ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালা। তরজমা স্বাতী রায়
১৩ এপ্রিল এমভূমি গ্রাম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সারা রাত বৃষ্টি পড়েছে, সকালেও থামার কোন লক্ষ্মণ নেই। প্লাবন-আক্রান্ত প্রান্তরের ওপর দিয়ে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে আমরা আবার একটা শাখা নদীর ধারে এসে পৌঁছলাম। সেখানে নদী সরু, এবং মাঝখানে গভীর গর্ত। আমরা একটা গাছ কেটে ফেলতে উদ্যোগ নিলাম, অনুমান করলাম যে এটা সরাসরি স্রোতের উপর দিয়ে ওপারে পড়বে। এই কেটে ফেলা গাছের উপর দুপাশে পা ঝুলিয়ে বসে দলের লোকেরা গাঁটরি ও বাক্স সমেত সাবধানে হ্যাঁচর প্যাঁচর করে পেরল। কিন্তু একজন তরুণ মুটে, রজব, অতি উৎসাহে বা নিছক পাগলামিতে- ডাক্তারের বাক্সটি মাথায় তুলে নিল। এই বাক্সের মধ্যে তাঁর চিঠি ও তাঁর আবিষ্কারের জার্নাল ছিল আর নদীতে হাঁটতে শুরু করল। নদী পারাপার তদারকি করার জন্য আমিই সবার আগে ওই পাড়ে পৌঁছেছিলাম। তখন আমি এই লোকটিকে তার মাথায় সবচেয়ে মূল্যবান বাক্সটি নিয়ে নদীর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে দেখলাম। হঠাৎ সে এক গভীর গর্তে পড়ে গেল, বাক্স সমেত লোকটা প্রায় দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। ওই চিঠিপত্র হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি শিউরে উঠলাম। সৌভাগ্যবশত, সে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তখন আমি একটা গুলিভরা বন্দুক তুলে ধরে তাকে চিৎকার করে বললাম, "দেখ! ওই বাক্সটা যদি ফেলে দিস, তাহলে তোকে আমি গুলি করে মারব।"
সমস্ত লোক হাতের কাজ বন্ধ করে দিল। সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা একদিকে বন্যা, আরেকদিকে গুলি দুয়ের চাপে থতমত। সে নিজেই অবাক চোখে পিস্তলটাকে দেখছিল, কিছুক্ষণের মরিয়া চেষ্টার পরে অবশ্য বাক্সটি নিরাপদে তীরে নিয়ে আসতে সফলও হয়েছিল। ভিতরের জিনিসপত্র ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায়, রজব শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। আর কোন কারণেই ফের বাক্সটিকে স্পর্শ না করার হুমকি দেওয়া হল তাকে। তারপর এটা দেখেশুনে পা ফেলা, খুঁতহীন কুলি মাগঙ্গার দায়িত্বে দেওয়া হল।
এই ছোট নদীটির থেকে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে, আমরা প্রধান নদীতে এলাম, তবে এর ফুঁসতে থাকা জলের দিকে একবার তাকানোই যথেষ্ট ছিল। একটা ভেলা তৈরি করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করা হল, কিন্তু চারটে গাছ কেটে সতেজ গাছগুলিকে বেঁধে ঘূর্ণায়মান স্রোতে ঠেলে দেওয়ার পরে তাদের সীসার মতো ডুবে যেতে দেখলাম। তারপর আমরা আমাদের সঙ্গে থাকা সব শক্ত দড়ি এক সঙ্গে বেঁধে ১৮০ ফুট লম্বা একটা দড়ি তৈরি করা হল। তারপর সেটার এক প্রান্ত শরীরে বেঁধে চৌপেরেকে ওপারে পাঠানো হল যাতে সে দড়িটা ওপারে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে দিতে পারে। তাকেও স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে পাকা সাঁতারু। তাই সে সেই স্রোত ঠেলে ওপারে পৌঁছাতে পারল। গাঁটরিগুলোর মাঝখানে কষে দড়ি বেঁধে সেগুলোকে জলে ফেলে দেওয়া হল আর জলের মধ্যে দিয়ে ঠেলে ঠেলে ওপাড়ে নিয়ে যাওয়া হল। এমনকি তাঁবু আর অন্যান্য যা কিছু জলে ভিজলে নষ্ট হবে না সেসবও এই ভাবেই ওপারে গেল। আমি শুদ্ধ আরও অনেক জনকেই এইভাবে ঠেলে পার করানো হল, প্রত্যেকের সঙ্গে সঙ্গে একজন করে দক্ষ সাঁতারু। কিন্তু চিঠির বাক্স বা অন্যান্য মূল্যবান জিনিস কী করা হবে? কেউ কোন উপায় বাতলাতে পারল না। অতএব নদীর দুই পারে দুটো শিবির খাটানো হল। যে পাড় ছেড়ে চলে এলাম, সে পাড়ে একটা বিশাল উই ঢিপি ছিল। বেশ উঁচু মতন। আর আমার পাড়ের দলকে একটা সমতল, কাদা-ভরা জলাভূমি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হল। একটা এক ফুট মতন উঁচু আর তিরিশ ফুট ব্যাসের মাটির পাড় গোল করে আমার শিবিরকে কেন্দ্রে রেখে খাড়া করা হল। আর শিবিরের চারপাশ দিয়ে অন্য সবার আস্তানা তৈরি হল।
এক অসাধারণ, নতুন রকমের জায়গায় রয়েছি। আমাদের শিবিরের বিশ ফুটের মধ্যে একটি ক্রমঃপ্লাবিত নদী – সে নদীর পাড় দুটি সমান, তীর নিচু; আমাদের মাথার উপরে বিষন্ন, ক্রন্দনরত আকাশ; তিন দিকে ঘিরে রয়েছে এক বিশাল জঙ্গল, তার ডালে ডালে অবিরাম বৃষ্টির শব্দ শুনছি; পায়ের নীচে কালো, জঘন্য ও গভীর কাদা; তার সঙ্গে জুড়েছে এই চিন্তা যে যে কোন সময় নদীর জল উপচে উঠতে পারে, আর আমাদের সকলকে ঝেঁটিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
সকালেও দেখা গেল নদীর জল বাড়ছে। একটা অনিবার্য ধ্বংসের খাঁড়া আমাদের উপর ঝুলে আছে বলে মনে হচ্ছে। এখন কাজের সময় - অভিযানের সবচেয়ে মূল্যবান মালপত্র সমেত লোকেদের এপারে আনতে হবে। আমার বিবেচনায় ডঃ লিভিংস্টোনের জার্নাল, চিঠিপত্র ও আমার নিজের কাগজপত্র, অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে অনেক বেশি দামী। ভয়ঙ্কর নদীর দিকে তাকাতে তাকাতে আমার মাথায় বাক্সগুলো এপাড়ে নিয়ে আসার জন্য একটা বুদ্ধি এল। দুটো সরু খুঁটি কেটে, সেগুলোর সঙ্গে কোণাকুনি লাঠি বেঁধে, এক ধরনের হ্যান্ড-ব্যারো বানাবো, যার উপর এক একটা বাক্স দড়ি দিয়ে বেঁধে বসানো যেতে পারে। এবার দুজন করে মানুষ দড়ি ধরে এপারে সাঁতরে আসবে আর তাদের কাঁধে ওই লাঠির শেষ প্রান্ত বসানো থাকবে। আমি ভেবেছিলাম দুজন পুরুষ কাঁধে করে সহজে একটা ৭০ পাউন্ডের বাক্স বয়ে আনতে পারবে। অল্প সময়ের মধ্যে এরকম একটা বাক্স বইবার কাঠামো তৈরি করা হল, আর ছয় জোড়া পাকা সাঁতারুকেও প্রস্তুত করা হল, প্রতিটি পুরুষকে এক গ্লাস করে কড়া গ্রোগ খাইয়ে চাগিয়ে তোলা হল। আর জল না লাগিয়ে সবকিছু এপাশে নিয়ে আসতে পারলে প্রত্যেককে কাপড়ও দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। যখন দেখলাম, কাঁধে কাঠামোটা নিয়ে কী স্বচ্ছন্দভাবে তারা সাঁতার দিচ্ছে, আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম যে কেন পরিকল্পনাটি আগেই আমার মাথায় আসেনি।
প্রথম জোড়া চলে যাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে, অভিযানের সকলেই পূর্ব তীরে নিরাপদে উপস্থিত হল; আর তক্ষুনি শিবির ভেঙে, আমরা জলাজঙ্গলের মধ্য দিয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হলাম। কিছু জায়গায় পথ চার ফুট জলেও ঢাকা ছিল। বেশ কিছু অদ্ভুত দুর্ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার পর সাত ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত জলের মধ্যে ছপছপিয়ে হেঁটে রেহেন্নেকোতে এলাম। এখন আমরা মাকাটার প্লাবিত সমভূমির দোরে। গত বছরের বৃষ্টির জলে জলেও সে নদীর জলের কোন উন্নতি হয়নি। ঠান্ডা মাথায় সেই জল আবার মুখে তুলছি এটা ভাবতেও বিচ্ছিরি লাগছিল। রেহেন্নেকোর কাছে একটা পাহাড়ে দশ দিন বা ২৫ এপ্রিল অবধি শিবির করেছিলাম। বৃষ্টি পুরোপুরি ধরে গেলে তারপর মাকাটা পার হওয়ার চেষ্টা করব, এমনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। সামান্য পরিমাণ কাপড় নিজের প্রতিদিনের খাবার হিসেবে রেখে কাপড়ের গাঁটরিগুলো সব লোকদের কাজের জন্য উপহার হিসাবে বিতরণ করা হল।