আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। যেমন, আগের কিস্তিতে আমরা পেয়েছি, এমপোয়াপোয়া থেকে রওনা হয়ে বিহোয়ানা পার করে কিদিদিমো হয়ে এমসালালো-র (দ্বিতীয় মানচিত্রে) দিকে এগিয়ে যাওয়ার বর্ণনা। কিন্তু এ কিস্তিতে মুকনডোকু ও অন্যানা যে সব জনপদের কথা বলা হচ্ছে তার বর্তমান অস্তিত্ব খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। তবে এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই (ওপরের) মানচিত্রে নীল দাগ দেওয়া পথের আশেপাশেই।— সম্পাদক
মুকনডোকু থেকে আমাদের যাত্রার জন্য ৭ জুন দিনটি নির্দিষ্ট করা হল। অতএব এর আগের দিনই আরবরা আমার তাঁবুতে এলেন, কোন পথে যাওয়া উচিত সেই নিয়ে আমার সাথে পরামর্শ করতে। সংশ্লিষ্ট কাফেলাগুলোর পথপ্রদর্শকদের আর অভিজ্ঞ ন্যাময়েজি কুলিদের একযোগে ডাকা হল আর তাদের থেকে জানলাম যে মুকনডোকু থেকে উয়ানজি যাওয়ার তিনটে রাস্তা। প্রথমটা সবথেকে দক্ষিণের পথ, পূর্বে বর্ণিত কারণগুলোর জন্য এটাই সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়, এটা কিওয়েহের পাশ দিয়ে যায়। এই পথে যেতে হামেদের আপত্তি। "সুলতান মহা বদ লোক," সে বলল; "মাঝে মাঝে কাফেলা-প্রতি মায় কুড়ি ডটি নজরানাও ধার্য করে; আমাদের কাফেলাকে তো তাহলে প্রায় ষাট ডটি দিতে হবে! কিওয়েহের রাস্তা চলবে না মোটেও।’’ সে আরও বলল, ‘‘তাছাড়া কিওয়েহে পৌঁছাতে আমাদের একটা লম্বা জলহীন পথ পাড়ি দিতে হবে। আর তাহলে তো আমরা পরশুর আগে পৌঁছাবই না।” দু নম্বর পথটা মাঝখান দিয়ে গেছে। সে পথ ধরলে আগামীকাল মুনিয়েকায় পৌঁছাবো; পরের দিন মাবাংগুরু নুল্লা থেকে উন্যম্বোগির কাছের শিবিরে পৌঁছাতে লম্বা পথ দ্রুত ছুটতে হবে বটে; তারপর দিন মাত্র দু'ঘন্টা হাঁটলেই কিটি, সেখানে খাবার আর জলের ছড়াছড়ি। কিরণগোজিরা বা আরবরা কেউই এই পথের কথা জানত না, আমার এক বুড়ো কুলি এই পথের কথা জানাল, হামেদ বলল যে এত বড় কাফেলাকে পথ দেখানোর দায়িত্ব কোনও বুড়ো ন্যাময়েজির হাতে ছাড়তে তার ভরসা নেই, কাজেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সে তিন নম্বর রাস্তার কথা শুনতে ইচ্ছুক। তৃতীয় রাস্তাটি উত্তরে। প্রথম দুঘন্টায় অসংখ্য গোগো গ্রাম পেরিয়ে যেতে হবে, তারপরে একটা জঙ্গলে পৌঁছাব ; তারপর আরও তিন ঘণ্টা হেঁটে আমরা পৌঁছাব সিম্বো, যেখানে জল পেলেও কাছে পিঠে গ্রাম-টাম নেই। পরের দিন ভোরে রওনা দিয়ে আমরা ছয় ঘণ্টা হেঁটে একটা ডোবার ধারে পৌঁছাব। এখানে অল্প বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে একটা ঘণ্টা পাঁচেকের দ্বিপ্রাহরিক হন্টন আমাদের নিয়ে যাবে এমন একটা জায়গায় সেখান থেকে পরের গ্রামটা মাত্র ঘণ্টা তিনেক দূরে। এই পথটা যেহেতু অনেকেরই জানা, তাই হামেদ বলল, ‘‘শেখ থানি, সাহেবকে বলুন যে আমার মনে হয় এটাই সেরা পথ।'' আমাকে সেটা জানানো হলে আমি শেখ থানিকে বললাম, যে যেহেতু উগোগোর মধ্যে দিয়ে আমি তাদের সঙ্গেই চলেছি, তারা যদি সিম্বো দিয়েই যাবে বলে ঠিক করে, তবে আমার কাফেলাও তাদেরই পিছু নেবে।
অনেক আলোচনার পরে পথের ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হল, আমি তখন কম্পাস দিয়ে সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোর মাপজোক করতে বসলাম। মনে রাখতে হবে যে আমি বলেছিলাম, মিজানজা থেকে মুকনডোকু সরাসরি পশ্চিমে তিন ঘন্টার পথ। উগোগো ও সংলগ্ন ওয়ায়ানজির মধ্যে সীমারেখা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে একটা শৈলশ্রেণি, কান্যেন্যির আশপাশ থেকে বেরিয়ে উত্তর-পশ্চিমে সেটা উহোম্বোর সীমা অবধি চলে গেছে। সেই পাহাড়কে এড়িয়ে আমরা ততক্ষণে প্রায় সোয়া চার ঘন্টা উত্তর পশ্চিমে হেঁটে ফেলেছি। মুকনডোকু এই পাহাড়ের পূর্ব দিকে মাত্র দু মাইল দূরে: কিওয়েহে মুকনডোকুর দক্ষিণ-নৈঋত দিকে, সেখান থেকে কুসুরি সাত দিনের পথ। সিম্বো হল উত্তর-বায়ু কোণে, সেখান থেকে কুসুরি যেতে লাগে ছয় দিন। কাজেই এটা একদম স্পষ্ট যে কিটির রাস্তাই সংক্ষিপ্ততম। আরবরা বা কিরনগজিরা চেনে না বলেই এই রাস্তা নিয়ে সমস্যা।
বিভিন্ন পথের গুণাগুণ নিয়ে কর্তাদের মধ্যে আলোচনা শেষ হতে না হতেই কুলিদের মধ্যে আলোচনা শুরু হল। সিম্বোর রাস্তায় যাবে না বলে তারা গোঁয়ারের মত গোলমাল শুরু করল। দীর্ঘসময় একটানা হাঁটা আর জল মেলার সম্ভাবনা খুব কম – এটাই আপত্তির কারণ; সিম্বোর রাস্তা নিয়ে আপত্তির কথা সব কাফেলাতেই পৌঁছে গেল— সিম্বো থেকে কুসুরি যাওয়ার পথের নির্জনতা, সেখানে যে জল বা খাবার কিছুই মেলে না এইসব খবর বিশাল বিশাল গল্প হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। হামেদের কুলি আর আরব চাকররা একযোগে ঘোষণা করল যে তারা এই পথে যাবে না, আর হামেদ জোর করলে, তারা তাদের বোঝাগুলো নামিয়ে রেখে দেবে, তারপর সেই মাল হামেদকেই বইতে হবে।
হামেদ কিমিয়ানি। আরবরা তাকে সেভাবেই ডাকে। সে শেখ থানির কাছে ছুটে এল আর বলল যে তাকে কিওয়েহের পথই ধরতে হবে, নাহলে তার কুলিরা সব পালাবে। থানি উত্তর দিল যে তার কাছে সমস্ত রাস্তাই এক, হামেদ যে পথে যাবে, সেও সেই পথই নেবে। এরপরে তারা আমার তাঁবুতে এসে ন্যাময়েজিরা কী সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে তা আমাকে জানাল। আগের দফায় আমার শিবিরে বসে কিটির রাস্তা সম্বন্ধে ভাল ভাল কথা বলেছিল যে বুড়ো ন্যাময়েজি, তাকে আবার ডেকে ওই রাস্তার একটা সঠিক বিবরণ জানতে চাওয়া হল। সেই বর্ণনাও এতই সন্তোষজনক যে আমি হামেদকে বললাম যে কাফেলার মালিক তো আমি, কাজেই আমি কিরনগোজিকে যে পথে যেতে বলল, কাফেলা সেই পথেই যাবে। কুলিদের পছন্দ করা পথে তো যাবে না। যেখানে থামতে বলব সেখানেই থামবে আর যখন চলতে বলব, তখন চলবে। আমি তো তাদের ঠিকমত খাওয়াচ্ছি, এমনকি বেশি কাজও করাচ্ছি না। দেখি তো কোন কুলি বা সৈন্য আমার অবাধ্য হয়! তুমি এক্ষুনি ঠিক করে গেলে যে সিমবোর পথে যাবে। আমরা সবাই তাতে রাজিও হলাম। আর এখন তোমার কুলিরা বলছে যে তারা কিওয়েহের পথেই যাবে, না হলে পালাবে। তাহলে তুমি যাও কিওয়েহের পথে আর কুড়ি ডটি নজরানা দাও। আমি আর আমার কাফেলা কাল সকালে কিটির পথ ধরব। যখন তোমাদের একদিন আগেই আমি ইউন্যানিয়েম্বে পৌঁছে যাব, তখন তোমরা আফসোস কোরো যে কেন ওই একই রাস্তা ধরোনি। ”
আমার এ হেন প্রতিজ্ঞায় আবার হামেদের মত বদলাল, সে তখনই বলে উঠল, “এটাই সব থেকে ভাল রাস্তা, আর সাহেব যখন এই পথেই যাবেন বলে ঠিক করেছেন, আর আমরা তো গোগোদের ওই বিচ্ছিরি এলাকার মধ্য দিয়ে এতদিন একসাথে পথ চলেছি, ইনশা-আল্লাহ একসঙ্গেই যাওয়া যাক!" হামেদ মনস্থির করল আর থানি নামের ভালমানুষ বুড়োরও কোন আপত্তি নেই তাতে। দুজনেই সানন্দে আমার তাঁবু থেকে বেরোল, সবাইকে খবরটা জানাতে।
৭ তারিখ রওনা হওয়ার সময়, রোজকার মতই, কাফেলাগুলোকে পথ দেখানোর দায়িত্বে রয়েছেন হামেদের কিরনগোজি। মোটামুটি ধরে নেওয়া যে সর্বসম্মতিক্রমে কিটির রাস্তায় যাওয়া হবে। মাইলটাক যেতেই মনে হল যে আমরা দ্য টোড ছেড়ে চলে এসেছি, কিটির দিকেই চলছিলাম, আর এখন চালাকি করে একটা ঘুরপথে দ্রুত সামনের একটা শৈলশিরার মধ্যের গিরিপথের দিকে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটা কিওয়েহের উচ্চতর মালভূমিতে প্রবেশের পথ। তক্ষুণি আমার কাফেলা থামিয়ে দিলাম, কিটির পথে আগে যে বুড়ো গেছে, তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম যে আমরা কিওয়েহে-মুখো চলেছি কিনা। সে বলল যে আমরা সেদিকেই যাচ্ছি। আমার সব কুলিদের একসঙ্গে ডেকে বোম্বেকে বললাম তাদের জানাতে যে সাহেব নিজের মত বদলায়নি; আমি যেমন কিটির পথে যাওয়ার কথা বলেছিলাম, আমার কাফেলা কিটির পথেই যাবে; আরবরা সঙ্গে আসুক আর নাই আসুক। আমি বুড়োকে নিজের বোঝা তুলে নিতে আর কিরনগোজিকে কিটির ঠিক রাস্তাটি দেখাতে নির্দেশ দিলাম। ন্যামওয়েজি কুলিরা তাদের বস্তা নামিয়ে দিল— প্রায় বিদ্রোহ শুরু হয় হয় আর কি ! এরপরে এনগোওয়ানা সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হল যে বন্দুকে গুলি ভরে রাখতে আর কাফেলার পাশে পাশে থাকতে, যে কুলিই পালাতে চেষ্টা করবে তাকেই যেন গুলি করা হয়। গাধার পিঠ থেকে নেমে চাবুক বাগিয়ে ধরলাম, আর প্রথম যে কুলিটা মাল নামিয়ে রেখেছিল, তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে ইশারা করলাম মাল তুলে নিতে আর হাঁটা শুরু করতে। আর এগোনর দরকার পড়ল না, কারণ একটিও ব্যতিক্রম ছাড়া, সবাই কিরনগোজির পিছনে অনুগতভাবে চলা শুরু করল। থানি ও হামেদের কাছে বিদায় নিতে গেলাম, তখন থানি বলল, 'একটু দাঁড়ান সাহেব; এই সব ছেলেখেলা ঢের হয়েছে; আমিও আপনার সঙ্গে আসছি," আর তার কাফেলাও আমার কাফেলার পিছন পিছন ঘুরে দাঁড়ালো। ইতিমধ্যে হামেদের কাফেলা প্রায় গিরিবর্ত্মের কাছে চলে গেছে আর সে নিজে তার পুরো এক মাইল পিছনে, তার ভাষ্যমতে আমরা তাকে ফেলে চলে যাওয়ায় সে তখন বাচ্চাদের মতন কাঁদছে ! তার অবস্থা দেখে করুণা হল— কিওয়েহের সুলতানের কথা, তার জুলুম আর অসভ্যতার কথা ভেবে ভেবে তার আর চিন্তার কূল নেই— আমি তাকে নিজের কাফেলার পিছনে দৌড়ানোর পরামর্শ দিলাম, আর বললাম যে ওদের গিয়ে বলো যে , বাকিরা সব অন্য রাস্তায় গেছে, কিওয়েহের সুলতানের কথা যেন তারা ভাবে। কিটিতে যাওয়ার গিরিপথে পৌঁছানোর আগেই বুঝলাম যে হামেদের কাফেলা আমাদের পিছু পিছু আসছে।
গিরিশিরা বেয়ে ওঠার পথটা খুব বন্ধুর ও খাড়া, ভীষণ খোঁচাওলা কাঁটাগাছেরা আমাদের ভয়ানক শাস্তি দিয়েছিল, এখানে বাবলা গাছের দাপট স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি, গঁদগাছের ডালগুলো ছড়ানো আর বোঝার সঙ্গে জড়িয়ে-টড়িয়ে একাকার, ছাতার মত মাথাওলা মিমোসা আমাদের সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করলেও দ্রুত পথ চলার পথে সে একটা বড় বাধা। পায়ে পায়ে মসৃণ খাড়া হয়ে থাকা সায়ানাইট এবং গ্রানাইটের টুকরো পেরিয়ে উপরে উঠতে হবে, মাটি-পাথরের অসমান চত্বর চড়তে হবে, আর দূরে, জঙ্গলের মধ্যে থেকে ভেসে আসা গুলির শব্দ দলকে আরও ঘাবড়ে দিচ্ছে আর দলের সাধারণ অসন্তুষ্টি আরও বাড়াচ্ছে। যদি আমি আমার কাফেলার ঠিক পিছনে না থাকতাম আর প্রতিটা চালচলনের দিকে কড়া নজর না রাখতাম, আমার দলের প্রত্যেকটা ন্যাময়েজিই পালাত।
একটু আগে ফেলে আসা জলতলের থেকে যদিও মাত্র ৮০০ ফুট উঠেছি, উঠতে সময় লাগল দুই ঘন্টা। মালভূমি পেরিয়ে, মারাত্মক ঝামেলাগুলো সব কাটিয়ে আসার পরে, সামনে একটা তুলনামূলকভাবে ভাল রাস্তা পাওয়া গেল, বন, জঙ্গল আর খোলা মাঠের মধ্যে দিয়ে ছুটেছে সেই পথ। এই রাস্তা আরও তিন ঘণ্টায় আমাদের নিয়ে এল ছোট্ট একটা গ্রামে, নাম তার মুনিয়েকা। সে গ্রামের চারপাশে চাষের ক্ষেত, প্রভূত ফসল ফলেছে তাতে। মুকোনডকুর সুলতানের প্রজারা চাষ করে সেখানে।
আর সকলেই শিবিরে পৌঁছানোর পরে পথের ঝঞ্ঝাট ভুলে আবার আগের মত হাসিখুসি হয়ে গেল। শুধু হামেদ বাদে।
ক্রমশ...