো বিষয়টাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে যেতে চাই না। এমন কিছু ঘটে থাকলে তার জন্য আমি দুঃখিত। দেওয়ালির সময়ে অবলা প্রাণির লেজে পটকা বেঁধে উল্লাস করে যাঁরা তাদের কাছে সমবেদনা পাওয়ায় আশা আমাদের নেই।
[ এমন সময় দূর থেকে ভেসে আসে ঘেউউউউ ডাক। বাঘা সচকিত হয়ে ওঠে।…]
বাঘা – ঐ যে ভোলু হাঁক দিতে শুরু করেছে। ভোর হতে আর বিশেষ বাকি নেই। চালিয়াৎ, সরি চার্লি আজ তাহলে চলি। অনেক সুখ - দুঃখের কথা হলো। কথা বলতে পেরে বেশ খুশি হলাম। এভাবে কথা বলতে পারলে শরীর আর মন দুইই ভালো থাকে। শঙ্কা আর ভয় নিয়ে বেঁচে থাকা যায়না। জীবনে সংকট আসে, তাকে কাটিয়ে উঠতে গেলে চাই লড়াইয়ের শপথ।
চার্লি – দারুণ বললিরে বাঘু, দারুণ বললি শেষ কথাটা – লড়াইয়ের শপথ। তোদের শঙ্কা কেটে যাক্। সুখের দিন আসুক তোদের জীবনে।
বাঘা – [ হাত মেলানোর মতো করে সামনের পা টা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাড়িয়ে দেয় চার্লির উদ্দেশ্যে। ] সুখ নয় স্বস্তি চাই। সুখের থেকে আমার দুখই ভালো। অবাক হলি বুঝি?
চার্লি – তা একটু হলাম বটে! সুখ চাইছিস্ না?
বাঘা – সুখ পরস্পরের মধ্যে ব্যবধান তৈরি করে। অতি চেনা জনও তখন অচেনা হয়ে যায় সুখের ছোঁয়া লেগে। বরং দুঃখ কাছে টেনে আনে। এই যে আজ আমাদের দুঃখে তুই কেমন সুন্দর পাশে এসে দাঁড়ালি। সমস্ত অচেনার ব্যবধান নিমেষেই ঘুচে গেল। বেশ স্বস্তি বোধ করছি এখন।
[ আবারও ঘেউউউ শব্দ ভেসে আসে ..]
বাঘা – আরে বাপু একটু সবুর কর।আসছি। চলিরে চার্লি। স্বস্তিতে থাকিস। আবার দেখা হবে।
[ বাঘা নিজের ঠিকানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। যেতে যেতে উচ্চকন্ঠে আবৃত্তি করে –
…..
আমাদের ঘর গেছে উড়ে
আমাদের শিশুদের শব
ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে।
আমরাও তবে এইভাবে
এ- মুহূর্তে মরে যাবো না কি?
আমাদের পথ নেই আর
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ।
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।
[ নেপথ্যে ভেসে আসে অনেক অনেক সারমেয়র উল্লাস রব]
যবনিকা
উৎসর্গ
সেই ছোটবেলা থেকে যাঁদের অভিনয় দেখে বড়ো হলাম সেই মাধু দি আর খুকু দি কে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।