ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এইবার সাংবাদিকার ভূমিকায় অবতীর্ণ স্ট্যানলে, নথিবদ্ধ করছেন লিভিংস্টোনের মুখে শোনা তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত। তরজমা স্বাতী রায়
এক রাতে আমার নোট-বই বের করলাম, আর তাঁর মুখ থেকে তাঁর ভ্রমণ সম্পর্কে বক্তব্য শোনার জন্য বসলাম; নিঃসংকোচে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বললেন। তার একটি সারসংক্ষেপ নিচে দেওয়া হল। ডাঃ ডেভিড লিভিংস্টোন ১৮৬৬ সালের মার্চ মাসে জাঞ্জিবার দ্বীপ থেকে রওনা দেন। পরের মাসের ৭ তারিখে তিনি সদলবলে কিন্ডিনি বে থেকে আফ্রিকার অভ্যন্তরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তাঁর দলে ছিল বোম্বাই থেকে আসা বারোজন সিপাই, কোমোরো দ্বীপপুঞ্জের জোহানার নজন লোক, সাতজন মুক্তি পাওয়া দাস, আর দু'জন জাম্বেজির লোক। তাদের পরীক্ষামূলক ভাবে দলে নেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ছটা উট, তিনটে মোষ, দুটো খচ্চর আর তিনটে গাধা। এইরকম মোট ত্রিশজন লোক সঙ্গে ছিল, যাদের মধ্যে বারোজন যেমন সিপাই ছিল, যারা দলকে পাহারা দেবে। তাদের বেশিরভাগই এনফিল্ড রাইফেল দিয়ে সজ্জিত। সেই রাইফেলগুলো বোম্বাই-এর সরকার ডাক্তারকে উপহার দিয়েছিল।
অভিযানের মালপত্র বলতে ছিল দশটা কাপড়ের গাঁটরি আর দু'ব্যাগ পুঁতি। মুদ্রা হিসাবে ব্যবহারের জন্য। ডাক্তার যে দেশে যেতে চাইছিলেন সেখানে জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগুলোর বিনিময়েই কিনতে পারবেন। দুর্বহ রকমের অর্থ ছাড়াও, ক্রোনোমিটার, এয়ার থার্মোমিটার, সেক্সট্যান্ট ও আর্টিফিসিয়াল হরাইজন (উচ্চতামাপক যন্ত্র), কাপড়ের বাক্স, ওষুধ এবং ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিও ছিল। রোভুমা নদীর বাম দিক দিয়ে এই অভিযান চলেছিল, খুবই দুর্গম পথ - যে সব পথ বেছে নেওয়া যেত, তার সবগুলিই অবশ্য এমনই কঠিন। নদীর তীর ঘেঁষে থাকা ঘন, প্রায় দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্য দিয়ে লিভিংস্টোন ও তাঁর দলকে মাইলের পর মাইল কুড়ুল দিয়ে পথ কাটতে কাটতে যেতে হয়েছে। রাস্তাটা নিছকই শুঁড়িপথ, ঘন গাছপালার মধ্য এঁকেবেঁকে চলা, কোথায় যাচ্ছি না ভেবেই সহজতম পথ খুঁজে নেওয়া। কুলিরা সহজেই এগোতে পারছিল; কিন্তু উটগুলো এতই উঁচু যে কুঠার দিয়ে পথ পরিষ্কার না করলে তারা এক পাও এগোতে পারছিল না। জংলীদের সরঞ্জামগুলোর প্রায় সবসময় দরকার লেগেছে; তবে সিপাই আর জোহান্নাদের কাজ করতে অনিচ্ছার কারণে অভিযানের অগ্রগতি প্রায়শই ব্যাহত হচ্ছিল।
উপকূল থেকে রওনা দেওয়ার পরপরই, এই লোকগুলোর বচসা ও অভিযোগ জানানো শুরু হয়। প্রত্যেক সময়ে আর প্রতিটি সুযোগে তারা এগোনোর প্রতি তীব্র অনীহা প্রকাশ করে। ডাক্তারের অগ্রগতি রোধ করার জন্য, আর এই আশায় যে এর ফলে তিনি উপকূলে ফিরে যেতে বাধ্য হবেন, এই লোকেরা এত নিষ্ঠুরভাবে প্রাণীগুলোর সঙ্গে আচরণ করেছিল যে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আর একটাও বেঁচে ছিল না। কিন্তু এই উপায়টা যখন খাটল না, তখন তারা শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করে স্থানীয়দের খেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করতে লাগল, সাহেবরা নাকি অদ্ভুত অদ্ভুত নিয়ম মানে! এই পরিকল্পনাটা সফল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আর এই ধরনের লোক সঙ্গে থাকাও বিপজ্জনক। তাই ডাক্তার এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে তাদের ছেড়ে দেওয়াই ভাল। সেই অনুযায়ী সিপাইদের উপকূলে ফেরত পাঠালেন; তবে তার আগে তাদের সঙ্গে উপকূলে ফেরার পথের বেঁচে থাকার মত জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করেই ফেরত পাঠালেন। এই লোকগুলোকে সবাই এমন খাটো চোখে দেখত, স্থানীয়রা তাদের ডাক্তারের ক্রীতদাস বলে বলত। এদের সবচেয়ে খারাপ পাপগুলোর মধ্যে একটা এই যে, যে মেয়েলোক বা বাচ্চাকেই প্রথম দেখত, ধমক-চমক আর মিথ্যে অকারণ প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার ঘাড়ে এরা নিজেদের বন্দুক ও গোলাবারুদ চাপিয়ে দিত। এক ঘণ্টা হাঁটলেই এরা ক্লান্ত হয়ে পড়ত আর তারপর রাস্তায় শুয়ে পড়ে নিজেদের কঠিন ভাগ্যের জন্য হাহুতাশ করত, দলনেতার উদ্দেশ্যগুলো বানচাল করার জন্য নতুন নতুন পরিকল্পনা করত। সাধারণত এরা রাতের দিকে আধ-মরা চেহারায় শিবিরে এসে হাজির হত। এই ধরনের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই খুবই বাজে পাহারাদার; কেননা, যদি কোন স্থানীয় উপজাতিদের ভ্রাম্যমাণ ছোট-বড় দল অভিযানকে আক্রমণ করত, তবে ডাক্তার কোনও প্রতিরক্ষা করতে পারতেন না। আত্মসমর্পণ করা ও শেষ হয়ে যাওয়া ছাড়া তার হাতে অন্য কোনও বিকল্পই থাকত না।
১৮ ই জুলাই, ১৮৬৬ তারিখে ডাক্তার ও তার ছোট্ট দল রোভুমা থেকে দক্ষিণে আট দিনের পথ দুরে ওয়াহিইউ প্রধানের একটি গ্রামে এসে পৌঁছান। গ্রামটা নিয়াসা হ্রদের পাশে। রোভুমা নদী ও এই ওয়াহিইউ গ্রামের মাঝের এলাকাটা একটা জনবসতিহীন ধু-ধু প্রান্তর, এইটা পেরোতে গিয়ে লিভিংস্টোন ও তার দলবল খুবই খিদের জ্বালায় ভোগেন। অনেকেই দল ছেড়ে পালায়।
১৮৬৬ সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে, ডাক্তার এমপোন্ডার দেশে আসেন। এমপোন্ডা একজন সর্দার। সে নিয়াসা হ্রদের কাছে বাস করে। সেই দিকে যাওয়ার সময়, দু'জন ক্রীতদাস যাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তারা তাকে ছেড়ে চলে যায়। এখানেও, ডাক্তারের আরেক চেলা ওয়েকোটানি, তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য জোরজার করে। এই বলে যে সে নাকি তার ভাইকে খুঁজে পেয়েছে। পরে অবশ্য ডাক্তার জানতে পারেন যে সেকথা সর্বৈব মিথ্যে। সে আরও জানায় যে নিয়াসা লেকের পূর্ব দিকে তার পরিবারের বাস। আরও বলে যে তার বোন হল এমপোন্ডার প্রিয় স্ত্রী। ওয়েকোটানি তার সঙ্গে আর যেতে রাজি নয় বুঝতে পেরে, ডাক্তার তাকে এমপোন্ডার কাছে নিয়ে গেলেন। সে তাকে এখনই প্রথমবার দেখল- শুনল। অকৃতজ্ঞ ছেলেটাকে তার 'বড় ভাই' না ডাকা অবধি বেঁচে থাকার মতন পর্যাপ্ত কাপড়-পুঁতি দিয়ে, তাকে প্রধানের কাছে রেখে গেলেন। তার আগে এব্যাপারে আশ্বস্ত হলেন যে ছেলেটি সেখানে সম্মানজনক আচরণ পাবে। ওয়েকোটানি লিখতে-পড়তে পারত। এটা তার বোম্বেতে অর্জিত কৃতিত্ব। সেখানে তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। ডাক্তার তাকে লেখা-লেখির কাগজও দিয়েছিলেন যাতে যে কোনও সময় তার মনে হলে, সে তার ইংরেজ বন্ধুদের কাছে বা ডাক্তারকে চিঠি লিখতে পারে। ডাক্তার তাকে আরও নির্দেশ দিয়েছিলেন যে সাধারণত তার দেশোয়ালিরা, নিয়াসার লোকরা নিজেদের প্রতিবেশীদের উপর যে ক্রীতদাস অভিযান চালায় তাতে যোগ না দিতে। নিজের মুক্তির আবেদন সফল হয়েছে জানতে পেরে, ওয়েকোটানি ডাক্তারের আরেক চেলা, ওয়েকোটানির সহচর, চুমাহকে ডাক্তারের কাজ ছেড়ে দিয়ে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। ঘুষ হিসাবে তাকে বৌ জোগাড় করে দেওয়ার আর 'বড় ভাই' এর থেকে প্রচুর পম্বে পাইয়ে দেওয়ার কথা দেয়। চুমাহ ডাক্তারের কাছে বিষয়টি তুললে, ডাক্তার তাকে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ তিনি (ডাক্তার) গভীর সন্দেহ করেছিলেন যে ওয়েকোটানি কেবল তাকে নিজের দাস বানাতে চায়। চুমাহ বুদ্ধিমানের মত সেই প্রলোভন থেকে সরে এসেছিল। এমপোন্ডার এলাকা থেকে, ডাক্তার নিয়াসা হ্রদের পায়ের দিকে এগিয়ে গেলেন।এক বাবিসা সর্দারের গ্রামে গেলেন। তার চর্মরোগের চিকিৎসা দরকার ছিল। লিভিংস্টোন নিজের স্বভাবগত দয়া দেখিয়ে, সর্দারের অসুখের চিকিৎসার জন্য এই প্রধানের গ্রামে থেকে গেলেন।
(ক্রমশ…)