ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে উকাওয়েন্ডি, উভিনযা ও উহহা-র মধ্য দিয়ে উজিজি যাত্রার বর্ণনা। তরজমা স্বাতী রায়
২৯ অক্টোবর শিবির এলাকা ছাড়লাম, আর কয়েক মিনিট পরে, আফ্রিকায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর-সুন্দর দৃশ্যগুলোর মুখোমুখি হলাম। এই জায়গাটায় অজস্র গভীর, বন্য ও সরু গিরিখাত, সব দিকেই আছে তবে সাধারণত উত্তর-পশ্চিম দিকে সব থেকে বেশি। দুপাশেই বিশাল বর্গাকার নগ্ন শিলার (বেলেপাথর) স্তূপ, কখনও উঁচু ও গোল, কখনও পিরামিডের মত, কখনও মাথা-ছাঁটা শঙ্কুর মত, কখনও গোল গোল গিরিশিরা, যাদের গা গুলো ধারালো, রুক্ষ আর নগ্ন। সামান্য গাছপালাও চোখে পড়ে না কোথাও, একমাত্র ব্যতিক্রম হল কিছু বিশাল-আকারের পাহাড়ের চূড়ার মাথা, সেখানকার ফাটলের মাঝে জমা মাটিতে তাদের অনিশ্চিত উপস্থিতি। অথবা চোখের সামনে সর্বত্র হাজির যে লালচে গেরুয়া খাড়া দেওয়ালের মত উঠে যাওয়া পাহাড়, তাদের গোড়ায় যা একটু আধটু সবুজ দেখা যায়।
পাথুরে জলখাত ধরে নিচে নামছি তো নামছি। গোটা জায়গাটাই নুড়ি পাথরের ভরা। শেষে আমরা এসে পৌঁছলাম একটা শুষ্ক, পাথুরে উপত্যকায়। আমাদের চারদিকে হাজার ফুট উঁচু সব পাহাড়ের রাজত্ব। যে গিরিখাতটা ধরে আমরা চলছি, সেটা চারদিকে পাক খেতে খেতে নামছে, ধীরে ধীরে আরও চওড়া হচ্ছে আর শেষে এটা ছড়ানো সমভূমিতে পরিণত হয়েছে, তার ঢাল পশ্চিমে। রাস্তাটা, খাত ছেড়ে, উত্তরদিকে একটি নিচু গিরীষিরায় গিয়ে পৌঁছেছে। সেখান থেকে একটা পরিত্যক্ত জনবসতি দেখা যায়। এখানে গ্রামগুলো ভীষণদর্শন দুর্গের মত পাথরের উপর তৈরি। কাছেই একটা প্রায় সত্তর ফুট উঁচু আর প্রায় পঞ্চাশ গজ ব্যাসের পাথর। এতই বড় যে পাশের একটা দৈত্যাকৃতি ডুমুর গাছকেও তার পাশে বামন বলে মনে হচ্ছিল। সেই পাথরের উপর আমরা তাঁবু খাটালাম। সেদিন তার আগে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা একটানা দ্রুত হাঁটা হয়েছিল ।
সবাই খুব ক্ষুধার্ত, বিশ ঘণ্টা আগে তারা ভাঁড়ার নিঃশেষ করে মাংসের কুচি আর শস্যদানা খেয়েছে, আর এখুনি খাবার পাওয়ারও কোনও সম্ভাবনা নেই। আমার কাছে দেড় পাউন্ড মতন ময়দা পড়ে ছিল, পঁয়তাল্লিশেরও বেশি মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি করার জন্য তা মোটেই যথেষ্ট না, তবে আমার সঞ্চয়ে ত্রিশ পাউন্ড মতন চা, আর বিশ পাউন্ড চিনি ছিল। শিবিরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই আমি সবকটা কেটলিতে জল ভরে আগুনে চাপাতে বললাম, আর তারপরে সবার জন্য চা তৈরি করা হল। প্রত্যেকে এক কোয়ার্ট করে গরম, প্রচুর মিষ্টি দেওয়া পানীয় পেল, সকৃতজ্ঞ ভাবে নিল। বন্য ফলের সন্ধানে অনেকেই জঙ্গলের গভীরে চুপিচুপি হানা দিল, আর ঝুড়ি ভরে পীচ আর তেঁতুল নিয়ে এলো। মন না ভরলেও, খানিকটা স্বস্তি এলো। সেই রাতে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে, এনগোওয়ানারা 'আল্লাহর' কাছে উচ্চস্বরে প্রার্থনা করল। তাদের খাবার যোগানোর জন্য।
আমরা খুব ভোরে উঠলাম, একদম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে খাবার না পাওয়া যাওয়া অবধি আমরা হাঁটব । অথবা যতক্ষণ না তুমুল ক্লান্তি ও দুর্বলতায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ছি ততক্ষণ অবধি । অনেক গন্ডারের পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে, আর অনেক মোষও আছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু একটাও জ্যান্ত প্রাণী চোখে পড়ছে না। ছোট ছোট খাড়াই ভেঙ্গে উঠছি। আর মাঝেমাঝেই শুকনো, পাথুরে জলখাতের গভীরে গিয়ে নামছি । শেষে একটা উপত্যকায় পা রাখলাম, সেটার একদিকে একটা ত্রিভুজাকার পর্বত যার গাটা খাড়া উপরে উঠে গেছে আর অন্য দিকে তিনটে পাহাড় বেশ দল বেঁধে দৃপ্তভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। উপত্যকার শুকনো, ফ্যাকাসে চেহারার মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম শীঘ্রই তার চেহারা বদলে ঝলমলে সবুজ হয়ে গেল - দূরে একটা জঙ্গল দেখা যাচ্ছে । অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা নিজেদের একটা ভুট্টার ক্ষেতে আবিষ্কার করলাম। চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছি আর একটা কোন গ্রাম খুঁজছি, ডানদিকের উঁচু ত্রিভুজাকার পাহাড়ের চূড়ায় একটা গ্রাম চোখে পড়ল। সেই দেখেই একটা উচ্চকিত উল্লাসধ্বনি উঠল। কুলিরা সব বোঝা ফেলে দিল, আর খাবারের জন্য হল্লা-চিল্লা করতে লাগল। যারা ওই পাহাড়ের মাথায় উঠে ওই গ্রাম থেকে যে কোন দামে খাবার নিয়ে আসতে রাজি, তাঁদের এগিয়ে এসে কাপড় নিয়ে যেতে বলা হল। তিন-চারজন ঝাঁপিয়ে পড়ে রওনা দিল। আমরা মাটিতেই বসে পড়লাম বিশ্রাম নিতে, সকলেরই বেশ কাহিল অবস্থা তখন।
প্রায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমাদের খাদ্য সন্ধানী দলটি দারুণ খবর নিয়ে ফেরত এলো। অনেক খাবার আছে; যে গ্রামটা আমরা দেখেছি তার নাম ‘ওয়েলড এনজোগেরাস’— এনজোগেরার ছেলে— নাম থেকেই, অবশ্য, বোঝা গেল যে আমরা উভিনজাতে আছি, এনজোগেরা উভিনজার প্রধান সর্দার। এও জানানো হয়েছিল যে মালাগারজির উপত্যকার কিছু লবণ-তৈরির জমি নিয়ে লোকান্দা-মিরার সাথে এর বাবা এনজোগেরার যুদ্ধ চলছিল আর এই যুদ্ধের কারণে মূল রাস্তা দিয়ে উজিজিতে যাওয়া কঠিন হবে, তবে কিনা উপযুক্ত মূল্য পেলে এনজোগেরার ছেলে আমাদের গাইড সরবরাহ করতে পারে, তারা আমাদের নিরাপদে একটা উত্তর দিকের রাস্তা ধরে উজিজিতে নিয়ে যাবে।
সবকিছুই বেশ ভালই চলছিল, আমরাও ভাল করে আনন্দ উপভোগ করার জন্য শিবির খাটালাম, উকাওয়েন্দির বন-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আসার শুরুর থেকে যা সব ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট পুইয়েছি, তারপর এই আনন্দটুকুই ঢের।
তারপরে শুরু হল এক কূটনৈতিক আলোচনা। এনজোগেরার ছেলে সাধারণত ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে কতটা কাপড় আর কেমন কাপড় নেয় সেই বিষয়ে দরাদরি! শুরুর দশ ডটি কাপড়ের দাবির থেকে, শেষে সাড়ে সাত ডটি মেরিকানি ও কানিকিতে চাহিদা কমিয়ে আনা গেল আর সেই সঙ্গে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গাইডও জোগাড় করতে পারলাম।
এবার আমি হাঁটার সময়ের ডায়েরির শরণাপন্ন হচ্ছি। এর সাহায্য ছাড়া, মনে হয় আমাদের বিভিন্ন সব অভিজ্ঞতা যেমন যেমন ঘটেছিল তা পুরোপুরি বর্ণনা করা অসম্ভব। প্রতিটা দিনের শেষে সেদিনের ঘটনার নির্যাসগুলি লিখে রাখা হত। তাই আমার মতে, স্মৃতিতে ধূসর হয়ে যাওয়া শীতল তথ্যের তুলনায় সেই ডায়েরির টাটকা লেখা বেশি কৌতূহলোদ্দীপক হবে ।
(ক্রমশ...)