ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালা। তরজমা স্বাতী রায়
১ মে, কিঙ্গারু হেরা। জানজিবারে একটা প্রচণ্ড ঝড়ের খবর শুনেছি। শুনছি যে প্রতিটি বাড়ি ও জাহাজকে নাকি ধ্বংস করেছে। এমনই রটেছে। আর ওই একই বিধ্বংসী ঝড় বাগামোয়ো ও হুইন্ডের উপর দিয়েও বয়ে গেছে। এমনটাই লোকেরা বলছে। তবে এতদিনে আমি মোটামুটি জানি যে আফ্রিকানরা কেমন বাড়িয়ে কথা বলে। তবে দেশের ভিতর দিকে ঝড়ের যা প্রভাব দেখে এসেছি, তার থেকে মনে হয় এটা গুরুতর ক্ষতি করতেই পারে। শুনলাম যে বাগামোয়োতে নাকি শ্বেতাঙ্গরা এসেছে, আমার খোঁজখবর করতে এই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের তোড়জোড় চলছে। কে যে আমার খোঁজ নেবে, আমি তো বুঝতে পারছি না। মনে হয় আমার অভিযান সম্পর্কে নিশ্চয়ই তাদের কিছু ভুল ধারণা হয়েছে; যদিও, তারা কীভাবে জানল যে আমি কোনও মানুষকে খুঁজছি আমি তাই বুঝতে পারছি না, কারণ উন্যায়ানয়েম্বে পৌঁছনো পর্যন্ত আমি কাউকেই তো সেকথা বলিনি।
২ মে। রোসাকো। আমি তখন সবে গ্রামে পা রেখেছি। এমন সময় উগোগোর এমভুমি থেকে যে তিনজন লোককে পাঠিয়েছিলাম, তারা এসে পৌঁছাল। সঙ্গে কয়েক বোতল শ্যাম্পেন, কয়েক পাত্র জ্যাম এবং বোস্টন ক্র্যাকারের দুটি বাক্স। উদার আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের পাঠানো। মাকাটা উপত্যকার ভয়ানক অভিজ্ঞতার পরে এগুলো খুবই স্বাগত। এই বাক্সগুলির মধ্যে একটির ভিতরে, কনসাল সযত্নে হেরাল্ডের চারটি সংখ্যাও পাঠিয়েছিলেন; তার মধ্যে একটিতে ইউন্যায়ানয়েম্বে থেকে পাঠানো আমার চিঠিপত্র রয়েছে। সেখানে কিছু অদ্ভুত টাইপ-জনিত ভুল ছিল, বিশেষ করে পরিসংখ্যান ও আফ্রিকান নামগুলিতে। মনে হয় দুর্বলতার কারণে আমার লেখা খারাপ হয়েছিল। অন্যটিতে বিভিন্ন সংবাদপত্রের বেশ কিছু নির্যাস রয়েছে, যার থেকে আমি জানতে পারি যে অনেক সম্পাদক আমার আফ্রিকায় অভিযানকে একটি গল্পকথা বলে মনে করেন। হায় রে! আমার জন্য যে এটা কত ভয়ানক একটা সত্য ব্যাপার ! বিবেকের নির্দেশে করা কঠিন কাজ, নিঃসঙ্গতা, অসুস্থতা ও প্রায় মৃত্যুর অভিজ্ঞতা এর সঙ্গে জড়িয়ে! এই কাজে আঠেরো জন তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। এটা অবশ্যই গল্পকথা নয়—আমার দুই শ্বেতাঙ্গ সহকারীর এই কাজে মৃত্যুবরণ করেছে; বেচারিরা দেশের গভীর ভিতরে নির্বান্ধব পুরীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে!
এই সমালোচনামূলক নিবন্ধগুলোর মধ্যে একটা, টেনেসির এক সম্পাদকের কলম-প্রসূত, অভিযান নিয়ে প্রচুর হাসি-ঠাট্টার পরে, এইভাবে শেষ হয়েছে:
"সেই অভিযানে যে কি হবে তা আগেই জানা । লিভিংস্টোন সভ্য সমাজে পুনরাবির্ভূত না হওয়া পর্যন্ত কখনই সেই 'হেরাল্ড' কমিশনারের থেকে আর কিছু শোনার আশা করা উচিত নয়। সে আরেকটা কোনও বড় মাকাটার জলাভূমিতে ঢুকবে ও তার বেচারা কুকুর 'ওমরের' মত পরিণতি লাভ করবে। সর্বদাই এমনটা ঘটে।"
সুতরাং, যখন আমি আফ্রিকায় মাইলের পর মাইল হাঁটছি, এমন একটি কাজের দায়িত্ব নিয়ে যেটা আমি সরলমনে ভেবেছিলাম যে বহু খ্রিস্টানই তার কদর করবে, তখনই এক দল লোক মনে প্রাণে আমার ব্যর্থতা চাইছে। খুবই অবাক লাগে যে সভ্যতা আর বর্বরতার মধ্যে কতই না সামান্য পার্থক্য! একটা সরু রেখা কিছু শ্বেতাঙ্গকে নিগ্রো অসভ্যদের থেকে আলাদা করে। পরে যদিও আমি ভাল আচরণের প্রেক্ষিতে সদয় বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষের দেখা পেয়েছি - তবু উপরের নির্যাসটিতে যে অনুভূতি ধরা পড়েছে তার মারফৎ আমি বুঝেছিলাম যে দেশে ফিরে আমি ঠিক কী আশা করতে পারি। অবশ্য সবসময়েই, শেষ হাসি আমিই হাসছি। আর বেঁচে দেশে ফিরতে পারলে, আরও হাসির খোরাক পাব।
আমার বার্তাবাহকরা জাঞ্জিবার থেকে আমার যে সব চিঠি এনেছে তার মধ্যে একটিতে বলা হয়েছে যে "লিভিংস্টোন অনুসন্ধান ও ত্রাণ অভিযান" নামের একটি অভিযান বাগামোয়োতে এসেছে। এর নেতারা এখন কী করবেন? লিভিংস্টোনকে খুঁজে পাওয়া গেছে ও ইতিমধ্যেই তার কষ্ট নিবারণ করা হয়েছে। লিভিংস্টোন জানিয়েছেন তার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। খুবই দুঃখের ব্যাপার যে তারা আরও আগে যাত্রা করেনি; তাহলেই তারা যথাযথভাবে এগিয়ে যেতে পারত ও ভালভাবে অভ্যর্থিত হত।
৪ মে। কিংওয়ের ফেরিতে পৌঁছেছি, কিন্তু কোন ক্যানোর মাল্লার চোখ পড়েনি আমাদের দিকে। আমাদের শিবির এবং বাগামোয়োর মধ্যে একটা কম করেও চার মাইল চওড়া প্লাবিত সমভূমি রয়েছে। এই বিস্তৃত তরল বর্জ্য পেরিয়ে ওপারে যেতে আমাদের অভিযানের যথেষ্ট সময় লাগবে।
৫ মে। জলের ওপারের গঙ্গোনি গ্রাম থেকে ক্যানোর মালিক কিংওয়েরে প্রায় ১১ টার সময় এল। তার গতিবিধি দেখে আমি সানন্দে বিশ্বাস করলাম যে সে কোন এক বিষণ্ণ কাঠপুতলিরাজার বংশধর, কারণ আমি এই গোটা দেশে সেরকম কিংওয়েরের মতো অলস, অকর্মণ্য আর একটাও দেখিনি। সে এল সঙ্গে দুটো ছোট, টলমলে ক্যানো নিয়ে। তাতে আমাদের মাত্র বারোজন এক সঙ্গে চড়তে পারবে। গঙ্গোনি গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর তিনটে বাজল।
৬ মে। কিংওয়েরকে তার দিক থেকে দ্রুত ব্যবস্থা করার জরুরি প্রয়োজন বোঝানো হল। সেই সঙ্গে তাকে অতিরিক্ত পাঁচ ডলার মূল্যের সোনার টুকরো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সন্তুষ্ট করা হল। তার ফলে আমার দলের শেষ লোকটিকে বিকেল ৩.৩০ মিনিটে আমার শিবিরে পৌঁছাতে দেখে সন্তুষ্ট হলাম।
এক ঘণ্টা পরে, ফের আমরা নিজেদের পথে চলছি, আর এমনই গতিতে চলছি যে গতিতে আমি আগে কখনই আমার কাফেলাকে চলতে দেখিনি। প্রতিটি মানুষের অনুভূতি তীব্র, তাদের চলাফেরায় একটা তরতাজা ভাব ফুটে উঠেছে, নাকি একটা হঠকারী অধৈর্য্যভাবই বলব? তাই দেখেই ভাল মতন বোঝা যাচ্ছে যে তাদের মনের ভিতরে কী চলছে! নিঃসন্দেহে, আমি নিজেকে দিয়েই তাদের মনের অবস্থা খুব ভাল করে বুঝতে পারছি; আর আমাকে যে এক মহান আনন্দ জড়িয়ে ধরেছে তা স্বীকার করতে আমার এতটুকু লজ্জা নেই। নিজের সাফল্যের কথা ভেবে গর্বিত বোধ করছি। তবে, সত্যি বলতে কি, সেই আনন্দেও আমি ততটা উচ্ছ্বসিত নই যতটা এই আশায় যে আগামীকাল আমি জীবনের ভাল ভাল সুখাদ্য ভরা টেবিলের সামনে আবার বসতে পাব। হ্যাম, আলু ও ভাল রুটি - কিভাবে যে তার গুণ গাই! মনের কি শোচনীয় অবস্থা, তাই না? আহ, বন্ধু আমার, যতক্ষণ না তুমি খেতে না পেয়ে বা মোটা দাগের, জঘন্য খাবার খেয়ে কঙ্কালে পরিণত না হচ্ছ - যতক্ষণ না তুমি মাকাটা জলাভূমি পাড়ি দিচ্ছ,বা পঁয়ত্রিশ দিনে আমরা যেমন বিচ্ছিরি আবহাওয়া পেয়েছিলাম তেমন আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে ৫২৫ মাইল পথ হাঁটছ, ততদিন অপেক্ষা কর - তারপরে তুমিও ভাববে যে এমন রোজের খাবারও দেবভোগ্য!
এতেই আমরা খুশি যে, আমাদের যাত্রা সার্থক করে, রোজের হাঁটার জ্বালাযন্ত্রণা সহ্য করে, বিবাদমান উপজাতিদের কারণে প্রভূত উদ্বেগ ও ক্ষোভের মুখোমুখি হয়েও, গত পনেরো দিন ধরে কাদামাটি ও ঘন, বিচ্ছিরি কালো জলাজমির মধ্য দিয়ে হেঁটে এসে, অবশেষে আমরা চরম শান্তি ও বিশ্রামের কাছাকাছি, যেমন শান্তি ইহুদীরা ইজরায়েলের পূণ্যভুমিতে (Beulah's land) পৌঁছে পায়!
বন্দুক খালি না হওয়া অবধি গুলি ছুঁড়ে ছাড়া আর কি ভাবেই বা আনন্দ প্রকাশ করতে পারি—তারপর গলা ভেঙ্গে কর্কশ না হওয়া অবধি "হুররা" বলে চিৎকার করা – আর তারও পরে আছে সমুদ্র-ফেরত প্রতিটি তাজা মায়ের সন্তানকে মন নিংড়ে "ইয়াম্বোস" বলে শুভেচ্ছা জানানো! শুধু তাই না, ওয়াংওয়ানা সৈন্যদের কথা ভাবুন; আমি তাদের প্রতি এতটাই সহানুভূতিশীল যে কোন বাধা না দিয়ে তাদের যাবতীয় পাগলামো করার অনুমতি দিলাম।