ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে উন্যানয়েম্বের দিকে প্রত্যাবর্তনের অভিজ্ঞতা। তরজমা স্বাতী রায়
দশম দিন সকালে আমি দলের সবাইকে আশ্বস্ত করলাম যে আমরা খাবারের কাছেই আছি; অঢেল খাবারের প্রতিশ্রুতি তাদের মধ্যে বিনীতদের উত্সাহিত করেছিল। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা না নিতেও সতর্ক করা হয়েছিল - পাছে আমি রাগের মাথায় মেরে বসি! তাতে সবথেকে পাজিগুলোকে চুপ করানো গিয়েছিল। তারপর বনের মধ্য দিয়ে উত্তর-ঈশান দিক বরাবর চললাম। ক্লান্ত মানুষের দল দুর্বলভাবে, বেদনাদায়কভাবে আমার পিছু নিল। খুবই বেপরোয়া অবস্থা তখন, বেচারাদের নিজেদের জন্য যতটা না দুঃখ হচ্ছিল, আমার তার চেয়েও বেশি করুণা হচ্ছিল; আর তারা হাল ছেড়ে শুয়ে পড়লে তাদের সামনে প্রচুর রাগারাগি চেঁচামেচি করলেও, তাদের গায়ে হাত তোলার কথা তখন স্বপ্নেও ভাবিনি। তাদের জন্য খুবই গর্বিত ছিলাম; কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে এটা খুবই বিপজ্জনক ছিল। না তখন ওই রাস্তা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ প্রকাশ করা একেবারে আত্মঘাতী ছিল। তবে আমি যে এখনও ডাক্তারের ছোট্ট মুক্তোর মতন কম্পাস অনুসরণ করে আমার পথ ধরেই চলছি, সেটা ওদের মনের জোর বাড়িয়েছিল। যদিও এটা খুবই পরিষ্কার যে তারা গম্ভীর হয়ে মুখ টিপে পথ চলছিল, তবে তারা বিশ্বস্তভাবে আমার পিছনে ছিল। সেটা আমাকে বেশ নাড়িয়ে দিল।
টানা অনেক মাইল আমরা ঘাসে ভরা মসৃণ ঢালের উপর দিয়ে হাঁটছিলাম, সামনে, ডাইন বাঁয়ে বন ও ঘাসজমির বিরল সৌন্দর্য। অভিযানের মূল দলটিকে পিছনে ফেলে দেওয়ার গতিতে, আমি কয়েকজন সাহসী কুলিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ভারী বোঝা সামলেও তারা আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছিল। কয়েক ঘণ্টা পরে আমরা একটা গিরিশিরার সহজ ঢাল বেয়ে উপরে উঠছিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার ছবি ঠিক না ভুল সেটা বোঝা যাবে বলে মনে হয়েছিল। তারপর আমরা শিরার পূর্ব প্রান্তে পৌঁছলাম, আর প্রায় পাঁচ মাইল দূরে, যে উঁচু মালভূমিতে আমরা দাঁড়িয়ে তার হাজার ফুট নিচে, ইমেরার উপত্যকাকে স্পষ্টভাবে চেনা গেল!
দুপুরের মধ্যে আমরা আমাদের পুরনো শিবিরে এসে গেলাম। চারিদিকে স্থানীয়রা জড়ো হয়েছে, সঙ্গে আমাদের জন্য খাবার। উজিজিতে গিয়ে ফেরত আসার জন্য তারা আমাদের অভিনন্দন জানাতে এসেছিল। বেশিক্ষণ লাগল না, দলের শেষ লোকও এসে গেল। ডাক্তারের পা ক্ষত বিক্ষত, পথ চলার পরিশ্রমে তার থেকে রক্ত ঝরছে। তার জুতোর খুবই জরাজীর্ণ দশা, আর ফোসকাযুক্ত পাকে আরাম দেওয়া জন্য তিনি ছুরি দিয়ে সেগুলোকে এতটাই কেটে দিয়েছিল যে আমাদের বাহিনীর যে কেউ, তা সাহেবদের মতন পায়ে জুতো পরার ইচ্ছা তার যতই প্রবল হোক না কেন, সেগুলো উপহার হিসাবেও নেবে না।
আমাদের পথপ্রদর্শক আসমানি খুব অবাক হয়েছিল যখন সে দেখল যে একটা পুঁচকে কম্পাস তার চেয়ে ভাল পথ চেনে। সে তখন গম্ভীরভাবে মতামত দিল যে এটা মিথ্যা হতে পারে না। "সামান্য একটা জিনিসের" কাছে হেরে গিয়ে তার খ্যাতির বেলুন চুপসে গিয়েছিল। তারপর থেকে দেশ সম্পর্কে তার জ্ঞানের বারফট্টাই বেশ ভালমতো সন্দেহের চোখে দেখা হত।
নিজেদের ঘাটতি পূরণের জন্য একদিন থামা হল। তারপর ১৮ই জানুয়ারী, ১৮৭২-এ আমরা আবার যাত্রা করলাম। উন্যানয়েম্বের দিকে। ইমেরা পেরিয়ে কয়েক মাইল পরে, আসমানি ফের রাস্তা হারিয়ে ফেলল, তাকে পথ দেখাতে বাধ্য হলাম। ফলে নেতা ও গাইড হিসেবে অতিরিক্ত সম্মান, সেই সঙ্গে বেশ খানিকটা কৃতিত্বও অর্জন করলাম। আমার জুতোরও অবস্থা খুব খারাপ - বলা মুশকিল যে ডাক্তার আর আমার মধ্যে কার জুতোর দশা বেশি খারাপ। উজিজি যাওয়ার সময় উত্তর দিকে চলে গিয়েছিলাম, এখন রাস্তার পাশের জমির চেহারায় সে তুলনায় একটা বিরাট বড় বদল এসেছে। এখন রাস্তার ধারে গোছা গোছা বুনো আঙ্গুর ঝুলছে; ভুট্টাগুলোও বেশ রসালো হয়েছে - খাবার হিসেবে তোলা ও পোড়ানর পক্ষে যথেষ্ট ভাল; বিভিন্ন গাছের থেকে ফুল ঝরে পড়েছে; আর এখানকার ঘন বন আগের চেয়েও বেশি সবুজ ছিল, জমির ঘাসও তাই।
১৯ তারিখে আমরা এমপোকওয়ার একটা নির্জন গ্রামে পৌঁছলাম। হেঁটে হেঁটে ডাক্তারের পা টুটিফাটা - খুব ব্যথাও। তিনি উরিম্বা থেকে পায়ে হেঁটে এসেছিলেন, যদিও তার একটি গাধা ছিল; সেখানে আমি, আমার পক্ষে খুবই লজ্জার কথা বলা যায়, মাঝে মাঝেই শক্তি সঞ্চয় করতে তার পিঠে চেপেছিলাম। যাতে আমি শিবিরে পৌঁছানোর পরে আবার শিকার করতে বেরোতে পারি।
আমাদের ব্যবহারের জন্য দুটি কুঁড়েঘর সাফ করা হয়েছিল, কিন্তু, যখন আমরা একটু আরাম করার চেষ্টা করছি, আমাদের তীক্ষ্ণ-দৃষ্টি দলের লোকেরা এমপকওয়ার পশ্চিম দিকের সমতলে বেশ কটা শিকারের পাল আবিষ্কার করল। তাড়াহুড়ো করে কফির সঙ্গে এক টুকরো ভুট্টার-রুটি খেয়েই, আমি বেরলাম। বিলালি রয়েছে সঙ্গে বন্দুকধারী হিসেবে। ডাক্তারের বিখ্যাত রেইলি রাইফেল ও একরাশ ফ্রেজারের খোলের গুলির সরবরাহ ছিল সঙ্গে। এক গভীর স্রোতে ডুব দিয়ে, ফের ভিজে গেলাম। ঘন ঝোপঝাড় ঠেলে, আধা ঘণ্টা পরে বনের একটা পাতলা অংশে পৌঁছেছিলাম, সেখানে হামাগুড়ি দেওয়া ছাড়া পথ নেই। আধ ঘণ্টার মধ্যে, এক দল জেব্রার একশ চল্লিশ গজের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। তারা একটা বড় গাছের ছায়ায় খেলার ছলে একে অপরকে কামড়াচ্ছে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আমি তাদের নজর কাড়লাম; কিন্তু আমার কাঁধে রয়েছে একটা সত্যিকারের বিশ্বস্ত রাইফেল, আর সঙ্গে সঙ্গে দুই নল দিয়ে দুটো গুলি বেরোল - "ক্র্যাক--ক্র্যাক", ব্যস দুটো সুদর্শন জেব্রা, একটা ছেলে ও একটা মেয়ে, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেই গাছের নীচেই মারা গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাদের গলা কেটে ফেলা হল। আমার সাফল্যের সংকেত দিতেই, দ্রুত এক ডজন লোক এসে আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলল, খুশির চোটে তারা রাইফেলের গুণাবলীর ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগল। আমার নিজের কাছে অবশ্য রাইফেলটার অত কদর ছিল না। মাংস নিয়ে শিবিরে ফিরতে ডাক্তারও অভিনন্দন জানালেন। সেটা বরং আমার কাছে ঢের বেশি মূল্যবান, কারণ তিনি দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় জানতেন, গুলি করে প্রাণী শিকার কাকে বলে।