চতুর্থ অধ্যায়: উকড়ে, উকামি ও উদয়ের মধ্যে দিয়ে উসেগুহহা-র উদ্দেশে যাত্রা
আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করব হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। এই অধ্যায়ে বর্ণিত অভিযানের সেই অংশ যেখানে বাগামোয়ো থেকে ‘উসেগুহহা’-র রাজধানী সিম্বামওয়েন্নিতে পৌঁছোনোর কথা বলা হয়েছে। উসেগুহহা বলে কোনো স্থান বা প্রদেশ আজ আর নেই। এমনকি বোঝাও মুশকিল সেই অঞ্চলের বিস্তৃতি ঠিক কী ছিল। তবে সিম্বামওয়েন্নি নামে একটি ক্যাম্প-সাইট এখনও রয়েছে তানজানিয়ার মোরোগোরো শহরের কাছে। আন্দাজ করা যেতে পারে এই সিম্বামওয়েন্নি-র কথাই স্ট্যানলে বলছেন। সম্পাদক
বাগামোয়ো থেকে ঘণ্টা মিনিট
শাম্বা গোনেরা ১ ৩০
কিকোকা ৩ ৪০
রোসাকো ৫ ০০
কিঙ্গারু ৬ ০০
ইম্বিকি ৪ ৩০
মাসুয়া ৪ ৩০
মসুয়া থেকে ঘণ্টা মিনিট
কিসেমো ৪ ৩০
মুসসৌদি ৪ ২০
মিকেসেহ ৭ ০০
মুতাল্লেহ ৬ ৪৫
সিম্বামওয়েন্নি ৩ ০০
এই অধ্যায়টা শুরু করার আগে পাঠকদের কাছে ছোট্ট করে একটু ক্ষমা চেয়ে নেই। এই বইতে ‘আমি’র জায়গা সবার আগে। সে ঠিক যেমনটি, যেরকম আচরণ করেছে, যেমন ভাবে ভ্রমণ করেছে তাকে ঠিক তেমনই দেখিয়েছি—তার যেমন হওয়া উচিত ছিল বা যেমন আচরণ করা উচিত ছিল বা যেমন ভাবে ভ্রমণ করা উচিত ছিল তেমন ভাবে নয়। নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকার জন্য, সমস্ত ঘটনা ঠিক যেমনটা ঘটেছিল তেমনই জানিয়েছি এবং এই অভিযানের সঙ্গে জড়িত ঘটনা-দুর্ঘটনা সবই সাধ্যানুসারে লিপিবদ্ধ করে রেখেছি। তবে ঘরে বসে থাকা, আরামকেদারা-বিলাসী, ঘরের কোণই যার সবথেকে প্রিয় তেমন পাঠকেরা এই বইয়ের গুণাগুণ নিয়ে যাই বলুন না কেন, আমার পরে পূর্ব আফ্রিকাতে যাঁরা অভিযান চালাবেন তাঁরা এই বই এর সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করবে আর আমাকে সবথেকে বেশি ধন্যবাদ জানাবে; কারণ আমার ঘটনা ও দুর্ঘটনার বিবরণের মধ্য দিয়ে যে দরকারি বিষয়গুলো শেখানো হয়েছে সেগুলো তারা বুঝতে পারবে।
জাঞ্জিবারে পৌঁছানোর ঠিক পঁচাত্তর দিন পরে, ২১ শে মার্চ আমার নেতৃত্বে পঞ্চম কাফেলাটি বাগামোয়ো শহর ছেড়ে পশ্চিমদিকে প্রথম যাত্রাশুরু করল। দলের একে অপরকে চিনে নেওয়ার জন্য 'ফরোয়ার্ড' শব্দটি সংকেত হিসেবে ঠিক করা হল। আমাদের আফ্রিকান পথপ্রদর্শক, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে কিরনগোজি, আমেরিকার পতাকা উড়িয়ে কাফেলার একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কুলি, জীবজন্তু, সৈনিক আর অকর্মা লোকরা পদযাত্রার জন্য তৈরি। সভ্য জীবনের আলস্যে জীবন কাটানোর মধুর আনন্দকে আমরা দীর্ঘ বিদায় জানালাম; বিদায় জানালাম নীল মহাসাগরকে, চওড়া পথকে—যে পথ ধরে দেশে ফিরে যাওয়া যায়; সেখানে যে শত শত বিষণ্ণ দর্শক জমা হয়েছিল, যারা বার বার বন্দুক ছুড়ে আমাদের চলে-যাওয়াকে উৎযাপন করছিল, তাদেরও বিদায় জানালাম।
আমাদের কাফেলাতে ছিল কিরনগোজি বা গাইড শুদ্ধ আঠাশজন কুলি; ক্যাপ্টেন এমবি বোম্বের অধীনে বারোজন সৈন্য, সতেরোটি বোঝা-সমেত গাধা; গাধা, গাড়ি, মালপত্রের দায়িত্বে থাকা আমার দোভাষী সেলিম; একজন রাঁধুনি এবং বদলি লোক, যে আবার সকলের দর্জি ও হাতে হাতে সাহায্য করার লোকও বটে; আর পাঁশুটে ঘোড়ার সামনে সামনে চলেছে শ, একসময় যে জাহাজের মেট ছিল, এখন সে বাহিনীর পশ্চাদভাগের রক্ষী আর সেইসঙ্গে কাফেলার তত্ত্বাবধায়কও বটে। শ চলেছে একটা ভালো গাধার পিঠে চড়ে, মাথায় একটা ক্যানোর মতো টুপি আর পায়ে একটাসি-বুট। আর সব শেষে আমি, এই অভিযানের অগ্রদূত, প্রতিবেদক, চিন্তাবিদ এবং নেতা। বানা মকুবা নামের একটি দুর্দান্ত পিঙ্গল রঙের ঘোড়ার পিঠে চড়ে চলেছি। ঘোড়াটা আমাকে মি. গুডহু উপহার দিয়েছিলেন। আমার লোকেরা আমাকে ‘বড়ো সাহেব’ বলত।
কাফেলার বেশ কয়েকজন সদস্য এর মধ্যেই আমার বেশ চেনা। তাদের ভালো করে খতিয়ে দেখেশুনে পছন্দ করা হয়েছে। এখনও অবধি তাদের কোনো দোষ খুঁজে পাওয়া যায়নি; তবুও, এখনই তাদের চরিত্র নিয়ে কথা বলতে বসলে সেটা বোধহয় একটু বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে। কাজেই এখন বরং শুধু প্রধান লোকদের ক্রমানুসারে নাম আর পদমর্যাদাগুলো বলি।
১. জন ডব্লিউ শ, পশ্চাদরক্ষীও তত্ত্বাবধায়ক
২. মোবারক বোম্বে, সৈন্যদের অধিনায়ক
৩। উলেদি (স্পেকের নিজস্ব খানসামা) সার্জেন্ট
৪. মাবরুকি (বার্টনের নিজস্ব খানসামা), তাঁবু-প্রহরী
৫. মাবরুকি দি লিটল, সৈনিক
৬. এম. মাবরুক সলিম, সৈনিক
৭. জায়েদি, সৈনিক
৮. কামনা, সৈনিক
৯. সরমীন, সৈনিক
১০. ফেরাজ্জি (এ স্পেকের বাহিনী থেকে পালিয়েছিল), সৈনিক
১১. কিঙ্গারু, সৈনিক
১২. আম্বারি, সৈনিক
১৩. সেলিম (জেরুজালেমের ছেলে), আরব দোভাষী
১৪. বন্দর সালাম (মালাবারের), রাঁধুনি
১৫. আবদুল কাদের, দর্জি ও সাহায্যকারী
১৬. হামাদি (ওয়াংওয়ানা), কিরনগাজি
১৭. সরবোকো, কুলি
১৮. জাফুনে, কুলি
১৯. ফারজাল্লা, কুলি
২০. খামিসি, কুলি
২১. আসমানি, কুলি
২২. চাম্বা, কুলি
২৩. শুবাড়ি, কুলি
২৪. মাকোরিগা, কুলি
২৫. খানাইস, কুলি
হয়তো উপরে বর্ণিত এইসব লোকেরা এমন কিছু অভ্যাস অর্জন করবে বা উন্যানয়েম্বে যাওয়ার পথে তাদের স্বভাবের বিষয়ে আমি যেমনটা ভেবেছি, তার থেকে অনেক আলাদা রূপ দেখাবে। তাবোরায় পৌঁছব যখন, তখন হয়তো আমরা এদের বিষয়ে আরও ভালো করে বুঝতে পারব। সেখানে একটা সাধারণ তালিকা তৈরি করা হবে। সব কিছু পরিদর্শন করা হবে আর আমাদের আগে রওনা দেওয়া চারটে কাফেলার প্রতিবেদনও শোনা হবে। সব মিলিয়ে যেদিন আমরা রওনা হলাম, সেদিন দলে রয়েছে তিনজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, তেইশ জন সৈন্য, চার জন অতিরিক্ত লোক, চারজন প্রধান, এবং একশো তেত্রিশজনকুলি, সাতাশটা গাধা আর একটা গাড়ি। মাল বলতে সঙ্গে রয়েছে কাপড়, পুঁতি, ও তার, নৌকার সরঞ্জাম, তাঁবু, রান্না করার পাত্র ও থালা-বাসন, ওষুধ, বারুদ, ছোটো শট, গাদা-বন্দুকের গুলি এবং ধাতব কার্তুজ; যন্ত্রপাতি আর অজস্র ছোটো ছোটো প্রয়োজনের জিনিস, যেমন সাবান, চিনি, চা, কফি, লাইবিগের মাংসের নির্যাস, শুকনো মাংস, মোমবাতি ইত্যাদি ইত্যাদি, সব মিলিয়ে ১৫৩ পাউন্ড মাল। প্রতিরক্ষার জন্য এই অভিযানে যে অস্ত্রগুলি নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে আছে একটা দোনলা ব্রিচ-লোডিং (নলের পিছন দিক দিয়ে গুলি ঢোকানো) মসৃণ-নলের বন্দুক; একটা ষোলো-ঘরার আমেরিকান উইনচেস্টার রাইফেল; একটা ষোলো-ঘরা হেনরি রাইফেল; দুটি স্টার কোম্পানির ব্রিচ-লোডার, একটি জসেলিন ব্রিচ-লোডার, একটা হাতিমারার রাইফেল, সেটা ১/৮ পাউন্ড ওজনের গোলা ছোঁড়ে; দুটো ব্রিচ-লোডিং রিভলবার, চব্বিশটা ফ্লিন্ট-লকওলা গাদাবন্দুক, ছটা একনলা পিস্তল, একটা যুদ্ধ করার কুড়াল, দুটো তরোয়াল, দুটি ছোরা (পারস্যের কুমার, শিরাজে আমি নিজে কিনেছিলাম), একটা শুয়োর-মারার বর্শা, দুটি চার পাউন্ডের আমেরিকান কুঠার, চব্বিশটা ছোটো কুঠার (হ্যাচেট) আর চব্বিশটা কসাই-এর ছুরি।
অতি যত্নে অভিযানের আয়োজন করেছি। যা কিছু প্রয়োজন তার কোনো কিছুতেই কোনো কিপটেমো করা হয়নি, সবই জোগাড় করা হয়েছে। খুব তাড়াহুড়ো করা হয়নি, নিজেদের সংগতি আর দক্ষতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, কালবিলম্ব না করেই দ্রুত সবকিছু কেনা, তৈরি করা, জোগাড় করা ও গোছানো হয়েছিল। এরপর যদি তাড়াতাড়ি উজি যাওয়া ও ফিরে আসার কাজটি সাধিত না হয়, তাহলে সেটা নেহাতই নিয়ন্ত্রণের অতীত দুর্ঘটনা। অভিযানের লোকজন, উদ্দেশ্য নিয়ে এখন এইটুকুই বলা থাক যতক্ষণ না অভিযানের মূল লক্ষ্যে পৌঁছাই...
খুবই ধুমধাম করে বাগামোয়ো ছেড়ে বেরোনো হল, অজস্র কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে। তারপর পথ চলা এক সরু রাস্তায় দল বেঁধে। সে পথের ধারে দুই সমান্তরাল রেখায় গজানো মিমোসার ছায়ায় আঁধার ঘনিয়ে এসেছে... সবারই ভারী খোশমেজাজ। সৈন্যরা গান গাইছিল, কিরণগোজি ভয়ানক জোরে চেঁচাচ্ছিল আর আমেরিকান পতাকাটি দোলাচ্ছিল, পথের পাশের লোকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিল, “দ্যাখো, দ্যাখো একজন মুসুনগুর কাফেলা!”
আর আমার মনে হচ্ছিল যে আমার বুকটা এতই ধড়ফড় করছে যে একজন নেতার শান্ত মুখের পক্ষে তা নেহাতই বেমানান। নিজেকে সামলাতেও পারছিলাম না; বহু দেশবিদেশে ঘোরা সত্ত্বেও যৌবনের উত্সাহ এখনও আমাকে জড়িয়ে আছে—পূর্ণ স্বাস্থ্যের দীপ্তিতে আমার নাড়ির রক্ত টগবগিয়ে ছুটছে; দু-মাস ধরে যে সব সমস্যা আমাকে কাঁটার মতো বিঁধছিল, সেগুলো সব পিছনে পড়ে রইল। ওই হিন্দির পাজি ছেলে, সুর হাডজি পাল্লুকে শেষ কথা আমিই বলেছি। আরব, বানিয়া ও বালুচদের দিকে, ওই বিচ্ছিরি জনতার দিকে শেষবার তাকিয়ে নিলাম; ফরাসি মিশনের জেসুইটসের থেকে বিদায় নিলাম। সামনে দ্রুত পশ্চিমগামী সূর্য ঝলমলে আলো ছড়াচ্ছে, কতই না প্রতিশ্রুতি লেখা আছে সেই আলোয়। সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে চারিপাশে... উর্বর খেত, ফলে-ফুলে ভরা গাছপালা, অদ্ভুত অদ্ভুত গাছ—ঝিল্লিরব আর তিতিরের ডাক ভেসে আসছে, আরও কত পোকামাকড়ের হিসহিস শব্দ—সবাই যেন আমাকে বলছে, “যাক, শেষ পর্যন্ত শুরু করলে!” ঝকঝকে বিমল আকাশের দিকে মুখ তুলে ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ দেওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করা যায়!
প্রথম শিবির, শাম্বা গোনেরাতে, ৩১/৪ মাইলের সমান পথ, আমরা এক ঘণ্টা তিরিশ মিনিটে পৌঁছেছি। এই প্রথম বা ‘ছোট্ট যাত্রা’ খুব ভালোভাবে হয়েছিল, আইরিশরা যেমন বলে, ‘সব কিছু বিবেচনা করে’। সেলিম নামের ছেলেটি তিনবারের বেশি গাড়ি উলটায়নি। যে গাধাটা আমার জামাকাপড়ের একটা ব্যাগ আর এক বাক্স গোলাবারুদ নিয়ে যাচ্ছিল, সৈনিক জায়েদী মাত্র একবার তাকে কালো জলের ডোবায় ফেলে দিয়েছিল। কাপড় আবার ধুয়ে নিতে হবে; আর গোলাবারুদের বাক্স, আমার ব্যবস্থার জন্য, জলরোধক ছিল। কামনা মনে হয় গাধা চালাতে জানত, তবে রওনা হওয়ার আনন্দে, খুব সম্ভবত একটি খাঁটি রাসভ গোত্রের জন্তু সামলানোর সাধারণ অসুবিধাগুলো ভুলে গিয়েছিল, যেমন তারা সঠিক রাস্তা চেনে না, ম্যানিওকের খেতের অনেক ভিতরে পালিয়ে যাওয়ার লোভ তারা সামলাতে পারে না, আর চালকরা যে প্রচলিত প্রথামত পশুর নাকের সামনে লাঠি ঝুলিয়ে দেয়, সে তো আর গাধারা জানে না বা তারা কোন্ দিকে যে যেতে হবে তাও বোঝে না, ফলে যে দিকে যাওয়ার দরকার তার উলটোদিকের রাস্তা ধরে পুরোদমে ছুটে যায়, যতক্ষণ না তার পিঠের বোঝাটি টলর-বলর করে আর সে আহ্লাদে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে এই ঘটনাগুলো ফালতু, কোনো গুরুত্বই নেই—পূর্ব আফ্রিকার প্রথম ‘ছোটো ভ্রমণ’-এ এসব স্বাভাবিকই ছিল।
সৈন্যদের চরিত্রের কথাটা একটু বলেই ফেলি। দেখা গেল, বোম্বে সৎ ও বিশ্বাসযোগ্য, তবে কিছুটা ঢিমে তালে চলে... উলেদি কাজের চেয়ে বেশি কথা বলে; আর সেই পালিয়ে-যাওয়া ফেরাজ্জি এবং অকেজো-হাতের মাবরুকি বার্টন দেখা গেল সাচ্চা মরদ আর ভারী পোক্ত, যে পরিমাণ মাল তারা বইত সে দেখলে হাট্টা-কোট্টা স্টাম্বুলের লোকেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারত।
জিনগুলো দারুণ ছিল, যেমন চেয়েছিলাম তার থেকেও অনেক ভালো। শক্ত শণের ক্যানভাস একশো পঞ্চাশ পাউন্ডের ওজন ষাঁড়ের চামড়ার মতোই পোক্ত ভাবে ধরে রেখেছিল, এবং বিভিন্ন মালপত্রের ওঠানো-নামানোর কাজটা বেশ সুসম্বদ্ধভাবে তাড়াতাড়ি করা হচ্ছিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে, আফসোস করার কিছুই ছিল না—আমাদের অভিযানের সাফল্যই প্রমাণ করে যে আমাদের যাত্রা শুরু করাটা মোটেই প্রয়োজনীয় সময়ের আগে করা হয়নি।
দীর্ঘ স্থলযাত্রার জন্য আমাদের প্রস্তুতি শেষ করতে, আসন্ন বর্ষা ঋতুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করতে আর হিসেবপত্র মেটাতে পরের তিন দিন গেল। সৈন্যরা, কুলিরা এই সুযোগে তাদের মেয়েবন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেল; তবে আমি কোনো কেলেংকারি করতে কড়া মানা করে দিয়েছিলাম।
শাম্বা গোনেরা মানে গোনেরার মাঠ। গোনেরা একজন ধনী ভারতীয় বিধবা, ওয়াসুঙ্গু মানে শ্বেতাঙ্গদের সে ভালোচোখেই দেখে। আফ্রিকার সুদূর অভ্যন্তরে সে প্রচুর কাপড়, পুঁতি, তার রফতানি করে। আর বদলে নিয়ে আসে অনেক অনেক হাতির দাঁত। তার বাড়িটা শহুরে বাড়ির আদলে তৈরি, দীর্ঘ ঢালু ছাদ, প্রসারিত ছাঁচের তলায় শীতল ছায়া—সেখানে কুলিরা বিশ্রাম করতে ভালোবাসে। এর দক্ষিণ ও পূর্বদিকে বিস্তৃত চাষের জমি, এখান থেকেই পূর্ব আফ্রিকার প্রধান শস্য, জোয়ারের সরবরাহ হয় বাগামোয়োতে। বাঁ দিকে চাষ হয় ভারতীয় ভুট্টা আর মুহোগো, সাদাটে রাঙা-আলু জাতীয় মূল, কেউ কেউ একে ম্যানিওকও বলে; শুকিয়ে গেলে, একে গুঁড়ো করে কেকের মতো বানান হয়, অনেকটা সেনাবাহিনীর স্ল্যাপজ্যাকের মতো। বাড়ির ঠিক পেছনে উত্তরদিকে, একটি কালো খাল এঁকেবেঁকে যাচ্ছে, একটি সর্পিল খাদ। খাদের গভীরতম অংশে সবসময় জল থাকে—সেখানে নোংরা জটলা-বাঁধা জলজ-ঘাসের ঝোপের মধ্যে ‘কিবোকো’ বা হিপ্পোপটেমাসের বাড়ি। খালের পাড় বেঁটে বেঁটে তাল গাছ, লম্বা উলুখাগড়া, বাবলা, টাইগার-ঘাসে ভরা। সেখানে অসংখ্য জলজ পাখি, পেলিকান ইত্যাদির বাস। উত্তর-পূর্ব দিকে খানিক গিয়ে, এটা কিঙ্গানির সঙ্গে মিশেছে। সে নদী গোনেরার বাড়ির চার মাইল দূরে পূর্ব দিকে বেঁকে সমুদ্রের দিকে ছুটেছে। পশ্চিমে, মাইল খানেক চাষ-জমির পরে, পুরোনো সব সমুদ্রসৈকত। লম্বা লম্বা ঢেউ এসে পড়ছে আবার পিছু হটছে, মাথা তুলেছে বুনো ঘাস আর নলখাগড়ার ঘন বন। এই ঠেলে-ওঠা জমির পিঠের ওপর প্রচুর আবলুস, ক্যালাব্যাশ ও আমগাছ হয়।
(ক্রমশ... পরের অংশ পড়ুন আগামী বৃহস্পতিবার)