ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। স্ট্যানলে নথিবদ্ধ করছেন লিভিংস্টোনের মুখে শোনা তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত। তরজমা স্বাতী রায়
সবাই জানে যে হাতির দাঁতের ব্যবসা কেন্দ্রগুলো নীল নদের পেথেরিকের নামাঙ্কিত শাখা ধরে প্রায় ৫০০ মাইল অবধি ছড়ানো। এই কথাটাও অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে যখন বলা হয়েছিল যে গোন্ডোকোরো, ৪° উত্তর অক্ষাংশে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০০ ফুট উপরে অবস্থিত আর এদিকে যে জায়গায় থামা হয়েছিল সেই ৪° দক্ষিণ অক্ষাংশের জায়গাটারও উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ২০০০ ফুটের সামান্য বেশি। দুটো নদীই সমুদ্র থেকে ২০০০ ফুট উঁচুতে, একে অপরের থেকে ৮° অক্ষাংশ দুরে, অথচ দুটোকে এক ও একই নদী বলা হচ্ছে, এই ব্যাপারটা কিছু মানুষের কাছে একটা ভারি আশ্চর্য কথা বলে মনে হতে পারে। তবে বিস্ময় প্রকাশে লাগাম পড়ানো ভাল, এটা বুঝতে হবে যে এই বিপুল, বিস্তৃত লুয়ালাবা মিসিসিপির চেয়েও চওড়া, এটা একটা হ্রদজাত নদী; মাঝে মাঝেই এত বিপুল-পরিমাণ জল একেকটা ছড়ানো হ্রদ তৈরি করে ফেলেছে; তারপর আবার খানিক সরু হয়ে চওড়া নদীর চেহারা নিয়েছে, আবার আরেকটা হ্রদ তৈরি করেছে, আর সে কারণেই, ৪° অক্ষাংশ বা তার থেকেও উত্তরে ডাক্তার আবার একটা বড় হ্রদের কথা শুনেছিলেন।
যতক্ষণ না লুয়ালাবা, যেখানে ডাক্তার থেমেছিলেন আর বাহর গজলের দক্ষিণতম বিন্দু, যেখানে পেথেরিক এসেছিলেন, এই দুটি নদীর উচ্চতা নিখুঁত নির্ভুল ভাবে জানা যায়, ততক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।
এবার, তর্কের খাতিরে, আমরা ধরে নিলাম যে এই নামহীন হ্রদটি ৬° অক্ষাংশ দীর্ঘ, কারণ এটাই হয়ত ইতালীয় অভিযাত্রী পিয়াজ্জিয়ার আবিষ্কৃত হ্রদ, যেখান থেকে শ্বেত নীলের পেথেরিকের শাখা নলখাগড়ায় ভরা জলাভূমির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসে বাহর গজলের মধ্যে দিয়ে বয়ে গোন্ডোকোরোর দক্ষিণে শ্বেত নীলে এসে পড়ে। এই ভাবেই আমরা ধরতে পারি যে নদীদুটো এক; কারণ যদি হ্রদটি এত ডিগ্রী অক্ষাংশ জুড়ে বিস্তৃত হয়, তাহলে একটা নদীর উপরের, ৮° অক্ষাংশ দুরের দুটি বিন্দুর উচ্চতার মধ্যের খুবই স্বাভাবিক পার্থক্য ব্যাখ্যা করার ততটা দরকার থাকবে না।
এছাড়াও, লিভিংস্টোন উচ্চতা পর্যবেক্ষণ ও মাপার জন্য যেসব যন্ত্র ব্যবহার করেছেন, তাতেও ত্রুটি থাকতে পারে; হয়ত সেটাই হয়েছে কারণ বিগত ছ'বছর ধরে অভিযানের সময় যন্ত্রগুলো বেশ বাজে ভাবেই নাড়া-ঘাঁটা হয়েছে।
অবশ্য উচ্চতা-জনিত এই অসঙ্গতি সত্ত্বেও, ওয়েবের নদী বা লুয়ালাবাকে নীল নদ বলে মনে করার আরও একটা জবরদস্ত কারণ আছে। এই নদীর জলবিভাজিকা অঞ্চল, যেখানে ৬০০ মাইল জায়গা লিভিংস্টোন ভ্রমণ করেছেন, আসলে একটা পূর্ব-পশ্চিমে সুউচ্চ পাহাড় ঘেরা উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত উপত্যকার থেকে প্রাপ্ত জলে সিঞ্চিত।
যদিও কাসাই বা কোয়াঙ্গো নদী এই নদীতে এসে পড়ে না, তবে পূর্ব বা পশ্চিম দিকের অনেক দূর থেকে বয়ে আসা অনেক নদীই এই উপত্যকা, বা জলনিষ্কাশনের রেখাতে এনে জল ঢালে - উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে , লুফিরা ও লোমামি নামের উল্লেখযোগ্য পশ্চিম দিকের উপনদী ও পূর্ব দিক থেকে আসা বড় নদী লিন্ডি ও লুয়ামো। আর যদিও বেশিরভাগ বুদ্ধিমান পর্তুগিজ অভিযাত্রী ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন যে কাসাই, কোয়াঙ্গো আর লুবিলাশ হল কঙ্গো নদীর প্রধান প্রধান ধারা , এখনও অবধি কেউ বলেন নি যে এই বিশাল উত্তরবাহিনী নদীটি যাকে স্থানীয়রা লুয়ালাবা নামে ডাকে, সেটা আসলে কঙ্গো।
হয়ত এটা কঙ্গো নদী, বা, হয়ত, নাইজার। যদি লুয়ালাবা সমুদ্রতল থেকে মাত্র ২০০০ ফুট উপরে হয় আর অ্যালবার্ট এন'ইয়ানজা ২৭০০ ফুট উঁচুতে থাকে, তাহলে তো লুয়ালাবা সেই হ্রদে প্রবেশ করতে পারবে না। যদি বাহর গজল গোন্ডোকোরোর উপর দিয়ে ৮° ধরে বাহু প্রসারিত না করে, তবে লুয়ালাবা নীল নদ হতে পারে না। তবে এখনই ব্যাপারটা নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসা উচিত হবে না। লিভিংস্টোন নিজেই বিষয়টি পরিষ্কার করবেন; আর তাঁর যদি একে কঙ্গো বলে মনে হয়, তাহলে তিনিই প্রথম নিজের ভুল স্বীকার করবেন।
উত্তরবাহিনী লুয়ালাবা নদীকে ৭° অক্ষাংশ ধরে অনুসরণ করলেও লিভিংস্টোন স্বীকার করেছেন যে নীল নদের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর যদিও তার এক বিন্দুও সন্দেহ নেই এটাই নীল নদ , তবুও নীল নদ সংক্রান্ত প্রশ্নের সমাধান ও সমাপ্তি হয়েছে বলে বলা যায় না। তার দুটো কারণ:
১. তিনি চারটে ঝর্ণার অস্তিত্বের কথা শুনেছেন, তাদের মধ্যে দুটো ঝর্ণার একটা উত্তরমুখো ওয়েবস নদী বা লুয়ালাবার জন্ম দিয়েছে আর অন্যটা দক্ষিণদিকে প্রবাহিত জাম্বেজি নদীর জন্ম দিয়েছে। স্থানীয়দের থেকে তিনি বারবার এই ঝর্ণাগুলোর কথা শুনেছেন। বেশ কয়েকবার তিনি এই ঝর্নাগুলোর থেকে মাত্র ১০০ বা ২০০ মাইল দূরত্বে ছিলেন, কিন্তু কিছু না কিছু সমস্যা এসে সবসময় ঝর্ণা দেখতে যাওয়ায় বাধা দিয়েছে। যারা সেই ঝর্ণাগুলো দেখেছে, তাদের মতে, ঝর্ণাগুলো একটা ঢিপি বা উঁচুস্তরের দুপাশ থেকে বেরিয়েছে , সেখানে কোন পাথর নেই। কেউ কেউ বলে, এটা পিঁপড়ের-ঢিপি। এদের মধ্যে একটা ঝর্ণা তো এতোই বড় যে তার একপাশে দাঁড়ানো মানুষকে অন্য পাশ থেকে দেখা যায় না। এই ঝর্ণাগুলো অবশ্যই আবিষ্কার করতে হবে আর তাদের অবস্থান নির্ধারণ করতে হবে। সেগুলোকে ব্যাংওয়েওলো লেকের উপনদীগুলোর দক্ষিণে বলে ডাক্তার মনে করেন না। হেরাল্ডকে লেখা তাঁর চিঠিতে তিনি বলেছেন, "এই চারটে পুরোদমে, তোড়ে জল বেরনো ঝর্ণা, যারা কিনা একে অপরের খুব কাছাকাছি থেকেই উৎগত হয়েছে আর চারটে বড় বড় নদীর জন্ম দিয়েছে, খানিকটা হলেও মিশরের সাইস শহরের মিনার্ভার সেক্রেটারির সকল অভিযাত্রীদের পিতৃতুল্য হেরোডোটাসকে দেওয়া নীলনদের অতল ঝর্ণার বিবরণের সঙ্গে মেলে।”
সব পাঠকের হাতের কাছে মূল বই নাও থাকতে পারে। তাঁদের সুবিধার জন্য আমি ক্যারির করা হেরোডোটাসের অনুবাদ থেকে নিচের অংশটা জুড়ে দিচ্ছি।
নীল নদের উৎস বিষয়ে ইজিপ্ট, লিবিয়া বা গ্রীসের যত লোকের সঙ্গেই কথা বলেছি, তারা কখনোই কিছু জানার ভানও করেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন মিশরের সাইস নামের জায়গার মিনার্ভার কোষাগারের রেজিস্ট্রার। তাঁর সঙ্গে কথা বললে ব্যাপারটা খুবই অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। তিনি বলেছিলেন যে তিনি এ বিষয়ে খুবই ভাল করে জানেন; তারপরও তাঁর বিবরণ ছিল এই রকম : "থেবাইস অঞ্চলের সাইনে1 ও এলিফ আন্টিন নামের শহরদুটির মাঝখানে যে দুটো খাড়া উঠে যাওয়া, তীক্ষ্ণশীর্ষ পর্বত আছে, তাদের একটার নাম হল ক্রফি, আর অন্যটা মোফি; গভীর অতল নীল নদের উৎসধারা এই পর্বতদুটোর মধ্য দিয়ে বয়ে যায়। মিশর ও তার উত্তরে এই নদীর অর্ধেক জল পৌঁছায়, বাকী অর্ধেক জল ইথিওপিয়া ও আরও দক্ষিণে বয়ে যায়। নীল নদের ঝর্ণাগুলো অতল।” তিনি বলেছিলেন, “মিশরের রাজা সামেটিকাস পরীক্ষা করে একথা প্রমাণ করেছিলেন: কারণ, বহু হাজার ফ্যাদম দৈর্ঘ্যের দড়ি নামিয়েও তিনি নদীর তল খুঁজে পাননি।” তাহলে, রেজিস্ট্রার যদি প্রকৃত সত্য বলে থাকেন; তবে আমার মতে, তাঁর কথা প্রমাণ করে যে এখানে জলের সঙ্গে পাথরের ধাক্কায় একটা জোরালো ঘূর্ণি তৈরি হয়েছে, যতই লম্বা ওলন দড়ি নামানো হোক না কেন, তা আর তলা অবধি আর গিয়ে পৌঁছায় না। আমি অন্য কারোর কাছ থেকে এর বেশি কিছু জানতে পারিনি।
(ক্রমশ…)
1সাইনে হল ইজিপ্টের বর্তমান আসওয়ান শহর