আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। এখন চলছে এমপোয়াপোয়া থেকে রওনা হয়ে বিহোয়ানা পার করে কিদিদিমো হয়ে এমসালালো-র (নীচের মানচিত্রে) দিকে এগিয়ে যাওয়ার বর্ণনা। এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই (ওপরের) মানচিত্রে নীল দাগ দেওয়া পথের আশেপাশেই।— সম্পাদক
পরের সুলতানের বাড়ি কিদিদিমোতে—যে সুলতানের এলাকা দিয়ে আমরা আজ ৩০ মে হাঁটছি। বিহাওনা থেকে চার মাইল দূরে। একটা সমান, লম্বাটে জমির উপর দিয়ে রাস্তা গেছে—দুটো টানা পাহাড়শ্রেণির মধ্য দিয়ে, দৈত্যাকার বাওবাব দিয়ে পুরো জমি যেন ঢাকা। কিদিদিমো জায়গাটা ভারী নীরস। এমনকি গোগোদের মুখগুলোও যেন চারপাশের বিবর্ণতার ছোঁয়া লেগে বর্ণহীন হয়ে গেছে। আশেপাশের খানাখন্দের থেকে যে জল মেলে তাতে একটা জঘন্য গন্ধ—এই জল খেয়ে দুটো গাধা অসুস্থ হয়ে পড়ল আর এক ঘণ্টারও কম সময়ে মারা গেল। লোকজনেরও গা গোলাতে শুরু করল, শরীর আনচান করতে লাগল আর তার শোধ নিতে তারা দেশটাকে আর তার রাজাকে মনের সাধ মিটিয়ে গালি দিতে লাগল। তবে ব্যাপারটা চরমে উঠল যখন নজরানার বন্দোবস্ত করার একটা চেষ্টা চালানোর পরে ফিরে এসে বোম্বে জানাল যে সাহেবের আসার খবর শুনে প্রধান নিজেকে ‘কী হনু’ ভেবে ফেলেছে, আর দশ ডটি কাপড়ের কমে তার দপদপানি কমবে না। যদিও বিশাল দাবি, আমি তখন বারবার মুকুনগুরুর আক্রমণে দুর্বল, অশক্ত—এই নিয়ে আর তর্ক করলাম না; কথা না বাড়িয়েই কাপড় দিয়ে দিলাম। কিন্তু আরবরা পুরো বিকেলটা ধরে দরাদরি করল আর শেষে প্রত্যেকে আট ডটি করে দিতে বাধ্য হল।
কিদিদিমো ও ন্যামবোয়ার মধ্যে সুলতান পেম্বেরা পেরের এলাকাটা একটা টানা, লম্বা বন-জঙ্গল—হাতি, গণ্ডার, জেব্রা, হরিণ, অ্যান্টিলোপ আর জিরাফের বাস সেখানে। ৩১ তারিখ ভোরবেলা হাঁটতে শুরু করে আমরা জঙ্গলে ঢুকলাম, আমাদের কিদিমোমোর বাসা থেকে তার অন্ধকার রেখাগুলো আর বৃক্ষময় নদীর তীর স্পষ্ট দৃশ্যমান; আর, দু-ঘণ্টা হাঁটার পরে, বিশ্রাম ও প্রাতঃরাশের জন্য থামা হল, উজ্জ্বল সবুজ অরণ্য দিয়ে ঘেরা মিষ্টি জলের পুকুর, জঙ্গলের বন্য প্রাণীদের দুর্দান্ত আশ্রয়, অজস্র প্রাণীর সাম্প্রতিক হাঁটাচলার দাগ চারদিকে। একটি সরু নালা, ঘন পাতার ছায়ায় ঢাকা, চোখ-ধাঁধানো রোদের থেকে পালিয়ে বাঁচার দারুণ জায়গা। মধ্যদিনে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা মিটিয়ে, লাউয়ের খোলগুলো জলে ভরে নিয়ে আমরা ছায়ার থেকে গরম দুপুরের গনগনে আগুনের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
সাপের মতো এঁকে বেঁকে পথ চলেছে—হালকা বন আর জঙ্গলের কখনও ভিতর দিয়ে, কখনও বাইরে দিয়ে-ফসল কাটার পরে জমিতে পড়ে থাকা গোড়ার মতো সাদা, রং-জ্বলা ঘাসের খোলা জমির মধ্য দিয়ে, আস্তাবলের মতো দুর্গন্ধ ছড়ানো গঁদগাছের ও কাঁটাঝোপের ঝাড়ের মধ্য দিয়ে, বহুদূর ছড়ানো মিমোসার দঙ্গল আর বাওবাবের জটলার মধ্য দিয়ে, বড়ো বড়ো শিকারে ভরা একটা এলাকার মধ্য দিয়ে যেখানে প্রাণীদের আমরা মাঝে মাঝেই দেখতে পাচ্ছি, তবু তারা আমাদের রাইফেলের থেকে এতটাই নিরাপদ যে আমরা যেন ভারত মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমরা যে দ্রুত গতিতে হাঁটছি এখন তাতে বিলম্বের অবকাশ নেই। দুপুরে জল পিছনে ফেলে এসেছি। পরের দিন দুপুরের আগে এক ফোঁটা জলও পাওয়ার কোনো উপায় নেই। আর আমরা আজ দ্রুত দীর্ঘপথ হাঁটতে না পারলে, প্রবল তৃষ্ণায় সবাই ভেঙে পড়বে। অতএব ছয়টি দীর্ঘ ক্লান্তিকর ঘণ্টা ধরে আমরা প্রবল মনের জোর লাগিয়ে খাটলাম। সুর্যাস্তের সময় থামা হল—আমাদের আর আমাদের ন্যামবোয়ার শিবিরের মধ্যে তখনও দু-ঘণ্টার পথ বাকি, পরের দিন সূর্য ওঠার এক ঘণ্টার মধ্যেই সেই পথ পাড়ি দিতে হবে। সেরাতে লোকেরা গাছের তলাতেই আশ্রয় নিল, চারদিকে মাইলের পর মাইল গভীর জঙ্গল—টুপি বা তাঁবুর ঘেরের বাইরে ঠান্ডা রাত উপভোগ করছিল সবাই, আমি তখন জ্বরের ঘোরে সারা রাত ধরে কাতরাচ্ছিলাম আর ছটফট করছিলাম। ভোর হল; আর সেই উষাকালেই, আমাদের লম্বা কাফেলা বা কাফেলাগুলো যাত্রা শুরু করল। সেই একই জঙ্গল, সরু পথ ধরে একজন একজন করে আমরা ভিতরে ঢুকলাম—খুবই সীমিত দৃশ্য চোখে পড়ছে। ডানদিকে, বাঁদিকে অন্ধকার ও গভীর বন। উপরে ফিতের মতো স্বচ্ছ আকাশ, তাতে ইতস্তত মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। দু-একটা উড়ন্ত পাখির ডাক বা কাফেলার লোকদের গান গাওয়া, সুর ভাঁজা, কথা বলার বা জলের কাছাকাছি এসে যাওয়ার আনন্দে চেঁচামেচি ছাড়া আর কিছুই শুনিনি। আমার এক কুলি ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ে গেল, আর উঠল না। কাফেলার শেষটাও যখন পেরিয়ে গেল তখনও সে মরেনি। ভাগ্যিস, না হলে তো সে মরে গেছে জেনেও আমাদের তাকে কবর না দিয়েই চলে আসার বর্বরতা দেখাতে হত।
সকাল সাতটায় আমরা ন্যামবোয়ায় শিবির স্থাপন করলাম। তৃষ্ণার্ত উটের মতন লোলুপভাবে এখানে যে চমৎকার জল পাওয়া যায় তা পান করলাম। বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত্র অদূরেই গ্রামের উপস্থিতি ঘোষণা করছে, গ্রাম দেখতে পেয়েই বোঝা গেল যে থামার জায়গা কাছে আসতেই আমাদের কাফেলার গতি দ্রুততর হচ্ছে। যেই সাহেবরা জনবসতির কাছে এল, গোগোরা আবার ছুটতে ছুটতে এসে ভিড় জমাল, পেরিয়ে যাওয়ার আগেই সাহেবদের একঝলক দেখতে। ছেলে-মেয়ে, বাচ্চা-বুড়ো, অযুত সংখ্যায় এসে আমাদের ঘিরে ফেলল, ভারী চেঁচামেচি-করা জনতা। এইসব বাড়াবাড়ি রকমের হট্টগোল দেখে আমার নাবিক ওভারসিয়রটি তার স্বভাবগতভাবে মন্তব্য করলেন, ‘‘আচ্ছা, বলেই দিচ্ছি যে এরা একদম খাঁটি গোগোই, কারণ এরা হাঁ করে তাকায়! তাকিয়েই থাকে—এদের তাকিয়ে থাকার আর শেষ নেই। আমার তো প্রায় এদের থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে!’’ আসলে ন্যামবোয়ার গোগোদের আচরণ সাধারণ গোগোদের আচরণেরও বাড়া। এখনও অবধি যাদের দেখেছি তারা হাঁ করে তাকিয়ে থেকে আর চেঁচিয়েই সন্তুষ্ট ছিল; এরা সব সীমা পেরিয়ে গেল। আর এদের বাড়াবাড়ি রকমের ধৃষ্টতা দেখে আমার ক্রমবর্ধমান রাগটা এরপর প্রকাশ পেল, যখন আমি সবথেকে অসভ্য লোকটার ঘাড় ধরে সে বুঝে ওঠার আগেই আমার কুকুরচাবুক দিয়ে তাকে আচ্ছা করে পেটালাম, তার তাতে খুব অল্পই খুশি হওয়ার কথা। এই ঘটনাটার পরে ওই তাকিয়ে-থাকা দলের লোকরা বিবিধ স্থানীয় গালাগালি দিতে লাগল, কটুকাটব্য করতে লাগল। ভারী অদ্ভুত সেসবের প্রকাশ। প্রায় ক্রুদ্ধ কুকুর-বিড়ালদের মতো একটা কান ফাটানো শিস আর খানিকটা ঘেউ ঘেউ শব্দের সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে কথা বলতে থাকল। যা বেরোচ্ছিল, সেটাকে উচ্চারণ অনুসারে বললে দাঁড়ায়—‘হ্যাটচট’ তীক্ষ্ণ চড়া সুরে চেঁচিয়ে বলা। সামনে-পিছনে তারা দুলছিল আর নিজেদের মধ্যে বলছিল, ‘এই সাহেব কি গোগোদের দাসের মতো পেটাবে? একজন গোগো তো এমগওয়ানা (একজন স্বাধীন মানুষ); তার তো মার খাওয়ার অভ্যেস নেই—হ্যাটচট।’ তবে আমি নড়লে চড়লেই আর তাদের দিকে চাবুক নাচালেই, এই অদ্ভুত বাচাল লোকগুলো বিরক্ত সাহেবের থেকে সম্মানজনক দূরত্বে পালিয়ে যাওয়াই সুবিধাজনক বলে ভাবছিল।
বুঝলাম যে এই গোগোদের একটা ছোট্ট করে পৌরুষ ও ক্ষমতা দেখানোটা অনেকদিন ধরেই দরকার আর এই মুহূর্তে বিরক্তির হাত থেকে বাঁচার সেটাই উপায়। যখনই তারা ধৈর্যের সীমা ছাড়াত, আমি চাবুকের শরণ নিতাম, লম্বা কশ পিস্তলের গুলির মতো শব্দ করে সেটা মাটিতে আছড়ে পড়ত। যতক্ষণ তারা নাছোড়বান্দা হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকত আর আমার গাত্রবর্ণ, পোশাক ও সাজসজ্জা নিয়ে নিজেদের মধ্যে গুজুরগুজুর করত, ততক্ষণ আমি দার্শনিকভাবে চুপ করে থাকতাম, ওদের মজা পেতে দিতাম। কিন্তু যখন তারা আমার ঘাড়ে এসে পড়ত, কোনোক্রমে এগোনোর জায়গাটুকুই শুধু দিত, তখন ডাইনে-বাঁয়ে আমার মজবুত চাবুকের কয়েকটা দ্রুত সজোর ঝাপটা পথ ফাঁকা করে দিত।
পেম্বেরা পেরে একজন অদ্ভুত বুড়ো লোক, ছোট্টখাট্ট, উগোগোর সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান না হলে কেউ তাকে পুছতও না; অন্যান্য অনেক উপজাতিও তাকে মধ্যস্থতা করতে ডাকে। এতই গুরুত্বপূর্ণ প্রধান হলে কী হবে, প্রজাদের মধ্যে তার পোশাকআশাকই সব থেকে খারাপ—সর্বদাই নোংরা—এমনকি তেলচিটচিটে—সবসময় মুখ থেকে পচা গন্ধ বেরোচ্ছে—তবে এসব নিছক পাগলামি: একজন জ্ঞানী বিচারক হিসাবে তার তুলনা নেই, ইউন্যানয়েম্বেতে বছর-বছর ব্যাবসা করতে আসা ভীতু আরব বণিকদের থেকে কাপড় বার করার জন্য সর্বদা তার একটা কোনো কৌশল তৈরি থাকে আর জটিল সব বিচারের মামলা, সাধারণ লোকের কাছে যে বিচার কাজের পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়, সেসব সে সহজেই নিষ্পত্তি করে দেয়।
শেখ হামেদ, সেই যাকে এখন উগোগোর মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় জোট বাঁধা কাফেলাগুলোর পথ প্রদর্শক হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল, সে এতই দুর্বল ও ছোট্টখাট যে তাকে পরিচিত ঢ্যাপসদের নকল বলেও ভাবা যেতে পারে। এইরকম মাত্রার হওয়ায়, ওজন ও মাপের দিকে যেটুকু কমতি ছিল সেটা সে কাজ দিয়ে পুষিয়ে দিত। শিবিরে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তার পরিপাটি ছিমছাম চেহারাটা শিবিরাঞ্চলের এদিক থেকে ওদিক লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে বেড়াতে দেখা যেত। ছটফট করছে, জিনিসপত্র গোছাচ্ছে, সবকিছু ঘাঁটছে, সবাইকে জ্বালাচ্ছে। নিজের মালের গাঁটরির সঙ্গে সে অন্য কারও মালপত্র মেশাতে দিত না, এমনকি খুব কাছাকাছি রাখতেও দিত না। মালপত্র গুছিয়ে রাখার বাবদে তার একটা পছন্দের উপায় ছিল, সেইভাবেই যাতে রাখা হয় সেটা সে দেখত; নিজের তাঁবুর জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গাটা খুঁজে নেওয়ার বিশেষ চোখ ছিল তার আর অন্য কেউ সেই জমিতে অনধিকার প্রবেশ করতে পারবে না। কেউ ভাবতেই পারেন যে দিনে দশ-পনেরো মাইল হাঁটার পরে এইসব ছোটোখাটো ব্যাপার সে দাসদের হাতে ছেড়ে দেবে, কিন্তু সে হবে না, নিজে দাঁড়িয়ে না দেখলে কিছুই ঠিকঠাক হবে না; আর সে কাজে তিনি অক্লান্ত এবং কোনো অবসাদই তাকে ছোঁয় না।
শেখ হামেদের আর-একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য এই যে, যেহেতু সে ধনী নয়, তাই প্রতিটি শুককা ও ডটি যা খরচ হয় তার বেশিটাই তাকে অনেক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আয় করতে হয় আর প্রত্যেকটা নতুন খরচ যেন তার প্রাণকে কুরে কুরে খায়; যখন উগোগোতে চড়া দাম দিতে হল বা সেখানকার সুলতানের জুলুমভরা দাবি মেটাতে হল, সে নিজেই বলেছিল যে সে এবার কেঁদেই ফেলবে। এই কারণেই, সে কাফেলার নেতা হওয়ায় আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে উগোগোতে খাবার-দাবার এতই চড়া দামের যে সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করবে যেন আমাদের সেখানে একটুও দেরি না হয়।
ক্রমশ...
অসাধারন একটি সিরিজ। গোগ্রাসে পড়ছি , লেখককে টুপিখুলে ধন্যবাদ।