ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ পর্বে মিসংঘি নামের একটি অঞ্চলের উদ্দেশে যাত্রা। তরজমা স্বাতী রায়
সামনের ডান পায়ের খুর থেকে তার মাথার উপর প্রান্ত অবধি জিরাফটা মাপে ১৬ ফুট ৯ ইঞ্চি। এই গোত্রের সবচেয়ে বড় আকারের গুলোর মধ্যের একটা। যদিও এক একটা ১৭ ফুটের বেশি মাপেরও পাওয়া গেছে। সারা গায়ে বড় কালো, প্রায় গোল গোল দাগ।
খামিসিকে মৃত জন্তুর দায়িত্ব দিয়ে আমি শিবিরে ফিরে গেলাম। সেখান থেকে লোক পাঠাতে হবে জিরাফ কাটা ও আমাদের গ্রামে মাংস বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু খামিসি সিংহের ভয়ে একটা গাছে উঠে বসেছিল আর সেই ফাঁকে শকুনের দল জিরাফের উপর এসে বসেছিল। আমাদের লোকেরা যতক্ষণে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়, ততক্ষণে তারা চোখ, জিভ ও পিছনের দিকের একটা বড় অংশই খেয়ে ফেলেছে। বাকিটুকু নিয়ে এসে দাঁড়িপাল্লায় চাপানো হল। সেটার ওজন ছিল নিচে দিলাম—
১ টা পিছনের পা ১৩৪ পাউন্ড
১ টা পিছনের পা ১৩৬ পাউন্ড
১ টা সামনের পা ১৬০ পাউন্ড
১ টা সামনের পা ১৬০ পাউন্ড
পাঁজরা ১৫৮ পাউন্ড
ঘাড় ৭৪ পাউন্ড
পাছা ৮৭ পাউন্ড
বুক ৪৬ পাউন্ড
যকৃৎ ২০ পাউন্ড
ফুসফুস ১২ পাউন্ড
হৃৎপিণ্ড ৬ পাউন্ড
খাওয়ার যোগ্য অংশের মোট ওজন ৯৯৩ পাউন্ড
চামড়া ও মাথা ১৮১ পাউন্ড।
পরের তিন দিন আমার ধুম জ্বর চলল। বিছানা থেকে নড়তে পারিনি। এমতবস্থায় যা ওষুধ খাই, অর্থাৎ কোলোসিন্থ এবং কুইনাইন, তাই খেলাম। তবে অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে একই জোলাপের অত্যধিক ব্যবহার তার প্রভাব কমিয়ে দেয়, আর অন্ত্র পরিষ্কার ও যকৃতকে কার্যকর রাখার জন্য অভিযাত্রীদের সঙ্গে কোলোসিনথ, ক্যালোমেল, জালাপের রেজিন, ইপসম সল্ট ইত্যাদি বিভিন্ন ওষুধ থাকা ভাল। আর যতক্ষণ না এইসব ওষুধ শরীরকে কুইনাইন গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করে, ততক্ষণ কুইনাইনও খাওয়া উচিত না ।
জ্বরের জন্য ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন হল ৩ গ্রেন জালাপের রেজিন ও ২ গ্রেন ক্যালোমেল। সঙ্গে পেটের জ্বালা রোধের জন্য যথেষ্ট এলাচের আরকও - সব মিলিয়ে একটা বড়ির মত বানানো - একজন খুব আলস্য ও ক্লান্তিবোধ করলেই সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে নিতে হয়। এইসব লক্ষ্মণ নিশ্চিতভাবে আফ্রিকান জ্বরের অগ্রদূত। ওষুধের দ্রুত কাজের জন্য এক-দুই ঘন্টা পরে এক কাপ দুধ-চিনি-ছাড়া কফি পান বিধেয় । ডাক্তার এও মনে করেন যে এর সঙ্গেই কুইনাইন বড়িও নেওয়া উচিত। আমার অভিজ্ঞতা যদিও তিনি যা সহ্য করেছেন তার ধারেকাছে নয়, তবু সেটা অন্য কথা বলে, বলে যে এই ওষুধ কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত কুইনাইন অকেজো। আমার পেট কখনই কুইনাইনের কথা শুনতে পায় না যদি না তার আগে জোলাপ থাকে।
কনস্টান্টিনোপলের একজন সুপরিচিত ধর্মপ্রচারক ভ্রমণকারীদের পেটের থেকে পিত্ত বের করে দেওয়ার জন্য ৩ দানা টারটার-এমেটিক নিতে পরামর্শ দেন। কিন্তু শ্রদ্ধেয় ডাক্তারটি সম্ভবত ভুলে গেছেন যে শুধু তো পেট নয়, শরীরের আরও বিভিন্ন অংশই ঘেঁটে থাকে। আর যদিও বা একটা দুটো সামান্য আক্রমণের ক্ষেত্রে এই প্রতিকারটি সফল প্রমাণিত হতেও পারে, আফ্রিকার একজন দুর্বল হয়ে পড়া মানুষের পক্ষে এই ওষুধ বড্ড কড়া। আমি নিজে তিন বা চারবার এই পদ্ধতি বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করেছি; কিন্তু সচেতনভাবে এটা সুপারিশ করতে পারি না। গায়ে চাকা চাকা হলে, আমি ৩ গ্রেইন টারটার ইমেটিক খাওয়ার পরামর্শ দিতে পারি। তবে তারপর একবার পেট-সাফা করলেও একই কাজ হবে।
২৭ তারিখে আমরা রওনা হলাম মিসংঘির উদ্দেশে। প্রায় অর্ধেক পথ গিয়ে আমি দেখলাম যে অভিযানের সামনের দিকটা দৌড়াচ্ছে আর যতক্ষণে আমার গাধাটি লাথি মারতে শুরু করল ও গোড়ালি দিয়ে পিছনে মারতে শুরু করল, ততক্ষণে দ্রুত একে একে, একেবারে পিছনের লোকটা অবধি, সকলেই ওরা কেন যে দৌড়াচ্ছে সেটা জেনে গেল। এক সেকেন্ডের মধ্যে এই উত্তেজনার কারণ বুঝে গেলাম, আমার মাথার চারপাশে বুনো মৌমাছির গুঞ্জন, তাদের মধ্যে তিন-চারটে আমার মুখের উপর বসেছে, বিচ্ছিরিভাবে হুলও বিঁধিয়েছে। পাগলের মত প্রায় আধ মাইল দৌড়ালাম, বেচারা হুল-বেঁধা প্রাণীদের মতোই আমরাও বুনো আচরণ করেছিলাম।
অস্বাভাবিক রকমের লম্বা পথ। সন্দেহ ছিল ডাক্তার এতটা হাঁটতে পারবেন কিনা, কারণ তার পায়ের অবস্থা খুবই কাতর, তাই আমি খাটিয়া সহ চারজনকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম; কিন্তু জেদি বুড়ো কিছুতেই চড়ল না, আঠারো মাইল হাঁটার পরেও শিবির অবধি গোটা পথটা হেঁটে গেল। তার মাথায় মুখে ভয়ঙ্করভাবে মৌমাছি কামড়েছে। এমনকি বেশ কিছু মৌমাছি তার চুলের মধ্যে গেঁড়ে বসেছে। কিন্তু, এক কাপ গরম চা আর কিছু খাবার খাওয়ার পরে, তিনি ফের এমন প্রফুল্ল হয়ে গেলেন যেন তিনি কখনও এক মাইলও পথ হাঁটেননি।
মধ্য উকোনঙ্গোর এমরেরাতে আমরা একদিন থামলাম। শস্য পিষতে হবে। আর এমরেরা ও মান্য়রার মধ্যের বিজন প্রান্তর পেরনোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিতে হবে।
৩১ শে জানুয়ারী, সুলতান কামিরাম্বোর মাওয়ারুতে এক কাফেলার সঙ্গে দেখা হল। সেটার সর্দার হল সাইদ বিন হাবিবের একজন দাস । আমাদের শিবির ছিল ঘন জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে সেই দাস দেখা করতে এসেছিল। সে বসে কফি নেওয়ার পরে, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "বন্ধু, উন্যানয়েম্বে থেকে কী খবর নিয়ে এলে?"
"খবর ভাল, কর্তা।"
"যুদ্ধের কী খবর?"
“আহ্, মিরাম্বো কোথায় গেল? সে এতই ক্ষুধার্ত যে এখন চামড়া পেলেও খায়। আমার প্রভু সাইদ বিন হাবিব এখন কিরিরা দখল করেছেন। আরবরা উইল্যানকুরুর দরজায় বজ্রনির্ঘোষ করছে। সাইদ বিন মাজিদ, যিনি বিশ দিনে উজিজি থেকে উসাগোজিতে এসেছিলেন, রাজাকে পাকড়াও করে মেরে ফেলেছেন। কাসেরার সিম্বা তার বাবা উন্যানয়েম্বের এমকাসিওয়াকে বাঁচানোর জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছে। উগুন্ডার রাজা পাঁচশো লোক পাঠিয়েছে যুদ্ধ করতে। ওহ—মিরাম্বো কোথায় পালাল? এক মাসের মধ্যে সে ক্ষিধেয় মরে যাবে।"
"দারুণ খবর, খুব ভাল খবর, বন্ধু।"
"হ্যাঁ — আল্লা ভরসা।"
"আর তুমি কাফেলার নিয়ে কোথায় চললে?"
“মজিদের ছেলে সাইদ, যিনি উজিজি থেকে এসেছেন, তিনি আমাদের বলেছেন যে সাদা লোক যে রাস্তা নিয়েছিল, সেটা ধরে সে নিরাপদে উজিজিতে পৌঁছেছে আর সে উন্যানয়েম্বেতে ফেরার পথে আছে। তাই ভাবলাম যে সাদা মানুষ যদি সেখানে যেতে পারে তবে আমরাও যেতে পারব। দেখো, এবার আরবরা শ্বেতাঙ্গের রাস্তা দিয়ে দলে দলে আসবে, উজিজি থেকে হাতির দাঁত নিতে।"
"আমিই সেই সাদা মানুষ।"
"আপনি?"
"হ্যাঁ।"
‘‘সেকি! তবে যে শোনা গেল আপনি মারা গেছেন— জাভিরাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন।"
"আহ্, বন্ধু, এসব ওই খামিসের ছেলে এনজারার কথা।" লিভিংস্টোনকে দেখিয়ে বললাম, "এই সেই সাদা মানুষ, আমার পিতা, যাকে আমি উজিজিতে পেয়েছি। ইনি এখন আমার সঙ্গে তার কাপড় আনতে উন্যানয়েম্বেতে যাচ্ছেন, তারপরে আবার ওই বিস্তৃত জলরাশির কাছে ফিরে আসবেন।"
"দারুণ তো! - সত্যি কথাই বলছেন।"
"উন্যানয়েম্বের সাদা মানুষের সম্পর্কে কিছু জানো?"
"কোন সাদা মানুষ?"
"যে সাদা লোকটিকে আমি কুইহারায় আমার বাড়ি - মানে সেলিমের ছেলে সাইদের বাড়িতে রেখে এসেছি।"
"তিনি মারা গেছেন."
"মারা গেছেন!"
“হ্যাঁ।"
"নিশ্চয় বলছ না যে সাদা মানুষটি মারা গেছে?"
"সত্যি - তিনি মারা গেছেন।"
"কতদিন আগে?"
"অনেক মাস হল।"
"কী করে মারা গেছে?"
"হোমা (জ্বর)।"
"আমার লোকদের আর কেউ মারা গেছে?"
"আমি জানি না।"
"বেশ।" আমি সহানুভূতির চোখে ডাক্তারের দিকে তাকালাম, তিনি উত্তর দিলেন, "আমি আপনাকে সেটাই বলেছিলাম। আপনি যখন তাকে আমার কাছে একজন মাতাল হিসেবে বর্ণনা করেছিলে, আমি জানতাম সে বাঁচতে পারবে না। পাঁড় মাতালরা এই দেশে বাঁচতে পারে না, অন্য পাপের পাপীদের মতনই। জাম্বেজিতে আমার অভিযানেও যেসব মৃত্যু ঘটেছে তার কারণও একই।’’
“আহ্, ডাক্তার, আমার দলের দুজন চলে গেল। এই জ্বর যদি আরও কিছুদিন চলে , তাহলে এবার আমার পালা।"
"আরে না, না, মোটেই না। জ্বরে মারা যাওয়ার হলে উজিজিতেই মারা যেতে, সেই যখন আপনাকে পালাজ্বর চেপে ধরেছিল । এসব ভাববেন না। আপনার জ্বর এখন শুধু জলে ভেজার ফল। এই জন্য আমি বর্ষার মধ্যে কখনো অভিযান চালাই না। উদ্বিগ্ন ছিলাম বলে এবার এলাম আর আপনাকে উজিজিতে আটকে রাখতেও চাইনি।"
"হ্যাঁ, এই দেশে উৎসাহ দেওয়ার জন্য, মন চাঙ্গা রাখার জন্য একজন বন্ধু সঙ্গে থাকা যে কী ভাল! কিন্তু বেচারা শ। সে খারাপ মানুষ ছিল; কিন্তু বাজে লাগছে - তার জন্য কষ্ট লাগছে। কতবার তাকে চাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি! কিন্তু তার আর জীবনীশক্তি ছিল না। আর চলে আসার আগে যে সব শেষ কথা বলেছিলাম, তার মধ্যে তাকে এও বলেছিলাম, মনে রেখো, যদি তুমি উন্যানয়েম্বেতে ফিরে যাও তো তুমি মরবে! "