ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। উজিজিতে লিভিংস্টোনের সন্ধান পাওয়ার পর প্রথম আলাপচারিতা। তরজমা স্বাতী রায়
কথোপকথন শুরু হল। কী নিয়ে? সত্যি বলছি, ভুলে গেছি। উঁহু! পরস্পরকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছিলাম, যেমন ‘আপনি এখানে কীভাবে এসেছেন?’ ও ‘এতদিন কোথায় ছিলেন? - গোটা পৃথিবীর লোক জানে যে আপনি মৃত।’ হ্যাঁ, এভাবেই কথা শুরু হল: তবে ডাক্তার আমাকে কী বলেছিলেন, আর আমিই বা তাকে কী বলেছিলাম, সেসব সঠিক বলতে পারব না, কারণ আমি তো তার দিকে হাঁ করে তাকিয়েই ছিলাম, যে মানুষটার পাশে এখন মধ্য আফ্রিকায় বসে আছি, তাঁর দারুণ চেহারা ও মুখের প্রতিটা দাগ মুখস্থ করছিলাম। তার মাথার প্রতিটি চুল-দাড়ি, তার মুখের প্রতিটি বলিরেখা, তার চেহারার রোগজীর্ণতা, আর তার চেহারার সামান্য ক্লান্তি, সবই আমাকে অনেক কিছু বলছিল — সেই যেদিন আমাকে বলা হয়েছিল যে “আপনি যাই চান তাই নিন, শুধু লিভিংস্টোনকে খুঁজে নিন।” তারপর থেকেই আমি এর অপেক্ষায়। যা দেখছি তা অকপট সত্য। আমার কাছে গভীর কৌতূহলোদ্দীপক অভিজ্ঞতা। একই সঙ্গে শুনছিলাম আর বুঝে নিচ্ছিলাম। এই বোবা সাক্ষীরা আমাকে কী বলতে চায়?
ইস্, পাঠক, আপনি যদি ওই দিন উজিজিতে আমার পাশে থাকতেন, লোকটির কাজের প্রকৃতি বিষয়ে কত গুছিয়েই না বলা যেত! সব দেখার আর শোনার জন্য আপনি নিজেই যদি থাকতেন সেখানে! তাঁর মুখে সব বিস্তারিত বিবরণ শুনলাম; সেই মুখ তো কখনো মিথ্যা বলে না। যা বলেছিলেন সব তো আর পুনরাবৃত্তি করতে পারব না; এতই মগ্ন হয়ে ছিলাম যে আমার নোট-বইটি বের করে সব গল্প টুকে নিতে শুরু করতেও ভুলে গিয়েছিলাম। তাঁর এত কিছু বলার ছিল যে তিনি শেষের থেকে শুরু করেছিলেন, আপাতদৃষ্টিতে ভুলে গিয়েছিলেন যে তাঁকে পাঁচ বা ছয় বছরের ইতিহাস বলতে হবে। কিন্তু তার কথা বন্যার মতন বেরিয়ে আসছিল; দ্রুত একটা মহাকাব্যের চেহারা নিচ্ছিল - তাঁর কর্মকাণ্ডের এক বিস্ময়কর ইতিহাস।
আরবরা উঠে দাঁড়ালো, যেন তারা আপনা থেকেই বুঝে গেছে যে এদের এখন একলা থাকতে দেওয়া উচিত। এই সৌজন্যটুকু খুবই ভাল লাগল। বোম্বেকে তাদের সঙ্গে পাঠালাম তাদের উন্যানয়েম্বের খবরাখবর দেওয়ার জন্য - তাদের খুবই সে খবরে আগ্রহ। মাসাঙ্গিতে যে সাহসী যুবকটিকে দেখেছিলাম, যে জিম্বিজোতে আমার পাশেপাশে যুদ্ধ করেছিল আর তারপরেই উইলিয়ানকুরুর জঙ্গলে মিরাম্বোর রুগা-রুগারা যাকে মেরে ফেলেছিল, সৈয়দ বিন মাজিদ তার বাবা। আমি সেখানে ছিলাম জেনে, সে যুদ্ধের কথা শুনতে চাইল; তবে তাদের সব বন্ধু-বান্ধব রয়েছে উন্যানয়েম্বেতে। ফলে তাদের কী হল জানতেই এখানে সকলে উদ্বিগ্ন, খুবই স্বাভাবিক।
দলের সকলের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করার জন্য বোম্বে আর আসমানিকে হুকুম দিলাম। তারপর আমি ‘কাইফ-হালেক’ বা ‘হাউ-ডু ইউ-ডু’ কে ডাকলাম আর ডঃ লিভিংস্টোনের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলাম। উন্যানয়েম্বেতে রেখে যাওয়া কিছু মালপত্র তারই হেফাজতে ছিল, তাকে আমি জোর করে উজিজিতে নিয়ে এসেছিলাম, যাতে সে ব্যক্তিগতভাবে তার দায়িত্বে থাকা চিঠির ব্যাগ তার মালিকের হাতে পৌঁছে দিতে পারে। এই সেই বিখ্যাত চিঠির পুঁটলি, যার আগে 'পয়লা নভেম্বর, ১৮৭০' বলে চিহ্ন করা। এখন জাঞ্জিবার ছাড়ার ৩৬৫ দিন পরে সেটা ডাক্তারের হাতে তুলে দেওয়া হল। ! জানি না, আমি যদি এই মহান ভ্রমণকারীর সন্ধানে মধ্য আফ্রিকায় না আসতাম, তাহলে কতকাল এটা উন্যানয়েম্বেতে পড়ে থাকত?
ডাক্তার চিঠির পুলিন্দাটা হাঁটুর উপর রাখলেন, তারপর, তখনই, সেটা খুললেন, ওর মধ্যের চিঠিগুলো দেখছেন, ছেলে-মেয়েদের একটা-দুটো চিঠি পড়েছেন, পড়তে পড়তে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
তিনি আমার কাছে সব খবর জানতে চাইলেন। 'না, ডক্টর,' আমি বললাম, 'আপনি আগে চিঠিগুলো পড়ুন, আমি নিশ্চিত যে আপনার অবশ্যই অধৈর্য লাগছে।'
'আহ্,' তিনি বললেন, 'চিঠির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছি, আর ধৈর্য ধরতে শিখেছি । নিশ্চয় আরও কয়েক ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে পারব। না, আমাকে সাধারণ খবরগুলো বলুন: কী হালচাল পৃথিবীর?'
'আপনি সম্ভবত ইতিমধ্যেই অনেক কিছু জানেন। আপনি কি জানেন যে সুয়েজ খাল বাস্তবে পরিণত হয়েছে – এখন এই পথ খোলা আর এর মাধ্যমে ইউরোপ ও ভারতের মধ্যে নিয়মিত বাণিজ্য চলে?'
'খালটা খোলার কথা শুনিনি। বাঃ, এতো দারুণ খবর! আর কি?'
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি তাঁকে বছরওয়ারি বিবরণ দিতে শুরু করলাম। পঙক্তি-পিছু এক পেনি মূল্যের খবরে যেমন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলা হয়, এখানে তার কোন দরকার নেই। উত্তেজক ভাবে পরিবেশনা করারও প্রয়োজন নেই। গত কয়েক বছরে পৃথিবী অনেক কিছু দেখেছে, আর অনেক ঘটনাও ঘটেছে। প্যাসিফিক রেলপথ তৈরি সম্পূর্ণ হয়েছে; গ্রান্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন; মিশর ইউরোপীয় বিদ্বজ্জনে ছেয়ে গেছে : ক্রেটান বিদ্রোহ খতম; স্প্যানিশ বিপ্লবের ফলে ইসাবেলা স্পেনের সিংহাসন থেকে বিতাড়িত - একজন রাজপ্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়েছে: জেনারেল প্রিমকে হত্যা করা হয়েছে; একজন ক্যাস্টেলারের1 ধর্মীয় স্বাধীনতার আধুনিক ধারণা শুনে ইউরোপ হতবাক হয়ে গেছে; প্রুশিয়া ডেনমার্ককে হারিয়ে শ্লেসভিগ-হোলস্টাইন দখল করে নিয়েছে, আর প্রাশিয়ান সেনাবাহিনী এখন প্যারিস ঘিরে ফেলেছে; দ্য ‘ম্যান অব ডেসটিনি’2 উইলহেলমশোহেতে বন্দী; ফ্যাশনের রানী ফরাসি সম্রাজ্ঞী পালিয়েছেন; আর রাজবংশে জন্ম নেওয়া শিশুটি তার মাথার রাজকীয় মুকুটটি চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলেছে; বিসমার্ক এবং ভন মোল্ট প্রমুখ প্রাশিয়ানরা নেপোলিয়নের বংশকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছে; ফ্রান্সের সেই উদ্ধত সাম্রাজ্য আজ ধূলিকণায় মিশে গেছে।
এই সব ঘটনাগুলো আর কিই বা বাড়িয়ে বলব? ম্যান্যুয়েমার গহন বনের থেকে বেরিয়ে আসা একজন মানুষের কাছে এগুলো কতটুকুই বা খবর! লিভিংস্টোন অবাক হয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনাগুলো শুনছেন, সভ্যতার আলো এসে পড়ছে তার উপর। খুচরো বর্বর অভিজ্ঞতা গুলো এর সামনে কেমন ম্লান! আমরা, ইউরোপের দুই নিঃসঙ্গ সন্তান, যখন সেখানকার সুখ-দুঃখের বৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা করছি, কে জানে সেখানে এখন অশান্তির কোন অধ্যায় চলছে! হয়ত গীতিকার ডেমোডকাসের3 গলায় সেসব ঘটনার আরো ভাল বর্ণনা শোনা যেত; কিন্তু, কবির অনুপস্থিতিতে, সংবাদপত্রের সংবাদদাতা তার নিজের ভূমিকা যথাসম্ভব ভালভাবে আর সততার সঙ্গে পালন করেছিল।
আরবরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই, সাইদ বিন মজিদ আমাদের জন্য গরম গরম মাংসের কিমা রেঁধে পাঠিয়েছিল আর মোহাম্মদ বিন সালির একটা মুরগির ঝোল পাঠিয়েছিল। মোয়েনি খেরি একটি পাত্র বোঝাই ছাগ-মাংসের স্ট্যু আর ভাত পাঠিয়েছিল; এইভাবে একের পর এক খাবার উপহার আসতে লাগল, আর যত তাড়াতাড়িই আসে, ততই তাড়াতাড়ি আমরা খেয়ে ফেলি! আমার হজমশক্তি বেশ ভাল - আর এত এত হাঁটার ফলে সে একেবারে তখন তুঙ্গে; তবে লিভিংস্টোন - তিনি অবশ্য বলছিলেন যে তার খিদে নেই, মাঝে সাঁঝে এক কাপ করে চা ছাড়া তার পেটে আর কিছু সইছে না - তিনিও খেলেন - একজন প্রবল, ক্ষুধার্ত মানুষের মতো খেলেন; আর, তিনি যখন আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্যানকেক ধ্বংস করছিলেন, তখন তিনি আবার বললেন, 'তুমি আমাকে নতুন জীবন দিলে। নতুন জীবন ফিরিয়ে দিলে।'
(ক্রমশ...)
1 এমিলো কাস্টেলার ১৮৩২-১৮৯৯ একজন স্প্যানিশ রিপাবলিকান নেতা। অতিশয় সুবক্তা এই মানুষটি তদানীন্তন ইউরোপে ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে প্রচুর লড়াই করেন। ১৮৭৬ সালের তাঁর ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর দেওয়া বক্তৃতা নিয়ে বই ও আছে।
2ম্যান অফ ডেস্টিনি অর্থাৎ তৃতীয় নেপোলিয়নকে ১৮৭০ সালে যুদ্ধে হারার পরে উইলজেল্মশোহে তে কিছুদিন বন্দী করে রাখা হয়।
3ডেমোডকাস হোমারের অডিসির একটি চরিত্র, একজন অন্ধ চারণকবি। কেউ কেউ বলেন, হোমার নিজের আদলে এই চরিত্র বানিয়েছিলেন।