ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্ব থেকে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালা শুরু। তরজমা স্বাতী রায়
উপরের (এর আগের কিস্তিতে প্রকাশিত) চিঠিতে আমার আর নতুন করে জোড়ার কিছুই নেই - এটা নিজেই সব বলে দিয়েছে; তবে তখন আমি ভেবেছিলাম যে এটা আমার সাফল্যের সব থেকে বড় প্রমাণ। আমার নিজের কথা বলতে, আমার তাঁর আবিষ্কার সম্পর্কে এক বিন্দুও মাথাব্যথা নেই, একমাত্র যতক্ষণ না যে সংবাদপত্র আমাকে এই অনুসন্ধানের জন্য দায়িত্ব দিয়েছিল, তারা সেই বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে। তবে একথা সত্যি যে তাঁর ভ্রমণের ফলাফল সম্পর্কে কৌতূহল ছিল; তবে, তিনি যখন স্বীকার করেছেন যে তাঁর শুরু করা কাজ এখনও সম্পন্ন হয়নি, তখন থেকে আমি স্বেচ্ছায় যতটুকু বলেন তার বেশি এই নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে কুণ্ঠাবোধ করেছি। তাঁর আবিষ্কারগুলি তাঁর নিজের শ্রমের ফল, তার নিজস্ব ধন— সে বিবরণ প্রকাশ করে তিনি যা কিছু পুরষ্কার পাবেন বলে আশা করেছিলেন, সে সব তাঁর সন্তানদের উত্তরাধিকার হিসেবে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তবুও লিভিংস্টোন শুধুই সামান্য কটা টাকা পাওয়ার কথাই ভাবেননি। তাঁর আরও বড় , আরও মহৎ উচ্চাকাঙ্খা ছিল। এটাই যেন তাঁর কর্ম নির্দেশ! বিমূর্ত নির্দেশের তিনি স্বেচ্ছা-দাস। তাঁর কাজের প্রতি অনুরাগ তাঁকে বাড়িছাড়া করেছিল। বাড়ির প্রতি টান কাটাতে মানুষের খুবই মনের জোর লাগে। নতুন জায়গায় প্রতি পদক্ষেপে তিনি মানুষকে সহমর্মিতার বন্ধনে বেঁধেছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টা পরবর্তীকালে খ্রিস্টান দেশগুলিকে এই গ্রীষ্মমন্ডলীয় আফ্রিকার হিদেনদের সঙ্গে প্রেম ও দয়ার বন্ধনে বেঁধে রাখবে। এই প্রেমবন্ধনটি যদি তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেন – তাঁর আবিষ্কারের কাহিনী, অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ ও সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন্ত বিবরণী যদি তাঁর নিজের দেশের মহান দয়ালু মানুষদের এদের মুক্তি ও পরিত্রানের উদ্দেশ্যে নড়ে বসতে উৎসাহ দেয় - লিভিংস্টোন সেটাকেই যথেষ্ট পুরষ্কার বলে ভাববেন। ‘‘যত সব বোকা বোকা, পাগলের মতন কারবার ! পুরো কিহোতের মতন কাজ!’’ অনেকেই তাই বলবে। না বন্ধুরা; সূর্য খ্রিস্টান-কাফের, সভ্য-অসভ্য সবার উপরেই সমান ভাবে আলো ঢালে এও যেমন সত্য, সেই আলোকোজ্জ্বল দিনও ততটাই নিশ্চিতভাবে আসবে; আর যদিও আফ্রিকার দূত হয়ত নিজে সেটা দেখতে পাবেন না, হয়ত আমরা তুলনায় কমবয়সীরা, বা এমনকি আমাদের সন্তানেরাও হয়ত তা দেখবে না, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেটা দেখতে পাবে। আর সেই ভবিষ্যৎ নিশ্চয় এই সভ্যতার দুঃসাহসী অগ্রদূতকে স্বীকৃতি দেবে।
নিচের কথাগুলো পুরোটাই আমার ডায়েরি থেকে নেওয়া:
১২ ই মার্চ।-আরবরা আমাকে উপকূলে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায় পঁয়তাল্লিশটা চিঠি পাঠিয়েছে। পরের দিনগুলোতে আমি পত্রবাহক হয়ে গেলাম; তবে তার আসল কারণ হল মিরাম্বোর সঙ্গে যুদ্ধ চলার জন্য নিয়মিতভাবে এই পথে কোন কাফেলার যাতায়াতের অনুমতি নেই। যদি এই গোটা সময়টা উন্যানয়েম্বেতে বসে থাকতাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার আশায় আশায় তাহলে যে কি হত! আমার তো ধারণা যে আরবরা আগামী নয় মাসের মধ্যেও মিরাম্বোকে হারাতে পারবে না।
আজ রাতে স্থানীয়রা আমার বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছে। আমার জন্য বিদায়-নাচ হবে। দেখলাম, এরা সেই এমটেসাদের সর্দার সিঙ্গিরির কাফেলার কুলিরা। আমার লোকেরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিল, আর আমি নিজেও গানের সুরে মজে আটকে গেলাম, ওদের সঙ্গে যোগ দিলাম আর একটু হালকা নেচে নিলাম। আমার দলের বীরপুরুষরা তো একেবারে হাঁ, আর কর্তাকে তার চিরাচরিত কেঠোভাবের থেকে খানিকটা সরতে দেখে দারুণ খুশিও হল।
এটা একটা পুরো বন্য নাচ। গানটা চনমনে, চারটে ঢাকের সুরেলা ধ্বনির থেকে উঠে আসা। একটা অদ্ভুত বৃত্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারজন মানুষ ওই সামনে রাখা ঢাকগুলো বাজাচ্ছে। বোম্বেকে অন্যসময় ততটা হাস্যকর না লাগলেও মৃমাদের নাচের সময় চিরকালই হাস্যকর লাগে। সে মাথায় আমার জলের বালতিটা চাপিয়েছে; দৃঢ়, ক্ষিপ্রগতির, নিশ্চিত-পদক্ষেপের চৌপেরেহের হাতে একটা কুড়াল আর মাথায় একটা ছাগলের চামড়া পরেছে; বারাকা আমার ভালুকের চামড়াটা পরে আছে, আর একটি বর্শা নিয়েছে; ষাঁড়ের মত মুন্ডুওলা মাব্রুকি একেবারে ব্যাপারটা অন্তঃস্থ করে নিয়েছে, আর একটা গম্ভীর হাতির মতো হাঁটাচলা করছে; উলিমেঙ্গোর একটা বন্দুক আছে, একটা ভয়ঙ্কর ড্রক্যান্সির, মনে হবে যেন সে লাখখানেক লোকের সঙ্গে লড়াই করতে চলেছে, এমনই ভয়ানক লাগছে তাকে দেখতে; খামিসি ও কামনা রয়েছে ঢাকিদের সামনে, পিঠোপিঠি, আকাশের তারার দিকে পা ছুঁড়ছে যেন; বিশাল শক্তির মূর্ত প্রতীক আসমানির হাতে একটা বন্দুক, সে যেন এক বিশালবপু টাইটান, হাতের বন্দুকটা সে বাতাসে এমন ঘোরাচ্ছে, যেন সে সাক্ষাৎ থর, হাতুড়ি দিয়ে অযুত হত্যালীলায় মেতেছে। সবার সব বিচক্ষণতা, উৎসাহ সব কিছু আপাতত স্থগিত; নক্ষত্রের স্বর্গীয় আলোর নীচে আমরা যেন অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে মেতেছি, ড্রামের দুর্দম শক্তিতে বলীয়ান হয়ে, সেই বজ্রধ্বনির তালে তালে নেচে উঠে যেন একটা অদ্ভুত নাটকের অংশবিশেষকে মঞ্চস্থ করছি।
একটা যুদ্ধসঙ্গীত শেষ হয়, আরেকটা শুরু হয়। গায়ক মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়েছে, আর মাটি খোঁড়ার মতন করে দু তিনবার মাথা নামাচ্ছে, সঙ্গের দোহাররা, তারাও মাটিতে বসে, মন্থর ও গম্ভীর গানের ধুয়োর শেষ শব্দগুলো মর্মস্পর্শী সুরে গাইছে। শব্দগুলো আক্ষরিক অনুবাদে এইরকম:
মূল গায়ক: ওহো ওহো ওহো! সাদা মানুষ বাড়ি ফিরে যাচ্ছে!
দোহাররা: ওহো ওহো ওহো! বাড়ি ফিরে যাচ্ছে!
ফিরে যাচ্ছে, ওহো ওহো ওহো!
মূল গায়ক: সমুদ্রের মাঝের সুখের দ্বীপে,
যেখানে পুঁতি অগণন, ওহো ওহো ওহো!
দোহাররা: ওহো হো হো! যেখানে পুঁতি অগণন,
ওহো ওহো ওহো!
মূল গায়ক: যখন সিঙ্গিরি আমাদের আটকে রেখেছিল, ওহ, অনেক দূরে
আমাদের বাড়ি থেকে অনেকদূরে, ওহো-ওহো-ওহো!
দোহাররা: আমাদের বাড়ি থেকে, ওহো-ওহো-ওলি!
ওহো-ওহো-ওহো!
মূল গায়ক: আর অনেক দিন ধরে আমাদের কোন খাবার নেই, আমরা আধাপেটায় আছি, ওহো, অনেক দিন ধরে!
বানা সিঙ্গিরি!
দোহাররা: অনেকদিন ধরে, ওহো-ওহো-ওহো!
বানা সিঙ্গিরি-সিঙ্গিরি!
সিঙ্গিরি! ওহ, সিঙ্গিরি!
মূল গায়ক: মিরাম্বো যুদ্ধ করেছে
আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে;
আরবরা ও এনগোওয়ানারা
মিরাম্বোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেছে!
দোহাররা: ওহো-ওহো-ওহো! মিরাম্বোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে!
ওহ, মিরাম্বো! মিরাম্বো!
ওহ, মিরাম্বোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে!
মূল গায়ক। তবে সাদা মানুষ আমাদের খুশি করে দেবে,
সে বাড়ি যাচ্ছে! কারণ সে বাড়ি যাচ্ছে,
আর সে আমাদের খুশি করে দেবে! শ-শ-শ!
দোহাররা: সাদা মানুষ আমাদের খুশি করে দেবে ! শ-শ-শ!
শ- -শ-হ-হ- শ-হ-হ-হ-হ-হ!
উম-ম-মু-উম-ম-ম-শ!
এরকম একটা অনন্য বিদায় আমি সিঙ্গিরির ন্যামওয়েজিদের থেকে পেয়েছি। এর অসাধারণ মহাকাব্যিক সৌন্দর্য, ছন্দময় উৎকর্ষতা ও আবেগী শক্তির জন্য, একে আমার বইয়ের পাতায় অমর করে রাখলাম। উন্যামওয়েজির গণসংগীতপ্রেমী সন্তানদের বিস্ময়কর প্রযোজনাগুলির মধ্যে একটি হিসেবে।