আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। যেমন বহু খুঁজেও পাওয়া গেল না কিঙ্গারু গ্রাম। বাগামোয়ো থেকে ‘উসেগুহহা’-র রাজধানী সিম্বামওয়েন্নিতে পৌঁছোনোর লক্ষ্যে চলেছে স্ট্যানলের কাফেলা। উসেগুহহা বলে কোনো স্থান বা প্রদেশ আজ আর নেই। এমনকি বোঝাও মুশকিল সেই অঞ্চলের বিস্তৃতি ঠিক কী ছিল। তবে সিম্বামওয়েন্নি নামে একটি ক্যাম্প-সাইট এখনও রয়েছে তানজানিয়ার মোরোগোরো শহরের কাছে। আন্দাজ করা যেতে পারে এই সিম্বামওয়েন্নি-র কথাই স্ট্যানলে বলছেন। কাজেই এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই মানচিত্রে নীল বুটি দেওয়া পথের আশেপাশেই।—সম্পাদক
আগের প্রস্থের হন্টনের ভয়ানক ক্লান্তি কাটিয়ে, দশ তারিখে আমাদের কাফেলা মসোয়া থেকে যাত্রা শুরু করল। অতিথিপরায়ণ গ্রামবাসীরা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সীমানার বেড়া অবধি এল আর সমস্বরে ‘কুওহরিস’ বলে বিদায় জানাল। ইম্বিকি আর মসোয়ার মধ্যের হাঁটাপথের তুলনায় এখানকার গ্রামের বাইরের রাস্তা অনেক কম কষ্টকর। একটা ছোটো সুন্দর সমতল পেরোলাম। তার মাঝখান দিয়ে একটা শুকনো নালা বা মটোনি বয়ে গেছে। এরপর পথ চলেছে কয়েকটা চাষের খেতের পাশ দিয়ে, সেখানে চাষারা যেন খানিকটা মুগ্ধ হয়েই হাঁ করে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে।
খুব শীঘ্রই আমরা একটা দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম। বিশ্বের এই প্রান্তের খুবই পরিচিত দৃশ্য সেটা। পূর্ব দিকে চলতে থাকা একটি শিকলে বাঁধা দাসের দল। দাসেরা মোটেই হতাশ নয়; বরং তারা মার্টিন চ্যাজলউইটে১র আমুদে চাকরের মতো দার্শনিক আনন্দে মগ্ন। শিকল না থাকলে কে যে প্রভু কে যে দাস বোঝা মুশকিল। দেখতে তো প্রভু-ভৃত্য দুজনকেই একই রকম। আমাদের যে তারা হালকা দয়ার চোখে দেখছিল সেটা তাদের সকলের মুখে ফুটে উঠেছিল। শিকলগুলো ভয়ানক ভারী—হাতিদেরও আটকে রাখতে পারে; তবে দাসেরা যেহেতু নিজেদের ছাড়া আর কিছুই বহন করছিল না, শিকলের ওজন খুব অসহ্য হওয়ার কথা না।২
এ রকম একটি দৃশ্যকে খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছে হেনরি স্ট্যানলে-র
এই পথে জঙ্গল খুব কম। যদিও কোনো কোনো জায়গায় আমদের মালবাহী বাহিনী দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিল, তবে পথচলা বন্ধ করে দেওয়ার মতো গুরুতর কিছু ঘটেনি। সকাল দশটার মধ্যে আমরা আবার তাঁবু ফেললাম। নির্মেঘ আকাশের চাঁদোয়ার তলায় জঙ্গল আর সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠের মনোরম দৃশ্যের মাঝখানটিতে। আবার নির্জনে শিবির তৈরি করলাম, আর নিয়ম অনুসারে, দুটো গুলি ছুড়ে দেওয়া হল—মানে খবর পাঠানো হল যে কোনো ওয়াশেনসির ঘরে বিক্রি করার মতো শস্য থাকলে আমরা তা কিনতে ইচ্ছুক।
আমাদের পরের থামার জায়গা কিসেমো। মসোয়ার থেকে এগারো মাইল দূরে। গ্রামটা একটা ঘন জনবসতির এলাকায়, আশেপাশে কম করে আরও পাঁচটা গ্রাম তো ছিলই। সবকটা গ্রামই কাঠের খুঁটি আর কাঁটাগাছের বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত, এমন জোর গলায় নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করছে যেন তাদের পুঁচকে প্রধানরা সব এক-একজন পারসি বা ডগলাস৩-এর মতো আর্ল। ‘আপন গাঁয়ে কুকুর রাজা’ ধরনের হাবভাব তাদের! এই গ্রামগুলো এক-একটা শৈলশিরার বা নীচু টিলার মাথায় অবস্থিত। অল্প উঁচু টিলা আর ছোটো কুঁজের মতো ঢিবির মাঝে লুকিয়ে আছে সরু উপত্যকা। মাতামা আর ভারতীয় ভুট্টা চাষের জন্য ভারী উপযোগী। গ্রামের পেছনে বইছে উঙ্গেরেঙ্গেরি নদী, একটা ভারী স্বচ্ছ আর মিষ্টি জলের ছোটো নদী। মাসিকার সময়ে সে খলবলিয়ে ছুটে চলে, খাড়া পারও উপচে উঠে ভাসিয়ে দেয়, তবে শুকনো মরসুমে আবার নিজের আসল চেহারায় ফিরে আসে। কিসেমো থেকে এটি প্রথমে দক্ষিণ পশ্চিমে, তারপরে পুর্বে গেছে; এটা কিংগানি নদীর মূল শাখা।
কিসেমোর গুরু-নিতম্বিনী মেয়েরা তাদের পিতলের তারের দেমাকের জন্য বিখ্যাত, তাদের মণিবন্ধ আর গুলফ ঘিরে গোল গোল করে তার প্যাঁচানো, মাথায় শক্ত শক্ত কাঁটাওলা বিবিধ ছাঁদের সজ্জা; তবে তাদের বেচারা স্বামীদের মলিন, ছিন্ন বসন আর কানের ছেঁড়া লতি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়! এর থেকেই বোঝা যায় যে এই পার্থিব জগতের উপর আসমোডিয়াসের৪ কী ব্যাপক প্রভাব! কোণঠাসা স্বামীরা যখন অবশেষে বউদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় তখন নিশ্চয় সে ভারী সুখের সময় নয়! হাতে-পায়ের পিতলের গয়না আর হরেক কেশসজ্জা ছাড়াও কিসেমোর মেয়েরা প্রায়শই লম্বা লম্বা নেকলেস পরে, তাদের কালো শরীর বেয়ে যেন রং-এর ঝর্ণা নামে।
তবে আরও একটা মজার ছবি কদাচিত দেখা যায়—এই রকম অতিসজ্জিতা মহিলারা যখন নিজের ও পরিবারের জন্য গম ভাঙার মতো একটা ঘরোয়া এবং প্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্ত হয়, তখন। গম-পেষাই ঢেঁকিটার দুটো অংশ: একটা প্রায় ছ-ফুট লম্বা শক্ত কাঠের চওড়া ডাণ্ডা, সেটা ঘট্টনীর কাজ করে; অন্যটা একটি প্রশস্ত কাঠের হামান, তিন ফুট উঁচু। ডাণ্ডাটা ওঠানামার তালে তালে তাদের সুবিশাল বুক আর নিতম্ব দুলতে দুলতে থাকে আর পর্যায়ক্রমে এক ভারী কৌতুককর ছন্দে হামানদিস্তায় ঘা দিতে থাকে। আমি প্রথম যখন দেখি, তখনও বুঝিনি যে গম পেষা হচ্ছে, অত জোরে শরীর দোলানো দেখে ভয় পেয়েছিলাম যে ঝুপড়ির দেয়ালই না সে ধাক্কায় ভেঙে পড়ে।
তাঁবু খাটানোর সময়, একটা খোঁটা মাটিতে ঢোকানোর জন্য শ-কে একটা ছোটো চ্যাপটা পাথর সরাতে হয়েছিল। সেই দেখে গ্রামের প্রধান হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এসে তক্ষুনি পাথরটি আবার আগের জায়গায় বসিয়ে দিল আর ভারী দৃপ্তভাবে তার উপর উঠে দাঁড়াল। বোঝা গেল যে পাথরটা ও তার অবস্থান দুইই খুব গুরুত্বপুর্ণ। শ-তো এই কাণ্ড দেখে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়ল! বোম্বে এগিয়ে এসে প্রধানকে ব্যাপারটা কী তা জিজ্ঞেস করল। শেখ গম্ভীরভাবে নীচের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করল আর জবাব দিল, ‘উগাঙ্গা!’ তখন আমি তাকে অনুনয় করে পাথরের নীচে কী আছে তা দেখতে চাইলাম। সে দয়া করে রাজি হল। আমার কৌতূহল চরিতার্থ হল, দেখলাম একটা ছোটো আঁকাবাঁকা লাঠি, সেটা একটা পোকাকে মাটিতে গিঁথে রেখেছে। সেটা গ্রামের এক যুবতীর গর্ভপাতের কারণ!
সেই যে উলেদি আর ফেরাজ্জি দল-পালানো খামিসির পিছনে ধাওয়া করেছিল, সেদিন বিকেলে তারা সব চোরাই মালসহ খামিসিকে নিয়ে ফিরে এল। খামিসি চোরাই মাল পেয়ে ভারী খুশি হয়েছিল, কিন্তু রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢোকার পরপরই সে একদল ওয়াসেনসি ডাকাতের মুখোমুখি হয়। এরা সবসময়েই দলছাড়া পথিকের সন্ধানে তক্কে তক্কে থাকে। কোনো কথাবার্তা না বাড়িয়ে তারা খামিশিকে জঙ্গলের মধ্যের গ্রামে ধরে নিয়ে যায় আর মেরে ফেলার আগে তাকে একটা খুঁটিতে বেঁধে রাখে। খামিসি তাদের জিজ্ঞাসা করেছিল যে তারা তাকে বেঁধে রেখেছে কেন। তারা জবাব দিয়েছিল যে সে মগওয়ানা, ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মেরে ফেলাই নিয়ম, তাই তাকেও খুন করা হবে। তবে উলেদিও ফেরাজ্জি অল্প পরেই সেখানে হাজির হয় আর দুজনেই পুরো সশস্ত্র ছিল। তারা এসেই খামিসি এবং তার সঙ্গের সকল মালপত্রের উপর দাবি জানায়, বলে যে খামিসি মুসুঙ্গুর দলের থেকে পালানো কুলি, ফলে তার ভাগ্য নিয়ে বিতর্কের শেষ হয়। ডাকাতরা কুলি বা তার সঙ্গে পাওয়া ছাগল, তাঁবু বা অন্যান্য মূল্যবান জিনিসের উপর দাবি নিয়ে কোনো কথা তোলেনি, তবে তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য পুরস্কার চেয়েছিল। নিতান্তই নায্য দাবি, তাই সেটা মেনে নিয়ে তাদের দুই ডটি কাপড় আর দশটি পুঁতির মালা পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
দল ছেড়ে পালানো এবং ডাকাতির চেষ্টার জন্য, আগে শাস্তি না দিয়ে খামিসিকে তো আর ক্ষমা করা যায় না। বাগামোয়োতে আমার কাজে যোগ দেওয়ার আগে সে পাঁচ ডলার অগ্রিম চেয়েছিল, সেটা সে পেয়েওছিল। তাকে দেওয়া হয়েছিল একটা বুবু পুঁতির বোঝা, একজন কুলির বোঝার চেয়ে সেটা মোটেও অধিক ভারী না, অতএব, পালানোর কোনো অজুহাতই তার ছিল না। পাছে তাকে শাস্তি দিতে গিয়ে আমি বিচক্ষণতার সীমা লঙ্ঘন করি, তাই আমি আটজন কুলি আর চারজন সৈন্যকে ডেকে বললাম তার বিচার করতে—তাকে নিয়ে কী করা উচিত সে বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত যেন তারা আমাকে জানায়। সর্বসম্মতিক্রমে তারা রায় দিল যে খামিসি যে অপরাধ করেছে, ওয়ান্যাময়েজি কুলিদের মধ্যে তা প্রায় অজানা। যেহেতু এর ফলে ওয়ান্যাময়েজি কুলিদের বদনাম হতে পারে, তাই তাকে মহান প্রভুর ‘গাধার চাবুক’ দিয়ে চাবকানো হোক। সেইমতোই শাস্তি দেওয়া হল। তারপর আমি তাকে বাঁধতে হুকুম দিলাম। তার কাজে কুলিদের বদনাম হয়েছে, আমার মনে রক্ষীদের দক্ষতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে, শ দলছাড়াদের ঠিকমতো দেখাশোনা না করার জন্য আমার কাছে ধমক খেয়েছে। এইসবের শাস্তি হিসেবে প্রতিটি কুলি, সিপাই আর শ-কে বললাম, তাকে এক ঘা করে দিতে। সেই মতো শাস্তি পেল সে। বেচারা খামিসি!
(ক্রমশ...)
সট্যানলি এরপরে যা করবেন তার ছবি আপনি এই (২) তে তুলে ধরেছেন। কংগো নদীর বাঁয়ে অসংখ্য মানুষকে বোকা বানিয়ে কাগজে সই করিয়ে জমি দখল করেছেন রাজা লিওপোলডের নামে। এক কোটি মানুষের রকত তাঁর হাতে। আরেকটা কথা মনে রাখা ভাল -কংগো নদীর এই অনচল আরবদের চেনা ছিল বহু আগে। সট্যানলি এটি ইউরোপ তথা এক দানবকে চেনালেন । রাজা লিওপোলড একে শুষে খাবেন। সট্যানলি সে যজ্ঞের পুরোহিত।