আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। পঞ্চম অধ্যায় অবধি ছিল চুন্যু (চুন্যো) নামক জনপদে পৌঁছোনোর কাহিনি। এবার শুরু হল চুন্যু থেকে পথচলা। এ কিস্তিতে আছে এমভূমি অঞ্চল পার করার বর্ণনা, এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই মানচিত্রে নীল দাগ দেওয়া পথের আশেপাশেই।— সম্পাদক
২৭ মে আমরা সানন্দে গা থেকে এমভূমির ধুলো ঝেড়ে ফেলে নিজেদের পথে হাঁটা দিলাম, সিধে পশ্চিমমুখো। আগের রাতে আমার পাঁচটা গাধা মারা গেছে, মারেঙ্গা এমকালির জলের প্রভাবে। এমভূমির শিবির ছেড়ে যাওয়ার আগে, তাদের দেহাবশেষ দেখতে গেলাম; তবে দেখলাম যে হায়েনার দল একদম সাফ করে দিয়েছে আর হাড়গুলোর দখল নিয়েছে সাদা-গলার কাকের১ বাহিনী।
অসংখ্য গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবছিলাম এই জায়গাটার পুরোটাই যেন একটা বিশাল শস্যক্ষেত্র, সেইসঙ্গে সাহেবকে একবার লোভী চোখে দেখে আনন্দ পাওয়ার জন্য রাস্তার ধারে দলে দলে অপেক্ষারত লোকদের গুনছিলাম—গোগোদের ওই জুলুমবাজিতে আর একটুও অবাক লাগছিল না! এটা স্পষ্ট যে একটা কাফেলার যাই কিছু মালপত্তর থাক না কেন, সেসব দখল করার জন্য হাত বাড়ানো ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই। যেসব লোকেরা নিজের শক্তি জেনেও তাকে ব্যবহার করে না তাদেরই আমার বেশি ভালো লাগতে শুরু করল। সেই লোকরাই বেশি ভালো যারা এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধিমান যে কোনো জুলুম না করে কাফেলাকে এগিয়ে যেতে দেওয়াই তাদের পক্ষে মঙ্গল।
এমভূমি ও মাটামবুরু, মানে পরের সুলতানের এলাকার, মধ্যে, গুণতিতে কম করেও পঁচিশটা গ্রাম পেলাম, রঙিন কাদাজমির উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এখানকার পরিবেশ আতিথ্যবিমুখ হলেও, বাগামোয়ো ছাড়ার পর থেকে আমরা যেসব এলাকা দেখেছি তাদের তুলনায় এখানে অনেক ভালো চাষ হয়।
শেষ অবধি আমরা যখন আমাদের মাটামবুরুর শিবির-এলাকায় পৌঁছালাম, এমভূমির মতো একই দৃশ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, সেই একই কৌতুহলী লোকের দল, একই উৎসাহী মুখচোখ, সেই এক বিস্ময়ের প্রকাশ, সাহেবের পোশাক-আশাকে বা আচার আচরণে সেই একই হাসির হররা। আরবরা যেহেতু ‘ওয়াকোনোঙ্গো’ যাত্রী, প্রতিদিনই তাদের দেখা যায়, তাই ভোগান্তি পোহাতে হল শুধু আমাদেরই—আরবরা সে ঝামেলার থেকে সম্পূর্ণ রেহাই পেয়েছিল।
মাটামবুরুর সুলতানের চেহারা দৈত্যের মতো আর মাইলোর২ কাঁধের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কাঁধের উপর শক্ত করে বসানো বিশাল মাথা। দেখা গেল তিনি অত্যন্ত যুক্তিসংগত মানুষ। এমভূমির সুলতানের মতন ততটা শক্তিশালী না, তবে তিনিও উগোগোর একটা বড়ো অংশের মালিক, প্রায় চল্লিশটা গ্রামের, চাইলে তিনিও এমভূমির সুলতানের মতোই আমার আরব সঙ্গীদের ব্যবসায়ী মনের উপর অত্যাচার করতে পারতেন। চার ডটি কাপড় প্রাথমিক নজরানা হিসেবে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাতে তিনি বললেন যে যদি আরবরা আর সাহেব তাঁকে আরও চার ডটি পাঠান তবে তিনি এটা নেবেন। তাঁর দাবিদাওয়া এতই যুক্তিসংগত ছিল যে খুব শীঘ্রই এই ছোট্ট ব্যাপারটার সকলের পক্ষেই সন্তুষ্টিজনক একটা নিষ্পত্তি হল; আর তার অল্প পরেই, শেখ হামেদের কিরণগোজি৩ পরদিনের যাত্রার সংকেত ঘোষণা করলেন।
শেখের নির্দেশে, জড়ো হওয়া সকল কাফেলার মানুষদের সামনে কিরণগোজি বক্তৃতা করতে উঠল। হাঁক পেড়ে উঠল, “শোনো, প্রভুর কথা শোনো। কান খুলে শোনো, কিরণগোজিরা শোনো! শোনো, উন্যাময়েজির ছেলেমেয়েরা! কাল আমাদের যাত্রা! রাস্তা আঁকাবাঁকা ও খারাপ! জঙ্গলে ভরা, আর তার মধ্যে অনেক গোগো লুকিয়ে থাকে! কুলিদের তারা বর্শা ছুড়ে মারে, আর যারা মুটুম্বা (কাপড়ের গাঁটরি) ও উশাঙ্গা (পুঁতির মালা) বয়ে নিয়ে যায় তাদের গলা কেটে দেয়! গোগোরা আমাদের শিবিরে এসেছিল, ওরা তোমাদের কাপড়ের গাঁটরিগুলো দেখেছে; আজ রাতে তারা জঙ্গলে গিয়ে অপেক্ষা করবে: উয়ান্যাম্বেজির লোকরা! ভালো করে খেয়াল করে চলবে! দল বেঁধে থাকবে, পিছিয়ে পড়বে না! কিরণগোজিরা ধীরে চলবে, যাতে দুর্বল, অসুস্থ এবং বাচ্চারা জোয়ানদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে! পথে দু-বার বিশ্রাম নেবে! এসব প্রভুর কথা। শুনতে পেয়েছ সকলে? (একটা উচ্চস্বরে চিত্কার এল সবার থেকে, যার মানে হ্যাঁ) বুঝতে পেরেছ? (আবার সমস্বরে চিৎকার) তাহলে ব্যাস”, এই বলে বাক্যবাগীশ কিরণগোজি সেই অন্ধকার রাতের আড়ালে, নিজের খড়ের কুঁড়েতে বিশ্রাম নিতে গেল।
আধুনিক মানচিত্রে বিহওয়ানা। এখানে দর্শিত ‘মাটামবুলু’-ই যে স্ট্যানলে-র ‘মাটামবুরু’ তা আন্দাজ করে নিতে অসুবিধা হয় না। বিহওয়ানা বর্তমানে একটি খ্রিশ্চান মিশন, তানজানিয়ার রাজধানী বিশাল দোদোমা শহরাঞ্চলের অন্তর্গত
বিহওয়ানা, অর্থাৎ আমাদের পরবর্তী শিবিরের দিকে যাত্রাটি বন্ধুর ও দীর্ঘ, পথ চলেছে গঁদগাছ আর কাঁটাঝোপের টানা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, খাড়া পাহাড়ি পথ, অবশেষে চলেছে একটা তপ্ত সমতলের উপর দিয়ে, যেখানে যতই সূর্য মধ্যগগনের কাছে যাচ্ছে ততই তার তেজ বাড়ছে, যতক্ষণ না নির্জীব প্রকৃতির থেকে সবটুকু জীবনীশক্তি শুষে নিচ্ছে—একটা সাদা জ্বলজ্বলে দৃশ্য, ওই জ্বালার থেকে রেহাই পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় ক্লান্ত চোখের কাছে অসহ্য সে দৃশ্য। কয়েকটা বালিময় জলধারাও এই পথে পেরিয়ে এলাম, যাদের টানে অজস্র হাতির দল ছুটে আসে। এই নদীখাতগুলোর ঢাল দক্ষিণ-পূর্ব আর দক্ষিণ দিকে।
এই উত্তপ্ত সমতলের মাঝখানে অবস্থিত বিহাওনার গ্রামগুলো সব প্রায় এক রকমের দেখতে—অত্যন্ত নীচু নীচু কুঁড়েঘর। এতই নীচু যে ওই বেলাগাম তাপে পুড়তে থাকা, লম্বা, রংজ্বলা ঘাসের মাথাও ছোঁয়নি। আমাদের শিবিরটা একটা বিশাল ঘেরা এলাকায়, সুলতানের বাড়ি থেকে প্রায় এক চতুর্থাংশ মাইল দূরে। শিবিরে পৌঁছানোর পরপরই তিনজন গোগো এল, আমার কাছে জানতে চাইল যে আমি রাস্তায় বউ-বাচ্চাসুদ্ধ কোনো গোগোকে দেখেছি কি না। খুবই সরলভাবে ‘হ্যাঁ’ বলতে যাচ্ছিলাম, তখন সতর্ক আর মনিবের স্বার্থবিষয়ে সদাসচেতন মাব্রুকি আমাকে উত্তর দিতে বারণ করল, চলিত রীতি অনুসারে গোগোরা তাহলে তাদের শেষ করে দেওয়ার দায় আমার উপর চাপাবে আর আমার থেকে ক্ষতিপূরণ চাইবে। আমার ঘাড়ে এমন দোষ চাপানোর চেষ্টা করাতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের চাবুকপেটা করে শিবির থেকে তাড়ানোর জন্য যেই চাবুক তুলতে গেছি, মাব্রুকি সঘোষে আবার আমাকে সাবধান করল, কারণ প্রতিটি আঘাতের জন্য আমাকে তিন বা চার ডটি কাপড় দিতে হবে। নিজের রাগের ঝাল মেটানোর জন্য এত খেসারত দিতে অবশ্য আমি মোটেই রাজি ছিলাম না, অগত্যা বাধ্য হলাম রাগ গিলে ফেলতে আর ফলে গোগোরা শাস্তির হাত থেকে রেহাই পেল।
দোদোমা অঞ্চলের যে প্রান্তরের বর্ণনা করেছেন স্ট্যানলে তার বর্তমান রূপ। এখন বিখ্যাত বন্যপশু-পর্যটনের জন্য
এইখানে আমরা একদিন থামলাম, আমার পক্ষে সেটা এক বিরাট স্বস্তির ব্যাপার হল, যেহেতু আমি তখন প্রায় দু-সপ্তাহ ধরে থেকে থেকেই জ্বরে খুব ভুগছিলাম, এমনকি হাঁটার পরে প্রতি সন্ধ্যায় সবকিছু ডায়ারিতে লিখে রাখার যে অভ্যাসটা করেছিলাম, সেটা পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হয়েছিল।
প্রজারা যতই শত্রুভাবাপন্ন আর চুরি বা হত্যায় সদাপ্রস্তুত হোক না কেন, বিহাওনার সুলতান নজরানা হিসেবে তিন ডটি কাপড় পেয়েই খুশি। এই প্রধানের কাছ থেকে আমার চতুর্থ কাফেলার খবর পেলাম, সুলতানের বিতাড়িত প্রজাদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার জন্য তাদের আলাদা করে মনে আছে। আমার কয়েকজন কুলিকে রাস্তায় পাকড়িয়ে কাপড়ের গাঁটরি আর পুঁতির বোঝা নিয়ে পালানোর চেষ্টা করায় আমার সৈন্যরা দু-জনকে মেরে ফেলেছিল; ঠিক সময়ে হাজির হয়ে, সৈন্যরা নিশ্চিতভাবে লুঠেরাদের আটকে দিয়েছিল। সুলতান ভেবেছিলেন যে, সমস্ত কাফেলাই যদি আমার কাফেলার মতো সুরক্ষিত হত তবে পথে তাদের উপর লুঠতরাজের ঘটনা কম হত; এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি আন্তরিকভাবে একমত।
ক্রমশ...