ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এইবার সাংবাদিকার ভূমিকায় অবতীর্ণ স্ট্যানলে, নথিবদ্ধ করছেন লিভিংস্টোনের মুখে শোনা তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত। তরজমা স্বাতী রায়
লুন্ডা বা লোন্ডা দেশে পা রাখার পরেপরেই, কাজেম্বে শাসিত এলাকায় প্রবেশ করার আগে, লিভিংস্টোন চাম্বেজি নামের একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ নদী পেরিয়েছিলেন। দক্ষিণের সেই ব্যাপ্ত, বিশাল নদী, যে নদীর নামের সঙ্গে লিভিংস্টোনের নাম চিরকাল জড়িয়ে থাকবে, তার সঙ্গে এর খুবই নামের মিল। ব্যাপারটা সেই সময়ে লিভিংস্টোনকে বিভ্রান্ত করেছিল, আর সেই কারণেই , তিনি এই নদীকে তার প্রাপ্য মনোযোগ দেননি, বিশ্বাস করেছিলেন যে চাম্বেজি তাহলে আদতে জাম্বেজিরই উৎস ধারা, আর তাই তিনি মিশরের যে নদীর উৎসের সন্ধান করছেন, তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক বা যোগাযোগ নেই। পর্তুগিজ তথ্যের সত্যতার উপর গভীর বিশ্বাস রাখাই তার দোষ হয়েছিল। এই ত্রুটি সংশোধনের জন্য তাকে অনেক, অনেক মাসের ক্লান্তিকর পরিশ্রম করতে হয়েছে, অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
১৮৬৭ সালের গোড়া থেকেই - ক্যাজেম্বেতে তার আসার সময় থেকে - ১৮৬৯ সালের মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত - উজিজিতে তার পৌঁছানোর সময় অবধি - বেশিরভাগ সময়টাই তিনি পর্তুগিজ অভিযাত্রীদের ভুল তথ্য ও বর্ণনার সংশোধনের কাজ করেছেন। পর্তুগিজরা, চাম্বেজি নদীর কথা বলতে গিয়ে, এটাকে সবসময়ই 'আমাদের জাম্বেজি' বলে উল্লেখ করেছিল - অর্থাৎ, সেই জাম্বেজি যা মোজাম্বিকের পর্তুগিজ এলাকার মধ্য দিয়ে বয়ে যায়। 'নিয়াসা থেকে কাজেম্বে যাওয়ার সময়,' তারা বলেছিল, ‘আপনি আমাদের জাম্বেজি নদী পেরবেন।‘ এইরকম জোর দিয়ে আর বারবার বলা কথা - শুধুমাত্র মুখে বলা কথা তো নয়, তাদের বই ও মানচিত্রেও সেইরকমই দেওয়া – স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপারটা বিভ্রান্তিকর ছিল। ডাক্তার যখন বুঝতে পারলেন যে তিনি যা দেখেছেন ও তাদের থেকে যা বর্ণনা শুনছেন দুটো আদতে আলাদা, সঠিকটা জানা-বলার আন্তরিক আগ্রহে, আর পাছে তিনি নিজেই কোন ভুল করে থাকেন, তাই আগে যে সব জায়গা দিয়ে একবার ঘুরে এসেছেন, আবার সেই সব জায়গা দিয়ে ভ্রমণ করতে শুরু করেছিলেন। বেশ অনেক কটা নদী মিলে তৈরি এক জটিল জলব্যবস্থা ছড়িয়ে আছে অনেকগুলো দেশ জুড়ে। বারবার করে তিনি একটা অতৃপ্ত আত্মার মতো এই দেশগুলোতে ঘুরে বেরিয়েছেন। বারবার বিভিন্ন লোককে একই প্রশ্ন করেছেন, শেষকালে তারা 'লোকটা পাগল; ওর মাথাতেই জল ঢুকেছে!' বলতে শুরু করার ঠিক আগে প্রশ্ন করা থামিয়েছেন।
তবে লুন্ডা আর তার আশপাশের দেশগুলোতে তার নিরন্তর ঘোরা আর ক্লান্তিকর শ্রম সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে - প্রথমত, চাম্বেজি নদী পর্তুগিজদের জাম্বেজি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ; আর দ্বিতীয়ত, চাম্বেজি নদী , যার উৎপত্তি প্রায় ১১° দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে, আসলে মিশরের অত্যুত্তম নদী নীলনদের দক্ষিণতম উপনদী ছাড়া আর কিছুই নয়, আর এইভাবে সেই বিখ্যাত নদীটির দৈর্ঘ্য সোজাসুজি অক্ষাংশের হিসেবে ২,000 মাইলেরও বেশি হয়েছে; আর সেকারণেই নীলনদ মিসিসিপির পরেই, বিশ্বের দীর্ঘতম নদী। জাম্বেজির আসল ও সত্যিকারের নাম হল ডোম্বাজি। লাসেরদা ও তার পর্তুগিজ উত্তরাধিকারী, ক্যাজেম্বে আসার পথে, চাম্বেজি পেরিয়ে এসেছে। এর নাম শুনে তারা স্বাভাবিকভাবেই এটাকে 'আমাদের নিজেদের জাম্বেজি' বলে ধরে নিয়েছে। আর কোনও খোঁজখবর না করেই, এই নদী সেই দিকে ছুটেছে ধরে নিয়ে তার ছবি এঁকেছে।
সেই অঞ্চলে তাঁর বহু আবিষ্কার-প্রসবিনী গবেষণা চলার সময় , লিভিংস্টোন কাজেম্বের উত্তর-পূর্বে স্থিত এক হ্রদে এসেছিলেন। এই এলাকার পূর্ব ও দক্ষিণের সীমানা বরাবর লিয়েম্বা নামের একটা দেশ আছে। সেই দেশের নাম ধরে এই হৃদকে স্থানীয়রা লিয়েম্বা বলে ডাকে। হ্রদের উত্তরদিক খুঁজতে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন যে এটা টাঙ্গানিকা ছাড়া আর কিছু না, বলা যায় তার দক্ষিণ-পূর্বতম প্রান্ত , ডাক্তারের মানচিত্রে এই জায়গাটা দেখতে অনেকটা ইতালির সীমারেখার মতো। বিশাল-ব্যাপ্ত জলাধারের দক্ষিণ প্রান্ত প্রায় ৮° ৪২' অক্ষাংশ ছুঁয়ে, ফলে এর দৈর্ঘ্য উত্তর থেকে দক্ষিণে, ৩৬০ ভৌগলিক মাইল। টাঙ্গানিকার দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে তিনি মারুনগান পেরোন আর মোয়েরো হ্রদ দেখতে পান। প্রায় ষাট মাইল লম্বা এই হ্রদটার সীমানা বরাবর যেতে যেতে এর দক্ষিণ দিকের মাথায় তিনি একটা নদীর সন্ধান পান। সে নদীর নাম লুয়াপুলা। সে দিক থেকে এটা হৃদে প্রবেশ করে। লুয়াপুলা নদী ধরে আরও দক্ষিণে গিয়ে, তিনি আবিষ্কার করেন যে সুবিশাল ব্যাংওয়েওলোর জলাধার থেকে এই নদী বেরিয়েছে। ব্যাংওয়েওলো হৃদ প্রায় টাঙ্গানিকার মতোই আকারে বড়। যে জলস্রোতগুলো জল বয়ে এনে সেই হ্রদে ঢালছিল, তাদের বিষয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন যে এই উপনদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল চাম্বেজি; অতএব এরপর তিনি চাম্বেজি নদীর উৎস থেকে ব্যাংওয়েওলো হ্রদ পর্যন্ত পরিক্রমা করেন। সেই সঙ্গে এর উত্তরপ্রান্তের থেকে বেরোনো লুয়াপালা নামের জলধারাটিও পরিক্রমা করেন ও সেই নদীটিকে মোয়েরো হ্রদে প্রবেশ করতে দেখেন। আবার তিনি কাজেম্বেতে ফিরে আসেন, ততক্ষণে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে এই যে নদী প্রায় ৩০° অক্ষাংশ ধরে উত্তর দিকে বয়ে গেছে, সেটা জাম্বেজি নামের সেই দক্ষিণের নদীটি কিছুতেই হতে পারে না, যদিও তাদের নামের মধ্যে খুবই মিল।
দু'জন বাদে বাকি সকলেই ডাক্তারকে পরিত্যাগ করেছিল, এমনকি বিশ্বস্ত সুসি ও চুমাহ মোহাম্মদ বিন সালির দলে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন। তবে তারা শিগগিরই অনুতপ্ত হয়েছিল ও তাদের আদি আনুগত্যে ফিরে এসেছিল। যেদিন থেকে ওই ইতর বুড়োটা তাঁর দলে এসে জুটেছিল, সেদিন থেকে ১৮৬৯ সালের মার্চ মাসে উজিজিতে এসে পৌঁছান পর্যন্ত বহুবিধ তিক্ত দুর্ভাগ্য ডাক্তারকে অনুসরণ করেছিল।
উজিজিতে পা রাখার দিন থেকে ১৮৬৯ সালের জুন মাসের শেষ পর্যন্ত, তিনি উজিজিতে ছিলেন। যদিও বহির্বিশ্বের অনেকেই তাঁর এখনও জীবিত থাকার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন, তবু এই সময়েই তিনি যেসব চিঠিপত্র লিখেছিলেন, তাতে রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি ও তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুরা তাঁর জীবিত থাকার বাবদে নিঃসন্দিগ্ধ হয়েছিল। মুসা'র সেই গল্পটা একটা ভীতু দল-পালানো লোকের উর্বরমস্তিষ্কের দারুণ উদ্ভাবনা হলেও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছিল। এই সময়েই টাঙ্গানিকা হ্রদের চারপাশে নৌভ্রমণ করার ইচ্ছেটা তার মাথায় চাড়া দিয়েছিল, কিন্তু আরবরা বা স্থানীয়রা তাঁকে ঠকানোর জন্য এতই ব্যস্ত ছিল যে, যদি তিনি নৌকা-অভিযানে বেরতেন, তাহলে তাঁর কাছে পণ্যের যে অবশিষ্টাংশ পড়ে ছিল, তাই দিয়ে তিনি ওই জল নিষ্কাসনের কেন্দ্রীয় পথ ধরে অভিযান সম্পূর্ণ করতে পারতেন না। জল নিষ্কাশনের এই কেন্দ্রীয় পথের শুরু কাজেম্বের অনেকটা দক্ষিণে, প্রায় ১১° অক্ষাংশে, চাম্বেজি নামের নদীতে।
ক্লান্ত ক্যাপ্টেন বার্টন যে সময়ে জাঞ্জিবারের কাছের উপকূল থেকে যাত্রা শুরু করে উজিজিতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, সেই সময়ে উজিজি থেকে বেরিয়ে লিভিংস্টোন যে সব জায়গায় পা রেখেছিলেন, কিছু আবছা বিবরণ ছাড়া সেসব জায়গার কথা আরবদের কাছেও অজানা ছিল। মেসার্স বার্টন ও স্পেক মনে হয় এই সব জায়গার নামই শোনেননি। বার্টনের অভিযানের ভূগোলবিদ, স্পেক উরুয়া নামক একটা জায়গার কথা শুনেছিলেন, আরবদের থেকে একটা মোটামুটি সাধারণ দিক শুনে আন্দাজে তাঁর মানচিত্রে জায়গাটা বসিয়েছিলেন; তবে স্থানীয়রা ও লিভিংস্টোন যে জায়গাটাকে রুয়া বলে জানেন, সেটা একটা বিশাল দেশ, ৬° অক্ষাংশ জুড়ে ছড়ানো আর পুবে পশ্চিমে যে কতদূর বিস্তৃত তা এখনও অজানা। আরবদের মধ্যে সবচেয়ে উদ্যমী মানুষেরাও, হাতির দাঁতের সন্ধানে, শুধুমাত্র রুয়ার সীমান্ত এলাকা অবধি গিয়েছিল।
১৯৬৯ সালের জুনের শেষদিকে, লিভিংস্টোন উজিজি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর শেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ অভিযানমালার জন্য হৃদের পশ্চিম তীরের উগুহহাতে আসেন; এই অভিযানের ফলে তিনি আরও একটা বেশ বড় আকারের হৃদ আবিষ্কার করেন। বিরাট নদী লুয়ালাবা এই হৃদকে মোয়েরোর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। তিনি যে সংযুক্ত হ্রদ-মালিকা আগেই আবিষ্কার করেছিলেন, এটা সেই হৃদ-মালারই একটা অংশ।
(ক্রমশ…)