ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালা। তরজমা স্বাতী রায়
আমাদের আরও মাস খানেক অপেক্ষা করা উচিত ছিল, কারণ বন্যার জমা জল চার ইঞ্চিও কমেনি। যাই হোক, আমরা একবার গলা জলেও যুদ্ধ করেছি। পিছু হটেও কোন লাভ ছিল না। দু-দুবার আট ঘণ্টা করে হেঁটে আমরা জল-কাদা, গভীর গাড্ডা, গলা-জল, বিচ্ছিরি কাদার মধ্যে দিয়ে পেরোলাম, সাঁতরে নালা পেরোলাম, থ্যাপ থ্যাপ করে গলির মধ্যে দিয়ে হেঁটে দ্বিতীয় দিন সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময়ে মাকাটা নদীর তীরে এসে পৌঁছালাম। আমার লোকেরা মাঝরাতের আগে দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি, মেঘের মত ঘন মশার দল আমাদের ছেঁকে ধরেছিল, যেন আমাদের সবাইকে খেয়ে নেবে! যখন পরের দিনের যাত্রা শুরুর জন্য শিঙ্গা ফোঁকা হল, তখন তারা সকলেই একমত হল যে সে রাতটা তাদের পক্ষে ভোলা কঠিন হবে।
ভোর পাঁচটার সময় আমরা মাকাটা নদী পেরোতে শুরু করি। কিন্তু এর পরেই ছয় মাইল জুড়ে রয়েছে একটি লম্বা হ্রদ, যার জল মৃদুভাবে ওয়ামির দিকে বয়ে গেছে । এখানে জলস্রোতগুলির সঙ্গম: চারটি নদী এক হয়ে গেছে। কিগোংগোর স্থানীয়রা আমাদের সতর্ক করেছিল যে আমরা যেন এখন পেরনোর চেষ্টা না করি, কারণ এখানে আমাদের মাথার ওপরে জল; কিন্তু আমি সবাইকে শুধুমাত্র একটি ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, আর তারপর নিজেদের পথে চলতে শুরু করলাম। এমনকি আমরা যে জল পাচ্ছিলাম, তা বেশ কাদা-গোলা- তবু গ্রামের প্রাচীরের পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়া ভয়ঙ্কর নোংরা, পচা গাছের স্তূপের চেয়ে এটা ভাল।
জল আমরা শীঘ্রই আমাদের বগল পর্যন্ত উঠে গেল, তারপর হাঁটু পর্যন্ত নামল আবার গলা অবধি উঠল। জলের উপরে বাচ্চাদের ভাসতে সাহায্য করতে করতে, নিজেরা ডিঙ্গি মেরে মেরে এগোলাম; আগের দিনের মতন একই অভিজ্ঞতা হচ্ছিল, যতক্ষণ না আমরা ছোট্ট মাকাটার ধারে এসে থামলাম। এই নদী প্রতি ঘন্টায় আট নট বেগে চলছিল; তবে মাত্র পঞ্চাশ গজ চওড়া, খুব উঁচু পাড়। তারপর সিম্বো পর্যন্ত ছড়ানো শুকনো ঘাসজমি। সাঁতার কাটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না; কিন্তু দ্রুত ও জোরালো স্রোতের কারণে খুব ধীরে ধীরে পেরোতে হল। একেই বাড়ির খুব কাছে চলে এসেছি, তার দরুন ছটফটেভাব তো ছিলই, সেই সঙ্গে যূথবদ্ধ কাজ ও উদ্যম, বড় পুরস্কার ও নগদ টাকার লোভ মিলে বিস্ময়কর ফল মিলল - কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমরা মাকাটা ছাড়িয়ে গেলাম।
সামনে এলিয়ে থাকা শুকনো, মসৃণ পথ ধরে আমরা এগোচ্ছি। আমাদের মন ভারি খুশি, আশা-ভরা। বীরের উদ্যম ও প্রাণবন্ততার সঙ্গে অভিজ্ঞতা-প্রসূত স্বাচ্ছন্দ্য ও শক্তি মিলে আমরা জোরকদমে হাঁটছি। সাধারণভাবে তিনদিনের পথ একদিনে হেঁটে রাতের অনেক আগেই সিম্বোতে পৌঁছে গেলাম।
২৯ তারিখে আমরা উঙ্গেরেঙ্গেরির পার হলাম, আর যখন আমরা সিম্বামওয়েন্নিতে এসে পৌঁছলাম—উসেগুহহা-এর "লায়ন সিটি" —উঃ এ কি পরিবর্তন! নদীতে বন্যা নেমে শক্ত প্রাচীর ঘেরা শহরের সামনের প্রাচীরকে পুরো ভাসিয়ে নিয়েছিল। প্রায় পঞ্চাশটা বাড়ি জলের ধাক্কায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এমকাম্বাকু পর্বতমালার উরুগুরুর ঢালে অবস্থিত ওয়ারুগুরুর গ্রামগুলিও ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আমরা যে খবর শুনেছি তার এক-চতুর্থাংশও যদি সত্যি হয়, তাহলেও অন্তত একশত লোক মরে গেছে।
সুলতানা পালিয়ে গেলেন, কিসাবেঙ্গোর দুর্গ আর থাকল না! তার জীবদ্দশায় শহরের কাছে উঙ্গেরেঙ্গেরির একটা শাখা টেনে আনার জন্য সে একটা গভীর খাল কাটিয়েছিল, সেটা ছিল তার ভারি গর্বের জিনিস, জাঁক করার মতই কাজ - সেটাই সিম্বামওয়েন্নির ধ্বংস ডেকে আনল। জায়গাটা ধ্বংসের পর শহর থেকে প্রায় ৩০০ গজ দূরে নদী এক নতুন পথ তৈরি করে নিল। তবে যে দৃশ্য দেখে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছিলাম তা হল চারদিকে জমে থাকা ধ্বংসাবশেষের স্তূপ আর প্রচুর মাটিতে পড়ে যাওয়া বৃক্ষ; তারা সবাই একই দিকে লুটিয়ে পড়েছে, যেন দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবল ঝড় তাদের মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে। উঙ্গেরেঙ্গেরির উপত্যকার চেহারা পুরো বদলে গেছে - আগে যাকে স্বর্গ বলে মনে হত, এখন সেটা এক ক্রন্দনরত ধ্বংসস্তুপ মাত্র।
উলাগাল্লা না পৌঁছনো অবধি আমরা হাঁটতেই থাকলাম, এগোতে এগোতে স্পষ্ট বুঝলাম যে মাটির উপর দিয়ে একটা অস্বাভাবিক ঝড় বয়ে গেছে, কিছু কিছু জায়গায় সার বেঁধে গাছ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।
একটা ভয়ানক ক্লান্তিকর, দীর্ঘ হাঁটার পরে আমরা উঙ্গেরেনগেরির পূর্ব তীরের মুসৌদিতে পৌঁছালাম, তবে সেখানে পৌঁছানোর অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে মানুষের জীবন ও সম্পত্তি এক ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলার সামনে পড়েছে। মুসৌদির খবর অনুসারে, প্রায় একশ গ্রাম ভেসে গেছে। এই কথার থেকেই দুর্যোগের মাত্রা ও প্রকৃতি কল্পনা করা যেতে পারে।
মুসুদি নামের দেওয়ান জানালেন যে মধ্যরাতে যখন সবাই যথারীতি ঘুমাতে চলে গিয়েছিল - পঁচিশ বছর আগে যখন তিনি এই উপত্যকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন, তখন থেকেই তাদের এমনটাই অভ্যাস – তখন তাদের অনেকে একসঙ্গে অনেক অনেক বজ্রপাতের মতন একটা গর্জনের আওয়াজ শোনে। তারা সজাগ হয়ে দেখে যে স্বয়ং মৃত্যু সামনে - বিপুল পরিমাণে জল একটা বিশাল উঁচু প্রাচীরের মতন ধেয়ে আসছে। উঁচু উঁচু গাছগুলোকে উপড়ে ফেলেছে, একের পর এক গ্রামকে নিঃশেষ করে দিয়েছে, সুনিশ্চিত, সম্পূর্ণ ধ্বংসদূত! ঘটনার ছয় দিন পরে যখন নদী আবার তার বর্ষাকালের স্বাভাবিক প্রস্থ ও গভীরতায় ফিরে এসেছে, চারপাশের দৃশ্য অতি ভয়ানক। যেদিকেই তাকাই, ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞের ছাপ স্পষ্ট; ভুট্টার ক্ষেত বহু ফুট বালি ও ধ্বংসাবশেষ দ্বারা ঢাকা; যে বালুকাময় খাতটি নদী ফেলে রেখে গেছে তা প্রায় এক মাইল চওড়া; তার পাশে তিনটে গ্রাম ছিল। উন্যানয়েম্বে যাওয়ার পথে দেখেছিলাম। আমি মুসুদিকে জিজ্ঞেস করলাম, যে সেখানকার লোকদের কি হল, সে উত্তর দিল, “ভগবান ওদের বেশিরভাগকে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন, তবে কয়েকজন উদোতে পালিয়েছে।” ঈশ্বর ওয়াকামি উপজাতির উপর সবচেয়ে নিশ্চিত আঘাতটি হেনেছেন; দেওয়ান যেমন বলেছে সেই কথাগুলোই তুলে দিচ্ছি, “আল্লাহর বিস্ময়কর ক্ষমতা, কেই বা তাকে আটকাতে পারে!”
আবার আমার ডায়েরি থেকে নীচে কিছুটা অংশ তুলে দিই:
৩০শে এপ্রিল।—মসুওয়া পেরিয়ে, আমরা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তাড়াহুড়ো করে এগোলাম, উন্যানয়েম্বে যাওয়ার সময় এই জঙ্গল পেরোতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। এই জঙ্গল কী যে ভয়ঙ্কর গন্ধ ও অবর্ণনীয় ঘৃণার জন্ম দেয়! এমন ঘন জঙ্গল যে একটা বাঘও এর মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিতে পারে না; এতই দুর্ভেদ্য যে একটা হাতিও এখানে গায়ের জোরে পথ তৈরি করতে পারে না! এখানে যে বাতাসে আমরা নিঃশ্বাস নিয়েছি, তাকে যদি ঘনীভূত করে বোতলে ভরে সংগ্রহ করা যেত, তাহলে বোঝা যেত যে কী মারাত্মক, তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকরী বিষ এখনো অনাবিষ্কৃত রয়েছে! আমার ধারণা, এটা ক্লোরোফর্মের চেয়েও দ্রুত কাজ করবে, প্রুসিক অ্যাসিডের মতো মারাত্মক!
বিভীষিকার উপর বিভীষিকা! মাথার উপরে অজগর আর পায়ের নিচে সাপ ও বিছে। স্থল-কাঁকড়া, জল-কাঁকড়া ও ইগুয়ানা আশেপাশেই ঘুড়ছে। বাতাসে ম্যালেরিয়া বিষ; রাস্তায় মাঝে মাঝেই লাল-পিঁপড়ের কামড় খেতে হয়েছে, এরা এমন পা কামড়ে ধরে যে নাচানাচি করতে, পাগলের মতো গা মোচড়াতে হয়। তবুও, কোনমতে, আমরা মৃত্যুর হাত থেকে যথেষ্ট ভাগ্যের জোরে বেঁচে ফিরলাম। আরও অনেক অভিযাত্রীদলও হয়ত পারবেন। তবুও সত্যি কথা বলতে, এখানে যে ‘মিশরের দশটি ভয়াবহ মারী’1র দেখা মেলে, যেসব নিরন্তর বিপদের মধ্যে দিয়েই এই অঞ্চলের একজন অভিযাত্রীকে যেতে হবে, সেগুলো নিম্নরূপঃ
১. রাশি রাশি ময়াল সাপ
২. লাল বিষ পিঁপড়ে
৩. কাঁকড়া-বিছে
৪. কাঁটা ঝোপ ও বর্শামুখ ক্যাকটাস
৫. অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা
৬. হাঁটু-গভীর কালো কাদা
৭. শ্বাসরোধকারী ঘন জঙ্গল
৮. দুর্গন্ধ
৯. রাস্তা ভরা কাঁটা
১০. বিষবাষ্প