ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। এই পর্বে উকোঙ্গোর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বিবরণ। তরজমা স্বাতী রায়
উকোনঙ্গোর দক্ষিণে ওয়াতুতা অঞ্চল; দক্ষিণ-পূর্বে ওয়ারোরি এলাকা; দক্ষিণ-পশ্চিমে উফিপা এবং কারুঙ্গু; পশ্চিমে উকাওয়েন্দি; উত্তরে উতাকামা মানে উন্যামওয়েজির দক্ষিণ প্রদেশ।
উকাওয়েন্দি জায়গাটা দেখা গেল প্রায় জনবসতিহীন। এবড়োখেবড়ো জমি, জঙ্গলে ভরা, অগণিত সূক্ষ্ম জলধারা-জালিকা অঞ্চলের সব জল বয়ে নিয়ে যায়। উর্বর, অজস্র প্রাণী ও উদ্ভিদের ভরা একটা অনুকূল ক্ষেত্র। জন বসতিগুলোর মধ্যে তবু উল্লেখ যোগ্য উত্তরের মানা মেসেঙ্গে বা টাঙ্গানিকার ধারে, পশ্চিম দিকের এনগোন্ডো এবং টংওয়ে; মাঝখানের রুসাওয়া; দক্ষিণে পামবুরু ও দক্ষিণ-পূর্বে উটান্ডা।
এখানকার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নদী হল রুগুফু। এটা পামবুরুর কাছের একটা পাহাড়ের জটলা থেকে বেরিয়েছে, তার পরে হৃদের সমান্তরালে একটা উত্তরের গভীর উপত্যকার মধ্যে দিয়ে বয়ে মালাগারজির দক্ষিণে হৃদে এসে পড়েছে। এর পরের গুরুত্বপূর্ণ নদী হল লোয়াজেরি, যেটা, কাগুঙ্গু ও পামবুরু পর্বতমালার থেকে বেরিয়েছে। তারপর উরিম্বার প্রধান গ্রামের কাছে হ্রদে এসে পড়ে। এছাড়াও অজস্র নদী রয়েছে যেমন ইউউইলাসিয়া, সিগুংগা, এমভিগা ও কিভোয়ে।
মধ্য আফ্রিকার দেশগুলির মধ্যে আয়তনের দিক থেকে উকাওয়েন্দি,রয়েছে তৃতীয় স্থানে। এই দেশ মালাগারজি নদী থেকে প্রায় ৫° ১০' দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে প্রায় ৬° ১৮' দক্ষিণ অক্ষাংশ অবধি বিস্তৃত। এটা উত্তরে দক্ষিণ উভিনজা এবং মালাগারজি নদী দ্বারা বেষ্টিত; এর পূর্বে রয়েছে উগারা ও উকোনঙ্গো; উসোওয়া ও উফিপা এর দক্ষিণ সীমায়; আর এর পশ্চিমে টাঙ্গানিকা হ্রদ।
উকাওয়েন্দি থেকে উত্তর দিকে চলে আমরা দক্ষিণ উভিনজায় পৌঁছাই। এই দেশটার অনেকটাই গভীর গিরিখাতে ভরা, পাহাড়ী, অমসৃণ এলাকা, চারদিক থেকে মেটে রঙের উলঙ্গ গিরিশিরা যেন কাটাকুটি খেলছে। মালাগারাজির পলি-বিধৌত উপত্যকায় প্রচুর লবণক্ষেত আছে – সেখান থেকে স্থানীয়রা ভাল পরিমাণে নুন উৎপাদন করে। অল্প কয়েকটাই জলধারা এখান দিয়ে বয়ে যায়। এখানকার বিশেষ উৎপাদন বলতে ছাগল আর শস্য।
মালাগারাজি পেরিয়ে আমরা একটা লম্বাটে জায়গায় আসি, দ্রাঘিমারেখা জুড়ে ছড়ানো একটা গরীব দেশ। এর নাম, উত্তর উভিনজা। এখানকার মাটি ভাল না, তবে একটা ছেঁড়া ছেঁড়া জঙ্গল আছে - তাতে গাম, কাঁটাঝোপ, তেঁতুল, মিমোসা আর কয়েকটা বেঁটেখাট সেগুন এইসব দেখা যায়। চারদিকে লবণ ক্ষেত, আর তাদের দখল তথা একচেটিয়া অধিকার নিয়ে দুই বড় সর্দার, লোকন্ডা মীরা এবং এনজোগেরার মধ্যে ঝামেলা লেগেই আছে।
মালাগারাজি তার শুরুর দিকে উত্তর গোম্বে নামে পরিচিত। যেহেতু এটা বিস্তৃত লবণহ্রদের মধ্য দিয়ে বয়ে যায়, এর জলে সামান্য নোনতা স্বাদ আছে, তবে তাতে খাওয়ার অসুবিধা ঘটে না। উজিজি বন্দরের দক্ষিণে এই নদী টাঙ্গানিকায় পড়ে। আমার ধারণা যে হ্রদ থেকে উইল্যানকুরু পর্যন্ত গোটা পথটাই নৌকা করে যাওয়া যায়। বর্ষাকালে যে ততদূর যাওয়া যায় সে তো জানিই।
উত্তর উভিনজা উত্তর দিকে উহহা এর চারণস্থান দিয়ে ঘেরা; পূর্বে উকালাগানজা ও উসাগোজি, অর্থাৎ পশ্চিম উনিয়ামওয়েজি দিয়ে সীমাবদ্ধ; দক্ষিণে মালাগারজি; ও পশ্চিম সীমায় আছে উকারঙ্গা।
এর প্রধান গ্রামগুলো হল এমপেটে, উসেন্যে, ইয়ামবেহো, সিয়ালা, ইসিঙ্গা, এনজোগেরার বদ্বীপ, ও লোকান্ডা মীরার এলাকা। এখানকার প্রধান উৎপাদন হল ছাগল, ভেড়া, শস্য ও লবণ।
উভিনজা থেকে আমরা উহহা গেলাম। এই ঊহহা জায়গাটা একটা বিশাল সমতল এলাকা। আমাদের নেব্রাস্কা প্রেইরির মতো দেখতে। এর দুটো ভাগ- কিমেন্যি ও আন্তারি। সবথেকে চওড়া জায়গায় উহহার উত্তরে উটুটা। এর দক্ষিণে ও পূর্বে রয়েছে উভিনজা আর পশ্চিম সীমায় আছে উকারাঙ্গা ও উজিজি।
উহহা এবং উতুতার মধ্যে একটি পর্বতমালার অবস্থান। বলা হয় যে এই গিরিশ্রেণিই দুই জায়গার সীমারেখা তৈরি করেছে। এই পর্বতমালা থেকে দুটি উল্লেখযোগ্য জলধারার উৎপত্তি, তারা হল রুসুগি এবং রুগুফু। সুনুজজি, কানেঙ্গি ও পম্বওয়ে হল অন্যান্য স্রোতস্বিনী। উহহার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর বেশিরভাগই সামান্য লোনা, বিশেষ করে পম্বওয়ে, কানেঙ্গি এবং রুসুগি।
উহহার ক্ষয়াটে সমভূমি কুঁজ-ওলা গবাদি পশু ও মোটা লেজ-ওলা ভেড়ার পালের পক্ষে ভাল। ছাগলগুলোও খুব ভালো। উর্বর মাটি, খুব ভাল হলকাস সরঘাম ও ভুট্টা ফলে। আবহাওয়াও ভাল, টাঙ্গনিকা ও উসাগারার বাতাস এখানকার তাপমাত্রার বেশি নড়নচরন হতে দেয় না।
উহহার একটা সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য ছোট ছোট হ্রদ বা বড় বড় জলাশয়। জলাধারগুলো অনেকটা ছড়ানো কিন্তু অগভীর বৃত্তাকার গড়নের। প্রমাণের অভাব নেই যে কোন না কোন সময়ে উহহা প্লাবিত হয়েছিল, আর এই মালাগারজি নদীর উপত্যকা আসলে টাঙ্গানিকার গভীর বাহু ছাড়া আর কিছুই না। একজন দক্ষ ভূতাত্ত্বিক এই অঞ্চলে প্রভূত আগ্রহের বিষয় খুঁজে পাবেন।
আরও পশ্চিম দিকে চলে, ছোট্ট সুনুজি নদী পেরিয়ে, আমরা উকারাঙ্গায় পৌঁছালাম। এই দেশটি অতি বৈচিত্র্যময়। উত্তরে যেখানে এটা উত্তর উহহার সঙ্গে মিশেছে, সেই দিকটা পাহাড়ি; দক্ষিণদিকে একটা দীর্ঘ মসৃণ ঢাল। সেই ঢাল লম্বা লম্বা সেগুন গাছে ঢাকা। আর মাঝখানে উঁচু নিচু পাহাড়ে ভরা। দ্রুত, স্বচ্ছ জলধারা সব জল বয়ে যাচ্ছে। উর্বর, মনোহরণ অঞ্চল। উকারাঙ্গা থেকে উত্তর-পূর্ব উহহাকে আলাদা করেছে যে পর্বতমালা সেটাই এখানকার প্রধান গিরিমালা। পূর্ব দিক থেকে, বেশ কয়েকটি সমান্তরাল, গাছে-ঢাকা, গিরিশিরা এসে পশ্চিমাগত মূল গিরিমালার সঙ্গে সমকোণ তৈরি করেছে। তারপর তারা লিউচের পলিভরা উপত্যকার কাছে গিয়ে আচমকা নিচু হয়ে যায়।
উকারাঙ্গার গাছ বলতে প্রধানত সেগুন, এম্বুগু আর বাঁশ। জলবায়ু খুব নাজুক, ও ভিজে। উকারাঙ্গা পাহাড়ের মাথায় যেন অবিরাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে হয়। সেখান থেকে অগুনতি ঝর্না নেমেছে - এরা সবাই লিউচেতে গিয়ে পড়ে।
সুউচ্চ উকারাঙ্গার থেকে আমরা লিউচে উপত্যকায় নেমে এলাম। উজিজিতে এসে পৌঁছালাম। এক অসাধারণ সুন্দর, উর্বর একটি অঞ্চল। এক দুর্দান্ত স্থলবেষ্টিত সমুদ্র দেখতে পেলাম। এর তটভুমি এখন থেকে পবিত্র বলে বিবেচিত হবে, কারণ "যে জায়গায় একজন ভালো মানুষের পদধূলি পড়ে, সেই জায়গা সব সময় স্মরণীয়।" এবং, সত্যিই, আমরা এখন টাঙ্গানিকার সীমান্তবর্তী চিরায়ত এলাকার প্রতি যে ভালবাসা অনুভব করছি, তা প্রকৃতিরই দান। সূর্যাস্তের সময় উজিজির সৈকতের থেকে বিস্তৃত রূপালী জলরাশির উপর দিয়ে পশ্চিম দিকে তাকালে এক অপুর্ব দৃশ্য চোখে পড়ে। সূর্য যেন স্বর্গের বুকে রং নিয়ে হোরি খেলতে বসেন। সেই স্বর্গীয় বর্ণছটা আসে আর জাদুর ছোঁয়ায় দ্রুত হারিয়ে যায়। যতই অকবি হোক না কেন, কোন মানুষই সে দৃশ্য দেখলে হৃদয়ের অন্তরতমস্থানে প্রভাবিত না হয়ে পারে না।
সোনালি ও আকাশি, গোলাপী ও রূপালি, বেগুনি ও কমলা কত যে রঙের বাহার - কখনও সরু রেখা কখনো চওড়া পাড়, বিভিন্ন মেঘের দল যেন চকচকে আগুন-জ্বলা সোনায় বদলে গেছে; পশ্চিম দিকে টাঙ্গানিকাকে ঘিরে বিশাল নীল-কালো বেড়ের থেকে সেই আলোর ছটা প্রতিফলিত হচ্ছে। সেই আলোয় সব পর্বতমালার অপুর্ব দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। তাদের গায়ে লালচে গোলাপী আভা। রূপালী আলোর বন্যায় চারদিক ভেসে যাচ্ছে।