ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে ঘরে ফেরার আগে ডঃ লিভিংস্টোনকে কী ভাবে নীলনদের উৎস সন্ধানের অভিযানের জন্য প্রস্তুত করা যায় তার কথা। তরজমা স্বাতী রায়
আমি ডাক্তারকে শেখ সাইদের কাছে লোক পাঠানোর জন্যও অনুরোধ করলাম। তার কাছে এটা জানতে চাওয়ার দরকার যে ডাক্তার উজিজিতে প্রথম বার পৌঁছানোর পরে ডাঃ কার্ক ও লর্ড ক্ল্যারেনডনের জন্য যে দুটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, সেটা তিনি পেয়েছেন কিনা; আর ডাক্তার যেমন চেয়েছিলেন, সেইমত তিনি চিঠিদুটো উপকূলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কিনা। দূত এসে খবর দিল যে হ্যাঁ পাঠানো হয়েছে। পরে ডাক্তারের উপস্থিতিতে প্রশ্ন করেও একই উত্তর পেয়েছি।
উজিজি থেকে পুরো পথটা আমাদের সঙ্গী ছিল ঝমঝমানো বৃষ্টি। ২২ শে ফেব্রুয়ারি সেটা বন্ধ হল আর সুন্দর আবহাওয়া পাওয়া গেল। আমি যখন বাড়ির পথের ফিরতি অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন ডাক্তার চিঠি লিখতে আর তাঁর যাবতীয় নোট জার্নালে লিখে রাখতে ব্যস্ত ছিলেন। সেটা আমি তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেব। এইসব কাজের ফাঁকে আমরা তাবোরায় আরবদের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমরা দুজনেই তাদের থেকে উদার আতিথেয়তা পেয়েছিলাম, তারা অবশ্য সে জন্য বিখ্যাত।
ডাঃ লিভিংস্টোনকে আমার মারফত দেওয়া জিনিসগুলির মধ্যে থেকে, আমার ঘরে ফেরার যাত্রার জন্য যেগুলো রাখতে চেয়েছিলাম, তা হল
ডটি | গজ | |
প্রথম শ্রেণির আমেরিকান শিটিং | ২৮৫ | = ১১৪০ |
প্রথম শ্রেণির কানিকি (নীল রঙয়ের) | ১৬ | =১৬৪ |
মাঝারি ধরণের ডাবওয়ানি কাপড় | ৬০ | =২৪০ |
বারসতি কাপড় | ৪১ | =৬৪ |
ছাপানো রুমাল | ৭০ | =২৮০ |
মাঝারি ধরণের রেহানি কাপড় | ৭০ | =২৮০ |
মাঝারি ধরণের ইসমাইলি কাপড় | ২০ | =৮০ |
মাঝারি ধরণের সোহারী কাপড় | ২০ | =৮০ |
৪ টুকরা সূক্ষ্ম কুঙ্গুরা (লাল চেক) | ২২ | =৮৮ |
৪ গোরাহ রেহানি | ৮ | =৩২ |
কাপড়ের মোট সংখ্যা | ৬৯৭ | =২৭৮৮ |
এছাড়াও:
কাপড়, ২৭৮৮ গজ।
মেলানো মেশানো পুঁতি, ১৬ বস্তা, ওজন = ৯৯২ পাউন্ড।
৫ ও ৬ নম্বর পিতলের তার, ১০ ফ্রাসিলা = ৩৫০ পাউন্ড।
১ জলরোধী ক্যানভাসের তাঁবু।
১ হাওয়া ভরা বিছানা।
১ নৌকা (ক্যানভাস)।
১ ব্যাগ ছুতারের সরঞ্জাম ।
১ রিপ শ।
২ পিপে আলকাতরা।
জাহাজের তামার ১২ পাত = ৬০ পাউন্ড।
কাপড়।
১ জোসলিন ব্রিচ-লোডার (ধাতব কার্তুজ)
১ স্টারের ব্রিচ-লোডার (ধাতব কার্তুজ)
১ হেনরি (16-শ্যুটার) (ধাতব কার্তুজ)
১ রিভলবার।
২০০ রাউন্ড রিভলবারের গুলি
২০০০ রাউন্ড জোসলিন ও স্টারের গুলি।
১৫০০ হেনরি রাইফেলের গুলি ।
রান্নার পাত্র, ওষুধের বাক্স, বই, সেক্সট্যান্ট, ক্যানভাস ব্যাগ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
উপরের জিনিসগুলো মোট চল্লিশটা বোঝা তৈরি করেছে। তালিকার অনেককিছুই, বিশেষত কার্বাইনস এবং গুলিবারুদ, করাত, ছুতোরের সরঞ্জাম, পুঁতি এবং তার, উন্যানিয়েম্বেতে কিনতে হল, অসম্ভব বেশি দাম দিয়ে। আমার কুঁড়েতে লিভিংস্টোনের উদ্দেশ্যে ১ লা নভেম্বর, ১৮৭০ এ পাঠানো তেত্রিশটি বোঝা রাখা ছিল। তবে তাদের মধ্যে অল্প কয়েকটাই তাঁর রুয়া ও মান্যুয়েমায় ফিরে যাওয়ার পথে কাজে লাগবে। তাঁর জন্য পাঠানো ৬৯৬ ডটি কাপড়ই একমাত্র বিক্রয়যোগ্য; আর মান্যুয়েমায়, যেখানে স্থানীয়রাই নিজেদের কাপড় বোনে, সেখানে এইসব জিনিস বয়ে নিয়ে গেলেই সেটা একটা পিছুটান। যদিও আমার দেওয়া পুঁতি ও তার, হিসেব করে চালালে, সেই অঞ্চলে তাঁকে ও তাঁর লোকদের দু বছরেরও বেশি সময় কাটানোর জন্য যথেষ্ট। আর তাঁর নিজের কাপড়, সঙ্গে আমার দেওয়া কাপড় জুড়লে, সব মিলে মোট ১৩৯৩ ডটি হল, প্রতিদিনের খাবারের জন্য ২ ডটি হিসেবে ধরলেও তাঁকে আর তাঁর দলের ষাট জনকে ৬৯৬ দিন বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট। এইভাবে হিসেব করলে তাঁর জন্য চার বছরের সরবরাহের ব্যবস্থা হল। নতুন করে একটা পাকা ব্যবস্থার অভিযান শুরু করার জন্য যা যা দরকার তার একটা তালিকা তিনি আর আমি বানিয়েছিলাম। তার মধ্যে একমাত্র নিচের লেখা জিনিসগুলোরই অভাব ছিল।
কয়েক টিন আমেরিকান গমের ময়দা।
কয়েক টিন সোডা বিস্কুট।
কয়েক টিন সংরক্ষিত ফল।
কয়েক টিন সার্ডিন।
কয়েক টিন স্যামন।
১০ পাউন্ড হাইসন চা
সেলাই করার সূঁচ সুতো।
১ ডজন অফিসিয়াল খাম।
১৮৭২ ও ১৮৭৩ সালের নটিক্যাল আলমানাক।
১ টা ফাঁকা জার্নাল।
১ টা বন্ধ করা ক্রোনোমিটার।
বেয়াড়া লোকদের জন্য ১টা শিকল।
উপরের বলা সব কিছু ধরলে তাঁর মোট সত্তরটি বোঝা হত, তবে অত বইবার লোক না থাকলে সেগুলো ভয়ানক উদ্বেগের কারণ হয়; এদিকে তাঁর কাছে এখন কেবল নয় জন লোক আছে। অতএব এত সব দুর্দান্ত জিনিসপত্র নিয়ে তিনি কোথায়ই বা যেতেন! তাই আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হল, জাঞ্জিবারে পৌঁছেই আমি পঞ্চাশ জন স্বাধীন কুলি জোগাড় করে , তাদের এমনি প্রয়োজনীয় সজ্জা ছাড়াও প্রত্যেককে বন্দুক আর কুড়ুল দিয়ে সাজিয়ে পাঠাতে। আর তাদের সঙ্গে দুই হাজার গুলি, এক হাজার চকমকি পাথর আর দশ বস্তা বারুদও কিনে পাঠাতে। এই লোকেরা মুটে হিসাবে কাজ করবে, যেখানেই লিভিংস্টোন যাবেন, সেখানেই তাকে অনুসরণ করবে।
যতই তিনি জানুন যে তার হাতে প্রচুর উপায় আছে, সমস্যা হল দলবল, মুটে-কুলি ছাড়া সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব না। কাজেই তাঁর উচ্চাশা তাঁকে শুধুই অলীক লোভ দেখানো ছাড়া আর কিছু করতে পারবে না। লন্ডন বা নিউইয়র্কের সকল সম্পদ তাঁর জন্য সাজিয়ে রাখলেও উপযুক্ত বাহনের অভাবে সেসব তাঁর ধরাছোঁয়ার বাইরে। যুদ্ধ চলাকালীন কোন ন্যামওয়েজি কুলির কাজ করে না। আপনারা যাঁরা আমার উন্যানয়েম্বের দিনলিপি পড়েছেন তাঁরা জানেন যে ন্যামওয়েজিরা কেমন গোঁড়া পুরোনপন্থী হয়। অথচ আমার বিশিষ্ট সঙ্গীটির প্রতি আমার একটা দায়িত্ব রয়েছে। আর সেটা হল দ্রুত উপকূলে পৌঁছানো, এতটাই দ্রুত যেন এর উপর কারোর জীবন-মরণ নির্ভর করছে। আর সেখানে পৌঁছে প্রবল উৎসাহে তাঁর জন্য লোক সংগ্রহ করা - তিনি নিজে উপস্থিত থেকে কাজটা করালে যেমন হত, আমি নিজের জন্য লোক জোগাড় করতে যতটা উৎসাহ দেখাতাম, ততটাই উৎসাহের সঙ্গে কাজটা করতে হবে। তার আগে থামা বা বিশ্রাম নেওয়া যাবে না। আর আমি কাজটা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ; তবে এর জন্য আমার নীল নদ ধরে যাওয়ার আর স্যার এস বেকারের খবর সংগ্রহ করার ইচ্ছেটার সমাধি হল। ডাক্তারের চিঠি লেখার কাজ সারা। তিনি আমার হাতে ব্রিটেনের জন্য খান কুড়ি চিঠি, বোম্বের জন্য ছটা চিঠি, নিউ ইয়র্কের জন্য দুটো আর জাঞ্জিবারের জন্য একটা চিঠি দিলেন।