ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে উকাওয়েন্ডি, উভিনযা ও উহহা-র মধ্য দিয়ে উজিজি যাত্রার বর্ণনা। তরজমা স্বাতী রায়
৩১শে অক্টোবর। মঙ্গলবার। জঙ্গলের শিবির। উত্তর-পূর্ব দিকের রাস্তা। হাঁটার সময় সোয়া চার ঘণ্টা।
ত্রিভুজাকার পর্বতের পাদদেশ ছেড়ে চললাম। আমাদের অবস্থান থেকে সিধা মালাগারাজি নদীর মাঝে একটা গভীর আর পারাপার-অযোগ্য জলাজমি আছে। তাকে এড়ানোর জন্য, অনেকটা সময় ধরে আমাদের রাস্তা পুর্ব-ঈশান কোণ বরাবর চলল। এই জায়গাটাতে এনজোগেরার ছেলে নিজের অধিকার কায়েম করেছে। উপত্যকা দ্রুত ঢালু হয়ে এই জলাতে গিয়ে মিশেছে, তিনটে বিস্তৃত পাহাড়ের শ্রেণীর থেকে জল এসে এই জলার ছড়ানো বুকে জমা হয়। শীঘ্রই আমরা উত্তর-পশ্চিমে মুখ ঘোরালাম ও জলাভূমি পেরোনোর জন্য প্রস্তুত হলাম, যখন আমরা জলার পূর্বদিকে থামলাম, গাইডরা আগের এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের কথা জানাল, আমরা যেখানে পারাপারের ব্যবস্থা করছি, তার থেকে কয়েক গজ উত্তরে ঘটেছিল সেই ঘটনা। এক আরব আর তার পঁয়ত্রিশ জন ক্রীতদাসের কাফেলার গল্প শুনলাম, তারা কেমন হঠাৎ করেই চোখের আড়ালে চলে গিয়েছিল, যাদের কথা আর কখনও শোনা যায়নি! এই জলাটা, যা দেখলাম, চওড়ায় বেশ কয়েকশ’ গজ, ঘাসে ছাওয়া, তার সঙ্গে অনেক পচা-গলা জিনিস মিশে আছে। এর ঠিক মাঝখানে, নিচ দিয়ে – একটা প্রশস্ত, গভীর ও দ্রুত স্রোত বয়ে যাচ্ছে। গাইডরা ওপারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার দলের সবাই সাবধানে পা টিপে টিপে তাদের পিছু নিল। তারা যেই কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছেছে, তখন এই ঘাসে ঢাকা দোদুল্যমান সেতুটা দেখতে পেলাম – প্রকৃতিই যেন সেটা আমাদের জন্য আশ্চর্যভাবে তৈরি করে রেখে গেছে; সেতুটা উপর-নিচে খুব ঢিমেতালে দুলছে, ঝড়ের পরে সমুদ্র যেমন ফুলে ওঠে। অভিযানের দুটো গাধা যেই সেখানে পৌঁছেছে, ঘাসের ঢেউ এক ফুট উপরে উঠে গেল, সহসা একটা হতভাগা প্রাণী তার মধ্যে পা ডুবিয়ে দিল, আর উঠতে পারে না। তুরন্ত একটা গভীর গর্ত তৈরি হয়ে গেল, দ্রুত জলে ভরে যেতে থাকল। তবে দশজন লোক মিলে তাকে কোনোক্রমে টেনে উপরে তোলা হল আর একটা শক্ত জায়গায় দাঁড় করানো গেল। দুটোকেই তাড়াতাড়ি জলা পেরিয়ে ওপারে নিয়ে যাওয়া গেল। পুরো কাফেলা দুর্ঘটনা ছাড়াই সেদিন পার হতে পেরেছিল।
অন্য পারে পৌঁছে আমরা উত্তর দিকে চললাম; এই জায়গাটা মনোরম, সব দিক দিয়েই চাষের উপযুক্ত। এখানে-সেখানে বড় বড় পাথর আছে বটে, কিন্তু তাদের ফাটলে বিশাল বিশাল গাছ, আর গাছের ছায়ায় ছায়ায় রয়েছে মানুষের গ্রাম। গাঁওবুড়োদের কাপড়ের উপর খুব লোভ, কিন্তু এনজোগেরার ছোট ছেলের দলবল হাজির থাকায় তাদের তোলাবাজির প্রবণতাকে চেপেচুপে রাখতে হল। ছাগল-ভেড়া ভারি সস্তা ও বেশ যত্নে রাখা, আর, সেই কারণেই, মালাগারজির কাছে পৌঁছে যাওয়ার আনন্দে, সেদিন আটটা ছাগলের একটা পাল জবাই করা হল আর দলের সবার মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হল।
১ নভেম্বর। শিবির ছেড়ে, উত্তর-পশ্চিম দিক বরাবর একটা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসার পরে, মালাগারজি নদীটি দেখতে পেলাম, বড়ই ব্যগ্র হয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সরু কিন্তু গভীর স্রোত, উঁচু পাহাড় ঘেরা একটা উপত্যকার মধ্য দিয়ে বইছে। মাছ-শিকারী পাখিরা তার পাড়ে গাছে গাছে সারি দিয়ে বসা, গ্রামগুলো ঘনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অনেক খাবার, সস্তাও।
নদীর বাঁদিক ধরে কয়েক মাইল যাওয়ার পর, একটা বসতিতে এলাম। কিয়ালা এখানকার সর্দার। ভেবেছিলাম, যে তখনই নদী পার হব, কিন্তু তা হল না। আমাদের শিবির স্থাপন করতে বলা হল, তারপরই আলোচনা হবে। আমরা আপত্তি প্রকাশ করলে বলা হল, যে আমরা ইচ্ছা করলে নদী পেরোতেই পারি, তবে কোনো ভিনজা আমাদের সাহায্য করবে না।
এদিনের জন্য থামতে বাধ্য হলাম, একটা গ্রামের মাঝখানে তাঁবু খাটানো হল আর একটা কুঁড়েতে সব কাপড়ের গাঁটরিগুলো রেখে চারজন সৈন্যকে সেখানে পাহারা দেওয়ার জন্য মোতায়েন করা হল। কিয়ালা হল মহান সর্দার এনজোগেরার বড় ছেলে। শান্তি বজায় রেখে কাফেলা নিয়ে নদী পার হওয়ার অনুমতি চেয়ে তার কাছে দূত পাঠানো হল। কিয়ালা খবর পাঠালেন, যে শ্বেতাঙ্গ মানুষটি নদী পেরোতেই পারেন, তবে তার আগে ছাপ্পান্নটি কাপড় নজরানা চাই। ছাপ্পান্নটা কাপড় — সে তো প্রায় এক গাঁটরি কাপড়! আবার একটা কূটনীতি প্রয়োগের সুযোগ। বোম্বে ও আসমানীকে কিয়ালার সঙ্গে নজরানা নিয়ে কথা বলার জন্য পাঠানো হল, তবে পঁচিশ ডটির বেশি কাপড় দেওয়া যাবে না। সাত ঘণ্টা ধরে দরাদরি করে, সকাল ৬ টায় তারা দু’জন ফেরত এল, এবারের দাবি এনজোগেরার জন্য তেরো ডটি আর কিয়ালার জন্য দশ ডটি কাপড়। বেচারা বোম্বের গলা ভেঙ্গে গেছে, অবশ্য আসমানী তখনও হাসছে; আমি এই দাবি মেনে নিলাম। নিজেকেই নিজে অভিনন্দন জানালাম, যে এই ডাকাতি-তুল্য অসঙ্গত দাবি অন্তত আগের দাবির থেকে খারাপ নয়।
তিন ঘণ্টা পরে আরেক দফা দাবি পেশ হল। কিয়ালার বাবার কাছ থেকে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য কয়েকজন সর্দার এসেছিল, একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষ ওপারে যাবে শুনে তারা ক’টা বন্দুক আর এক পিপে বারুদের আবদার জুড়ল। কিন্তু এবার আমার ধৈর্য্য শেষ হল, আমি বলে দিলাম, যে তাহলে গায়ের জোরে কেড়ে নিতে হবে, এমন দিনে ডাকাতি কোনোমতেই বরদাস্ত করা যাবে না।
বোম্বে ও আসমানি রাত ১১টা অবধি এইসব অতিরিক্ত দাবিদাওয়া নিয়ে দর কষাকষি করছিল। সেই সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া-ঝাঁটি, হুমকি দেওয়াও চলছিল, শেষে বোম্বে বলল, যে আরও কথা চললে সে এবার পাগলই হয়ে যাবে। বোম্বেকে বললাম, যে দুটো কাপড় নিতে, সর্দারদের মাথাপিছু একটা করে কাপড়, আর তাতেও যদি না পোষায়, তাহলে যুদ্ধই হোক। নজরানা নিয়ে নিল। আর মাঝরাতে আলোচনাতে দাঁড়ি টানা হল।
২ নভেম্বর। গোটা সকালটা ফেরিঘাটে ক্যানোর মালিকদের সঙ্গে ফালতু কথায় নষ্ট হল। অবশেষে বেলা পাঁচটায় আমরা মালাগারাজি নদীর বাম তীরে ইহাতা দ্বীপের সামনে পৌছালাম। কিয়ালার পশ্চিমে, দেড় ঘণ্টা দূরে ইহাতা দ্বীপ। ফেরি পারাপারের জন্য শেষমেষ রফা হল আট গজ কাপড় ও চার ফান্ডো সামি-সামি বা লাল পুঁতি, তখনই সেটা দিয়ে দেওয়া হল। এই ছোট, বেঢপ, টলমলে ক্যানোতে মালপত্র-সহ চারজন নদী পার করতে পারে। যাত্রী আর মালপত্র বোঝাই নৌকাগুলোর মাঝিরা যখন তাদের নৌকা নিয়ে রওনা হল, তখন তাদের অন্যদিকেই থেমে থাকার নির্দেশ দেওয়া হল, আর আমাকে অবাক করে, আরও দাবি জানানো হল। মাঝিরা দেখেছিল, যে এর মধ্যে দু’টি ফান্ডো মাপে খাটো, তাই আরও দুটো ফান্ডো অবশ্যই দিতে হবে, আর নাহলে নদী পারাপারের চুক্তি বাতিল। অগত্যা আরও দুটো ফান্ডো দিতে হল, তবে কিনা প্রভূত প্রতিবাদ, বাকবিতন্ডার পরে – এই দেশের যা নিয়ম।
তিনবার ক্যানোগুলো নদী পারাপার করল, তারপর আবার, দেখ! আরেকটা দাবি হাজির, আবার চিরাচরিত চেঁচামেচি, হট্টগোল ভয়ানক ঝগড়াঝাঁটি হতে থাকল, এইবার যে লোকটা আমাদের পথ দেখিয়ে ফেরি ঘাটে নিয়ে এসেছে, তার জন্য পাঁচ খেটে মালা, ঘ্যানঘেনে বুড়ির মত স্বভাবের জুমার সঙ্গে সঙ্গে যে ভ্যাজর-ভ্যাজর করা লোকটা ছিল, বকবক করা আর কোলাহল বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই যে করেনি, তার জন্য এক শুক্কা কাপড়। সব দাবি মেটানো হল।
সূর্যাস্তের সময় গাধাগুলোকে পার করানোর চেষ্টা শুরু হল। সিম্বা নামের দারুণ বুনো কিন্যামওয়েজি গাধাটার গলায় দড়ি বেঁধে প্রথমে নেওয়ার চেষ্টা করা হল। স্রোতের মাঝামাঝি অবধি যাওয়ার পরে দেখি যে সে হাবু-ডুবু খাচ্ছে – একটা কুমির তার গলা কামড়ে ধরেছে। বেচারা জন্তুটা কী কষ্টই না পেল! চৌপেরেহ গায়ের সব জোর দিয়ে দড়ি টেনেও কিছু করতে পারল না, গাধাটা ডুবে গেল। তাকে আর দেখা গেল না। এখানে নদীর গভীরতা প্রায় পনেরো ফুট। হালকা-বাদামী মাথা, চকচকে চোখ ও খোঁচা-ওঠা পিঠগুলো আশেপাশেই ঘোরাফেরা করছে দেখছি, তবে সরীসৃপগুলো যে নৌকা পারাপারের মত এত উত্তেজনাপূর্ণ দৃশ্যের এত কাছে এসে হাজির হবে, তা কখনই ভাবিনি। এই ক্ষতির জন্য কিছুটা দুঃখ হল, সেই দুঃখ নিয়েই আবার কাজ শুরু করলাম আর সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে আমরা সবাই ওপারে পৌঁছে গেলাম, এক শুধু বোম্বে আর দলের একমাত্র গাধাটার নদী পেরোতে বাকি, তাকে পরের দিন সকালে পার করে আনা হবে, যখন কুমিরদের নদীর এই জায়গাটা ছেড়ে যাওয়ার কথা।
(ক্রমশ...)