রাতের আগেই ওয়াংওয়ানা১র একটি ছোটো কাফেলা এসে পৌঁছাল। তাদের সঙ্গে জাঞ্জিবারের দয়ালু আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের লেখা একটা দীর্ঘ চিঠি আর এক তাড়া পুরোনো হেরাল্ড সংবাদপত্র এসে পৌঁছাল। কাগজের তাড়ায় ফেব্রুয়ারির চার তারিখ অবধি কাগজ ছিল। কংগ্রেস ও নিউইয়র্কের আইনসভার কাজকর্ম বা আমেরিকার চমকপ্রদ অপরাধের উদ্ঘাটন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের নানান মুখরোচক খবর পেলাম। তার মধ্যে প্রেসিডেন্ট গ্রান্টের দ্বিতীয় ‘লেভি’ বা আপ্যায়ন অনুষ্ঠানেরও বিবরণও ছিল। এই উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া মহিলাদের সাজগোজের এক দুরূহ বাগাড়ম্বরপূর্ণ বর্ণনা জেনকিন্স দিয়েছিলেন—মিসেস অমুকের মনমাতানো ধূসর কোঁকড়া চুলে কেমন ভাবে ল্যাভেন্ডার রং-এর উটপাখির পালক দোল দিচ্ছিল; দৃপ্ত-ব্যক্তিত্বের মিসেস তমুকের অপূর্ব সজ্জা কেমন হিরের দ্যুতিতে আরও দীপ্তিমান হয়ে উঠেছিল; অন্য কোনো এক মিসেস কী সুন্দর একটা টুকটুকে লাল রঙের সাটিনের ঝালর দেওয়া ওভারস্কার্ট পরেছিলেন; রাজকীয় বেগুনি রঙের সাটিনের পোশাক পরিহিতা মিসেস ক হেঁটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হিরের গহনার থেকে কেমন আলো ঝলকাচ্ছিল; গভীর পুরুষালি গলা ও একজোড়া ধূসর সন্ধানী দৃষ্টির অধিকারী আমাদের প্রেসিডেন্ট তাঁর দ্বিতীয় দরবারের উপলক্ষ্যে জড়ো হওয়া মান্যগণ্য মানুষদের সেবায় কেমন আত্মোৎসর্গ করেছিলেন—এইরকম চড়াদাগের তোষামুদে খবরাখবর।
হোয়াইট হাউসে ‘প্রেসিডেন্ট’স্ লেভি’। ছবি সৌজন্য: লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস
এইসব মজাদার খবরের থেকে চোখ তুলে দেখি যে আমার তাঁবুর দরজায় একদল কৃষ্ণকায় কিসেমো-কন্যা ভিড় জমিয়েছে। এতক্ষণ ধরে লম্বা কাগজের পাতায় মুখ গুঁজে আমি কী করছি সেই রহস্য উদ্ঘাটনের বৃথা চেষ্টায় মগ্ন তারা। বন্ধুবর জেনকিন্স যা বর্ণনা করেছিলেন আর আমার চোখের সামনে যে ঘোর বাস্তব দৃশ্য— দুয়ের মধ্যে এতই প্রবল তফাত যে ওই সুসজ্জিতা মহিলারা যে আসলে কেমন দেখতে সেটা মনে করতেই রীতিমতো স্মৃতিশক্তির জোর লাগল। একদিকে একরাশ ঝকঝকে সোনালি চুলওয়ালা সুন্দরী, যার চোখের ঔজ্জ্বল্য হিরের দ্যুতির সঙ্গে পাল্লা দেয়। আর অন্যদিকে আমার দরবারে উপস্থিত হওয়া মেয়েদের একজন— স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য আর নগ্নতার সৌন্দর্যে ভাস্বর—বারো-তেরো বছরের নারীত্বের দরজায় পা দেওয়া পুষ্টদেহ কৃষ্ণকলি; মাথা-বোঝাই মোরগঝুঁটির মতো পশমি চুল, দু-বছরের পুরোনো কাপড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে প্রয়োজনাতিরিক্ত, উপচে-পড়া দেহসুষমা, প্রতি হাতে-পায়ে তিন পাউন্ড পিতলের তারের গয়না, গলা ঘিরে লহরে লহরে পুঁতির মালা। দু-দল মেয়ের মধ্যে তফাত ঠিক কোন্খানে? তবে বাস্তবিকই জেনকিন্সের মতো পটু লোক যেখানে খবর দেওয়ার জন্য থাকেন, সেই প্রেসিডেন্টের দরবারের সঙ্গে কি আর আমার দরবারের তুলনা হয়!
১২ তারিখে কাফেলা মুসৌদি পৌঁছেছিল, উঙ্গেরেঙ্গেরি নদীর তীরে। আমাদের অসীম ধৈর্যবান গাধাগুলোর কপাল ভালো, এই পদযাত্রাতে জঙ্গলের বিরক্তিকর ঝামেলাগুলো আর ঘটেনি। আমাদের জন্যও সুখের বিষয়, সবসময় আর পোঁটলা-পুঁটলির দিকে নজর রাখতে হচ্ছিল না। তা ছাড়া রাতের আগে শিবিরে পৌঁছাতে পারব কিনা সে দুশ্চিন্তার হাত থেকেও রেহাই পেলাম। আমাদের সুস্থ গাধাদের পিঠে একবার বোঁচকাগুলো চাপিয়ে দেওয়া হল, তারপরে তারা শিবিরের দিকে হাঁটা দিল—রাস্তাটা খুবই ভালো—আর একবারও কোনো কিছু পিঠের থেকে পড়ল না, অধৈর্য হয়ে চেঁচানোর দরকার হল না—রাতের আগেই তারা শিবিরে পৌঁছে গেল।
উন্যানয়েম্বে যাওয়ার রাস্তা যদি গোটাটাই এরকম হত, তাহলে তো এই যাত্রাকে রবিবারের ছুটিতে স্টাটেন দ্বীপে ঘুরতে যাওয়া বা ঘোড়ার গাড়ি চেপে সেন্ট্রাল পার্কে বেড়াতে যাওয়ার মতো আরামের ব্যাপার বলেই ভাবা যেত। নুড়ি-বিছানো পথ, পুকুর ও হ্রদ, জাদুঘর, জাফরিকাটা কুঞ্জবন, কিওস্ক, ইউনিফর্ম-পরা পুলিশ ও সুসজ্জিত দর্শনার্থীদের বাদ দিয়ে সেন্ট্রাল পার্ক কল্পনা করতে পারেন? সংক্ষেপে বললে, পূর্ণবিকশিত সভ্যতার ছাপটুকু সেন্ট্রাল পার্কের গা থেকে মুছে ফেলে দিয়ে, কেবল মন-খুশি-করা লন আর উঁচু-নীচু জমি—কোথাও হালকা ঢালু, কোথাও আবার উপরদিকে উঠতে উঠতে হারিয়ে গেছে উপবনে—নিউইয়র্ক পার্কের এমন একটা ছবি যদি ভাবতে পারেন, তবে সে ছবির সঙ্গে কিসেমো ছাড়ার পরে আমাদের চোখের সামনে এদেশের যে ছবি ফুটে উঠল, তার ভারী মিল। চমৎকার বন্য প্রকৃতি, অসংখ্য ফুল এবং বিভিন্ন সুবাসিত গুল্মের গন্ধে ভরা, যার মধ্যে আমি বুনো ভুঁই-তুলসি (sage), নীল (indigo) গাছ ইত্যাদি চিনতে পারলাম। মাইল বিশেক দূরে, উদো এবং উকামির সীমানা বরাবর অবস্থিত কিরা ও তার সঙ্গী গিরিদলের পায়ের কাছটিতে গিয়ে এই অপরূপ দৃশ্যটি শেষ হয়েছে। দূরের পাহাড়ের সারির পটভূমিকায় উন্মুক্ত সমতল প্রান্তর, টুকরো টুকরো জঙ্গল এবং ঢালু তৃণভূমির অপরূপ দৃশ্য এক অসামান্য ছবি তৈরি করেছে। নীল পাহাড়ের সৌন্দর্য আর মাহাত্ম্য ছবিটিকে যেন সম্পূর্ণ করে তুলেছে।
উঙ্গেরেঙ্গেরি নদীর উপত্যকার যত কাছে যাচ্ছি, ততই দেখি লালমাটির উপরে গ্র্যানাইটের গোল মাথা আর ঝলমলে কোয়ার্টজের টুকরো বেরিয়ে আছে। পাহাড়ের ঢাল পাথরে ভরা। ঢাল বেয়ে নেমে এসে দেখি আমাদের চারপাশে উঙ্গেরেঙ্গেরি নদীর কালো পলির প্রলেপ, মাঠ-ভরা আখ, মাতামা, ভারতীয় ভুট্টা, সিমলা আলু, বাগান উপচে পড়ছে সবজি, বেগুন ও শসা গাছে। উঙ্গেরেঙ্গেরির তীরে খুব ভালো কলা হয়, আর কলাঝোপের মাথার উপর দিয়ে সত্তর ফুট বা আরও বেশি উপরে মাথা তুলে আছে রাজকীয় এমপারামুসি২। পারস্যের চিনার গাছের সৌন্দর্যের সঙ্গে পাল্লা দেয় সে। এই এলাকার সৌন্দর্য আবিসিনিয়ার সমতলের তুল্য। প্রথম শ্রেণির রণতরির প্রধান মাস্তুল যেমন সটান, সুন্দর হয়, তেমনই সোজা, চোখ-জুড়ানো এই গাছের দেহ, ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া পাতার টোপরটি ঘনত্বে আর উজ্জ্বল সবুজ রঙের দৌলতে আর দশটা গাছের থেকে আলাদা। আরও অনেক রকমের বড়ো গাছও ছিল। তাদের সুদূর প্রসারিত শাখা সরু, খরস্রোতা নদীটিকে জড়িয়ে ধরেছিল। উপত্যকার নীচু জায়গাতে ও নদীর পাশের অঞ্চলগুলি বিশালাকার ঘাসের কচি বন আর নলখাগড়ার ঝোপে ভরা।
অন্য গ্রামগুলোর তুলনায় মুসৌদি খানিকটা উঁচুতে অবস্থিত। ফলে আশেপাশের শতখানেক বা তারও বেশি গ্রামকে মুসৌদির লোকেরা বেশ অবজ্ঞার চোখেই দেখে। উকুয়েরের একদম পশ্চিমে এই গ্রামটা। উঙ্গেরেঙ্গেরির পশ্চিম তীরে ওয়াকামির রাজত্ব শুরু। মুসৌদিতে একদিন থামতে হল কারণ এখানকার লোকেরা এতই গরিব যে আমাদের দরকার মতো খাদ্য জোগাড় করে উঠতে পারিনি। আমাদের ঠিক আগেই অনেকগুলো কাফেলা এসেছিল—আগামী দিনগুলির রসদ তারা এখান থেকেই সংগ্রহ করেছে। এত উর্বর, জনাকীর্ণ উপত্যকাতেও ফলে খাদ্যশস্যের এমন আকাল দেখা দিয়েছে।
১৪ তারিখে আমরা উঙ্গেরেঙ্গেরি নদী পেরোলাম। এখানে নদীটা উপত্যকার দক্ষিণ প্রান্ত অবধি দক্ষিণবাহিনী, তারপর বাঁক ঘুরে পুবমুখো হয়ে চলেছে কিসেমো পর্যন্ত। হাঁটুজল, মাত্র বিশ গজ চওড়া। নদী পেরানোর পরে, আবার মাইলখানেক উপত্যকা—ভয়ানক আর্দ্র মাটি আর সার দিয়ে ঘাসের জঙ্গল। এরপর এমপারামুসি, তেঁতুল, চিরহরিৎ ঝাউ, বাবলা ও ফুটন্ত মিমোসার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথটি উপর দিকে উঠতে শুরু করল। দু-ঘণ্টা উপরে ওঠার পরে, সর্বোচ্চ চুড়োয় পৌঁছালাম। নীচে জঙ্গলে ঢাকা উপত্যকা আর দূরের সদ্য ছেড়ে আসা কিসেমোর পাহাড় শ্রেণি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কয়েকশো ফুট নীচে নামতেই একটা গভীর, শুকনো, বালুকাময় খাতে এসে পৌঁছালাম, এই নালাখাত পেরিয়ে ওপারে আবার যতটা নেমে এসেছি ততটাই ফের উঠতে হবে। চারপাশে আবার একই রকম দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে পথচলা, যতক্ষণ না আমরা জলের পাশে একটা বেড়া-ঘেরা গ্রাম দেখতে পেলাম। সেখানে কী সুন্দর ঘাসের কুঁড়ে রয়েছে, সদ্য নির্মিত—সঙ্গে সঙ্গে একরাতের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটা দখল করলাম। টানাগাড়িটা খুবই ঝামেলা করছে; এমনকি আমাদের শক্তিশালী গাধাগুলোও যারা কিনা সহজেই ১৯৬ পাউন্ডের উপর ওজন বইছিল, তারাও মাত্র ২২৫ পাউন্ড ওজনের বোঝা সমেত গাড়িটা আর টানতে পারছে না।
১৫ই ভোরবেলায় আমরা শিবির গুটিয়ে মিকেসেহের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।
(ক্রমশ... পরের কিস্তি পড়ুন পরের বৃহস্পতিবার)
আমার অভিজ্ঞতায় অনেক নাম বদলে গেছে। ধরুন এখন যদি কেউ এই অনচলে সট্যানলির পদ চিনহ ধরে ( মোরোগোরো অসাধারন - অবশ্যই দেখার মত ) যান তাদের সুবিধারথে বরতমান নামের তালিকা ফুটনোটে দিতে পারেন। যেমন সট্যানলি যাকে উনগেরেনগেরি বলেছেন সেটা এনগেরেনগে নামে পরিচিত। একটা ছোট খাট জনপদ। অথবা একেবারে শেষে সেই তালিকা দিতে পারেন।
ভালো আইডিয়া। মাথায় রাখব। ধন্যবাদ।
প্রেসিডেনসিয়াল লেভীর ছবিটা তো পিয়ার্সের (ফ্যাঙ্কলিন পিয়ার্সঃ ১৮৫৩-১৮৫৭) লেভীর। ঊলেসিস গ্র্যান্টের (Ulysses S Grantঃ ১৮৬৯-১৮৭৭) আলোচনার সাথে পিয়ার্সের লেভীর ছবি জুড়ে দেওয়াটা একটু আজব লাগল।
["একটা ভালো লেখাকে অহেতুক exotic করার চাপ না নেওয়াই ভালো" : প্রাচীন অরণ্য প্রবাদ!]
স্ট্যানলির কল্পনা শক্তি অসাধারণ ছিল। যুদ্ধ ক্ষেত্রে না গিয়েই তার দুর্ধর্ষ বর্ননা দেবার ক্ষমতা রাখতেন এতেই তো বেনেট সাহেব চমৎকৃত হয়ে যান। আর এটা তো প্রমাণিত সত্য যে তাঁর ডায়েরীর ৮ ও ৯ নভেম্বরের পাতা কখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি অথচ ১০ তারিখ তিনি ডক্টর লিভিংস্টোনের মুখো হয়েছেন . আরেকটা কথা - আফ্রিকাকে কালো মহাদেশ নামটি তিনিই প্রথম দিয়েছেন ( থ্রু দি ডার্ক কন্টিনেন্ট ) সে নাম রয়ে গেলো।