ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে হেনরি মর্টান স্ট্যানলির বাড়ি ফেরার পালা। তরজমা স্বাতী রায়
৩০ তারিখে আমরা খোঞ্জে পৌঁছলাম, মাটির থেকে অনেকটা উঁচুতে দৈত্যাকৃতির সিকামোর আর বাওবাব গাছের পাতার বিশাল চাঁদোয়ার কারণে জায়গাটা উল্লেখযোগ্য। খোঞ্জের সর্দার চারটে গ্রামের গর্বিত মালিক, তার থেকে সে পঞ্চাশ জন সশস্ত্র লোককে এক ডাকে হাজির করতে পারে; তবুও ন্য়ামওয়েজির বাসিন্দাদের প্ররোচনায় এই লোকটা আমাদের ঠেকানোর জন্য প্রস্তুত ছিল, কারণ আমি তাকে মাত্র তিন ডোটি অর্থাৎ বারো গজ কাপড় হঙ্গা হিসাবে পাঠিয়েছিলাম।
কয়েকজন বন্ধুস্বভাবের গোগো ভ্রমণকারী আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। তাঁদের অনুরোধ করা হয়েছিল বোম্বেকে নজরানার বিষয়ে সাহায্য করার জন্য, তাদের ফেরার জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সেই গোগোরা দমবন্ধ করে ছুটতে ছুটতে আমাদের কাছে ফিরে এল, আর আমাকে চিৎকার করে বলেছিল, "কেন এখানে থেমেছেন? মরতে চান? এই অসভ্যরা নজরানা নেবে না, উল্টে তারা গর্ব করে বলে বেড়াচ্ছে যে ওরা আপনার সমস্ত কাপড় গ্রাস করে নেবে।"
যেসব দলত্যাগী ন্যামওয়েজিরা গোগোদের পরিবারে বিয়ে করেছিল তারা এদেশে সবসময় আমাদের ক্ষতি চেয়েছিল। খোঞ্জের সর্দার কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার লোকদের নিজেদের বন্দুকে গুলি ভরতে নির্দেশ দিয়েছিলাম, আর তার সামনেই আমি সদম্ভে নিজের বন্দুকে গুলি ভরেছিলাম, তারপর তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম যে সে কি জোর করে কাপড় নিতে এসেছে, নাকি আমি তাকে যা দেব, সেটাই সে চুপচাপ মেনে নেবে? যে মান্যওয়েজি এইসকল শত্রুতার প্রদর্শনের মূলে, সে কথা বলতে শুরু করলে, তার গলা টিপে ধরলাম। আর হুমকিও দিলাম যে সে যদি আমার সামনে আর মুখ খোলার চেষ্টা করে তবে তার নাকে ঘুষি মেরে চ্যাপ্টা করে দেব। আর যদি লড়াই করতে বাধ্য করা হয় তো তাকেই প্রথমে গুলি করে মারা হবে। এরপর বদমাশকে পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। সর্দার এইসব দেখে খুব মজা পেল। এই পরজীবীর হেনস্থায় জোরে একচোট হেসে উঠল, আর অল্প সময়ের মধ্যে সে আর আমি পারস্পরিক সন্তোষের সঙ্গে নজরানার বিষয়টা মিটিয়ে ফেললাম, বন্ধুভাবে পরস্পরের থেকে বিদায় নিলাম। আমাদের দলবল সেই রাতে সানজায় পৌঁছাল।
৩১ তারিখে আমরা কাম্য়েন্যিতে এলাম। সেই মহান সর্দারের মাগোম্বার কাছে। তার পুত্র তথা উত্তরাধিকারী হল মুটুন্ডু ম'গোন্ডেহ। তার প্রধানমন্ত্রী, একজন হাসিখুশি ধূসর মাথার মানুষ। আমরা যখন মহান সুলতানের টেম্বের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন সে একটা কচি ভুট্টার ক্ষেতের চারপাশে কাঁটার বেড়া দিচ্ছিলেন। সে আমাদের কাফেলাকে একটা সুন্দর "ইয়াম্বো" দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল, নিজে সামনে সামনে গিয়ে আমাদের শিবিরে পৌঁছে দিল। আমার সঙ্গে পরিচয়ের সময় সে খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলল। তাকে একটা কিটি - বসার টুল - দেওয়া হল, ব্যস জমিয়ে বসে সে গল্প জুড়ল। আমার পূর্বসূরি বার্টন, স্পেক ও গ্রান্টকে সে খুব ভালোভাবে মনে রেখেছে; আমাকে তাদের যে কারো থেকে অনেক ছোট বলে ঘোষণা করল; আর একজন শ্বেতাঙ্গ লোক (বার্টন?) গাধার দুধ পান করত সে কথা মনে করে আমাকেও কিছুটা গাধার দুধ জোগাড় করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি যেভাবে সেই দুধ পান করলাম তাতে মনে হয় সে খুব তৃপ্ত হয়েছিল।
তার ছেলে, উনামাপোকেরা একজন বছর তিরিশেকের লম্বা মানুষ। আর তার আমার প্রতি প্রবল বন্ধুত্বের টান অনুভব করেছিল। আমাকে কথা দিয়েছিল যে হালকা নজরানা দিলেই হবে। তাছাড়া কান্যেন্যি সীমান্তের গ্রাম ম্যুমি যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিতে আমার সঙ্গে সে একজন লোকও পাঠাবে বলেছিল। সেই পথে গেলে লোলুপ কিসেওয়াহকে এড়াতেও পারব। তার আবার কাফেলার থেকে প্রচুর উপঢৌকন আদায় করার অভ্যাস ছিল।
উনামাপোকেরা এবং তার বাবার কারণে, আমাদের খুবই সামান্য খেসারত দিতে হয়েছিল, কারণ আমরা মাত্র দশ ডটি কাপড় দিয়েছিলাম, বার্টনকে যেখানে ষাট ডটি বা দুশ চল্লিশ গজ কাপড় দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।
১ এপ্রিল, ভোর ভোর উঠে, চার ঘন্টা হেঁটে আমরা ম্যুমিতে পৌঁছালাম; তারপর আমরা জঙ্গলে ঢুকলাম, দুপুর ২টো নাগাদ, জঙ্গলের মাঝে একটি বড় জিওয়া বা পুকুরে পৌঁছালাম; আর পরের দিন সকাল ১০ টায় মাপাঙ্গার জমিতে পৌছালাম। আমরা মাপাঙ্গা গ্রাম পেরিয়ে গ্রামের বাইরে একটি বিশ্রামের জায়গার দিকে যাচ্ছিলাম, যেখানে আমরা সকালের নাস্তা করতে পারি আর সেইসঙ্গে নজরানার ব্যাপারটাও মেটাতে পারি, তখন একটা ছেলে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এগিয়ে এল, আমাদের জিজ্ঞাসা করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি। আমরা শিবির-এলাকায় যাচ্ছি শুনে সে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে গেল, এবং তারপরেই আমাদের ডানহাতের মাঠে কিছু লোকের সাথে তাকে কথা বলতে শুনলাম।
ইতিমধ্যে, আমরা একটা আরামদায়ক ছায়াঢাকা জায়গা খুঁজে বার করে থেমেছি; দলের লোকেরা সবে মাটিতে হেলান দিয়ে বসেছে, কেউ কেউ নিজের নিজের বোঝার কাছে দাঁড়িয়ে আছে; বোম্বে যেই একটা কাপড়ের গাঁটরি খুলতে যাবে, অমনি লোকদের বিশাল ঠেলাঠেলি আর জোরে হাঁকডাক শুনতে পেলাম। তার পরপরই, প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জন সশস্ত্র লোক, কেউ মাথার উপরে বর্শা বাগিয়ে, কেউ আবার ধনুক-বাণ উঁচিয়ে, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল। তাদের সামনে একজন সর্দার। তারা সকলে অসভ্যদের মতন ক্রুদ্ধ চিৎকার করছে, একটা দীর্ঘ টানা "হ্যাত -উহ-হ্যাত -উহহ-উহহ" এর মতো শব্দ, স্পষ্টতই যার অর্থ "তুমি করবে, তাই না? না, করবে না! -একই সঙ্গে কৃতসংকল্প, বেপরোয়া, ও হাড়-হিম করা চিৎকার।
সন্দেহ হচ্ছিল, যে শব্দ শুনছি তা অশুভ, সেই অনুযায়ী আমরা অস্ত্র, কার্তুজ প্রস্তুত করছিলাম। সত্যিই, একটা অ্যাডভেঞ্চারের জন্য একটা দুর্দান্ত সুযোগ! একটা বর্শা যদি আমাদের দিকে উড়ে আসা, অথবা এই বর্বর ভীতিপ্রদ জনতার দিকে একটা গুলি যদি কেউ ছোঁড়ে , সঙ্গে সঙ্গে দুটো বিরোধী দল একটা মারাত্মক সংঘর্ষে লিপ্ত হবে! কোন যুদ্ধ ঘোষণার দরকার নেই, কোনো আড়ম্বর লাগবে না, শুধু একটা ঝগড়া-মারামারি, ব্রীচ-লোডারগুলোর দ্রুত আগুন-ঝরানো, ফ্লিন্ট-লক মাস্কেটের কয়েকদফা বারুদ উগড়ে দেওয়া, সঙ্গে বর্শার ওড়াউড়ি ও ধনুকের টঙ্কার, সঙ্গে সঙ্গে কাপুরুষদের দুরদার পালানো আর পিছনে পিছনে অসভ্যদের চিৎকার করে ধাওয়া করা - কে জানে কিভাবে এটা পুরো শেষ হবে? চল্লিশটা বন্দুকের বিরুদ্ধে চল্লিশখানা বর্শা তো ঠিক —কিন্তু কজন বন্দুকধারী পালাবে না? সম্ভবত সব কজনই, আর শেষকালে শুধু আমি আর আমার বাচ্চা বন্দুকধারী রয়ে যাব যাতে বেশ রসিয়ে রসিয়ে আমার জুগুলারখানা কাটা যায় বা আমার মুণ্ডুটা কেটে নেওয়া যায়। আর তারপর আমার মাথাখানা একটা কিগোগো গ্রামের মাঝখানে একটা লম্বা খুঁটির মাথায় সাজিয়ে রাখা হবে, যেমন উজারামোর দেগে লা-এমহোরাতে বেচারা মাইজান মহাশয়ের ছিল । এক অভিযানের শুভ সমাপ্তি! আর ডাক্তারের জার্নালও চিরতরে হারিয়ে যাবে—ছ' বছরের পরিশ্রমের ফল!
তবে এই দেশে, একেবারে শেষপ্রান্তে না যাওয়া অবধি যুদ্ধ করার মানে নেই। উগোগোতে যে কোন যুদ্ধবাজ মুঙ্গো পার্ক সফল হতে পারে না, এক না যদি তার সঙ্গে একটা বিশাল দলবল থাকে। পাঁচশ ইউরোপীয় নিয়ে আমি সকৌশলে উত্তর থেকে দক্ষিণে আফ্রিকা অতিক্রম করতে পারব আর এই ধরণের একটা দলের নৈতিক প্রভাবও প্রভূত। খুব সামান্য যুদ্ধেরই প্রয়োজন হবে।
যে গাঁটরিটার উপরে বসেছিলাম সেখান থেকে না উঠেই, আমি কিরাঙ্গোজিকে এত ক্ষিপ্ত চেঁচামেচির কারণ জানতে বললাম। আর যদি তারা ডাকাতির উদ্দেশেই এসে থাকে তাহলে এহেন হুমকির কারণ কি তাও জানতে চাইতে বললাম।
"না," সর্দার বলল, "আমরা রাস্তা বন্ধ করতে চাই না, ডাকাতিও করতে চাই না; তবে নজরানা চাই।"
“কিন্তু দেখতে পাচ্ছ না যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি আর নজরানা পাঠানোর জন্য গাঁটরিটা খোলা হয়েছে? আমরা তোমাদের গ্রাম থেকে এতটা দূরে এসেছি যাতে শ্রদ্ধা জানানোর পর্ব মিটিয়ে, আমরা আমাদের পথে রওনা দিতে পারি, যেহেতু এখনও বেলা আছে।"
সর্দার জোরে হেসে ওঠে, সঙ্গে আমরাও যোগ দিই। সে স্পষ্টতই নিজের আচরণের জন্য লজ্জিত বোধ করছিল; কারণ স্বেচ্ছায় ব্যাখ্যা দিয়েছিল যে সে ও তার লোকেরা যখন গ্রামের এক নতুন বেড়া তৈরির জন্য কাঠ কাটছিল, তখন একজন ছেলে তার কাছে এসে বলে যে এনগোওয়ানাদের একটা কাফেলা তাদের এলাকার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তারা যে কে সেসব ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য না থেমেই। শীঘ্রই আমরা ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম। তার জন্য বৃষ্টি ডেকে আনতে সে আমার কাছে খুব অনুরোধ করেছিল, কারণ কয়েক মাস ধরে বৃষ্টি হয়নি- তাদের ফসলের খুব ক্ষতি হচ্ছিল। আমি তাকে বললাম যে যদিও শ্বেতাঙ্গরা খুব মহান, ও বুদ্ধিমান মানুষ, আরবদের চেয়ে অনেক উন্নতও, তবুও আমরা বৃষ্টি ডেকে আনতে পারি না। খুব হতাশ হলেও, সে আমার কথায় সন্দেহ করেনি, খুবই সামান্য শ্রদ্ধার্ঘ পেয়েও, সে আমাদের চলে যেতে অনুমতি দিল, এমনকি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কিছু দূর অবধি রাস্তা দেখাতেও এসেছিল।
বেলা তিনটেয় আমরা একটা কাঁটাভরা জঙ্গলে প্রবেশ করলাম; এবং বিকাল পাঁচটা নাগাদ আমরা মুহালাটাতে পৌঁছেছিলাম, সর্দার ন্যামজাগা সে জায়গার রাজা। একজন গোগো যার সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলাম, সে খুবই আমার কট্টর সমর্থক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। সে মুলোওয়ার লোক, মুলোওয়া জায়গাটা এখান থেকে দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব দিকে, কুলাবির দক্ষিণে। সে বোম্বের সাহায্যে নজরানা নিয়ে দর কষাকষির সময় খুবই আমার স্বার্থ দেখত। পরের দিন, যখন আমরা কুলাবি পাড়ি দিয়ে এমভুমির দিকে যাচ্ছি, আর গোগোরা আমাদের নজরানার জন্য থামাতে যাচ্ছিল, তখন সে-ই আমাদের আরও উপশুল্ক দেওয়ার থেকে মুক্তি দেওয়ার কাজটা নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়েছিল, এই বলে যে আমরা উগোগো বা কান্যেন্যি থেকে এসেছি। তাই শুনে সর্দার কেবল মাথা নাড়ল, আর আমরা চলে গেলাম। মনে হয় যে গোগোরা যেসব কাফেলা শুধুমাত্র তাদের দেশে বাণিজ্য করতে চায়, বা তাদের নিজস্ব সীমান্ত পেরনোর কোন ইচ্ছা যাদের নেই, তাদের থেকে দেঁড়েমুশে উপঢৌকন আদায় করে না।