ইছামতী তীরবর্তী বনবাংলার আখ্যান
পুরুষোত্তম সিংহ
পাঠকের জন্য পড়া ও শোনা দুই আয়োজনই থাকছে। লেখার শেষে ইউটিউব লিংক রইল। পড়তে না চাইলে শুনতে পারেন।
বাঙালি ঔপন্যাসিকের জীবনদর্শনকে, লৈখিক সূত্রকে নানা প্রকরণে ভাগ করা যায়। বলা ভালো লেখকরা নিজেরাই আত্মজবানবন্দিতে সে কৈফিয়ত দান করে কাজ অনেকটাই এগিয়ে রেখেছেন। সেখানে বিভ্রান্ত যুক্তিও কম নেই। কারো কাছে যথার্থ বাস্তব, ভূগোল চিহ্নিত বাস্তব অপ্রয়োজনীয়। তাদের কেউ কেউ প্রকৃতপক্ষে গ্রাম বাংলার জীবনচরিত থেকে অনেক দূরে থাকেন। আবার কেউ কেউ ভূগোলের প্রত্যক্ষ স্বরকে নানা ভঙ্গিতে নানা বিভঙ্গে বাজাতে সক্ষম। এমনকি অবস্থান সেই প্রান্তজীবনেই। আখ্যানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞানের স্বচ্ছতাকে অস্বীকার করা যায় না। আখ্যানের চরিত্রের সঙ্গে লেখকের অবস্থান যদি একই সমাজ জীবনে হয় তবে তার স্বতঃস্ফূর্ততা অনেক বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। কথাসাহিত্যিক অমিতকুমার বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একথা আরো আরো বেশি করে সত্য কেননা তার প্রত্যহ দিনলিপি মিশে আছে ইছামতী সংলগ্ন বনগ্রামের আলসে বিলপাড়ে। নিত্যভ্রমণরত ইছামতীর বিল, চর, মাঠঘাট, পথ প্রান্তরের মানুষকে তিনি নিশ্বাসের মতো চেনেন। সেই প্রান্ত গ্রামবাংলার নিজস্ব সুর-স্বরকে তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। বলা ভালো সেই প্রান্তের ভাষা সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস, রুচি, বসনভূষণ, দরিদ্রতা, ফসল, চাষবাস, যৌথ জীবন, ভাঙনসহ মেঠোবাংলার রসাভাষ এক অনুভূতির স্পন্দনে আখ্যানে ভেসে আসে। মান্য বাংলাকে প্রায় অস্বীকার করে আঞ্চলিক বাংলার সজ্জায় তিনি বিন্যাস্ত করেছেন ‘পাঁচকুড়ুনির মা’ (২০২১) আখ্যান। ভাষার ভদ্রলোকী মধ্যবিত্ততাকে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই ধসিয়ে দেন। লোকায়ত বাংলার স্বাভাবিক প্রাণস্পন্দনকে ধরে রাখতে নেমে গিয়েছেন অন্ধকার বৃত্তে, প্রান্তিকতার সুঘ্রাণে। ভদ্রলোকী যুক্তিতর্কের ধার না ধেরে লোকায়ত বাংলার মুখের ভাষায় যে আপাত খিস্তি খেউড় ঝুলে থাকে তা শুধু জীবনের আর্তনাদকেই ব্যক্ত করে না সর্বহারা মানুষের ক্লেদ, দ্রোহকেও চিহ্নিত করে নির্ভেজাল বয়ানে।
ইছামতীর অজস্র বাঁকে অজস্র মানুষ। বিল, হাওড়, মরা নদীর বাঁকে বাঁকে ইতিহাস নীরবে কথা কয়। মাটির তলায় অজস্র কিংবদন্তি, লোকগাথা, লোককথা। এখানে কিংবদন্তি ভেসে চলে। নিসর্গপ্রকৃতির মূর্তিমান বিগ্রহে জাতি ধর্ম মিলে বিচিত্র মানুষের সম্মিলন। বাগদি, চাঁড়াল, মালো, নিকারি, সর্দার সকলের জাতি পরিচয়ের ঊর্ধ্বে অভাব জীবনের ধর্ম হয়ে ওঠে। উদ্বাস্তু মানুষ মুখের ভাষা হারিয়ে কেবল ধর্মাচারে, লোকাচারে অভ্যাসে বেঁচে আছে। মোড়ল, মাতব্বর কম নেই। জমির চরিত্রও আলাদা আলাদা। অজস্র গাছপালা, পাখি, মাছ, ফসল নিয়ে এক মায়াময় বিচ্ছুরণ। এই নিসর্গ প্রকৃতিকে অমিতকুমার বিশ্বাস আন্তরিক সুরে বুনেছেন। অন্ত্যজ মানুষের জীবনসত্যকে ভাসিয়ে দিয়েছেন মহাকালের তরণীতে। নদী এখানে সচল নয়। কোথাও পানাপুকুরে ডুবে গেছে, কোথাও মৃত, কোথাও জলাভূমি, কোথাও চাষাভূমি হয়ে গেছে। সেখানে নিত্য ভ্রমণরত পাঁচি, বুঁচি, বুদো, উদো। আলসে বিলের জনমানুষ নিঝুম শান্ত নিরালা। গায়ে গতরের ভাষায় আঞ্চলিক সুরে বাক্যালাপ চলায়। ছড়া, প্রবাদ, লোকশ্রুতিতে গল্পে মাতে। জাতি ক্রোধও কম নেই। প্রান্ত বাংলার নিজস্ব সুরকে চিনিয়েছেন লেখক। ইছামতীর বাংলার যে গড়ন ভড়ন, সংস্কৃতি, মেঠো সুর, জীবনের ঘ্রাণ তা জলজ দর্পণে নির্মাণ করেছেন লেখক। সেখানে এত সুর, এত প্রাণবৈচিত্রে ভরপুর ভেবে বিস্মিত হতে হয়। লেখকের যথার্থ পর্যবেক্ষণ, জনমানুষ সম্পর্কে আন্তরিকতা, জীবনের জটিল কুজ্ঝটিকাকে ব্যক্ত করার নিরলস প্রয়াস ও মেঠো বাংলার ক্রমাগত তিমিরাভিযানের ফসল ‘পাঁচকুড়ুনির মা’ উপন্যাস। জনপদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সত্যকে তিনি টেনে ধরেছেন। বৃত্তের বাইরে থাকা নিসর্গ মানুষের অবিরাম চলাফেরা, কর্ম, ভাষা সংস্কৃতির প্রাণপ্রাচুর্যে তা ভরপুর। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে জীবনের শিক্ষায় এরা শিক্ষিত। নাগরিক চোখে সেই লোকমানুষ হয়ত অন্ত্যজ বর্জিত। কিন্তু অমিতকুমার বিশ্বাস আন্তরিক অনুভূতিতে, জীবনের দীপ্ত তেজে, জন্মভূমির মাটি মানুষের অকৃত্রিম ফল্গুধারায় এক মায়াবী ভুবন রচনা করেন। লোকগান, ছড়া, প্রবাদ, কিংবদন্তি, ইতিহাস মিলে জীবনের সুর এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় অভিজ্ঞতার দর্পণে, জীবন বাস্তবের প্রত্যক্ষ মুন্সিয়ানায়। বয়ানে শুনতে পাই—
“হেরে-যাওয়া মানুষ তো হেরে-যাওয়া নয় আর। বরং জিতে-যাওয়া মানুষই গোহারা হেরে থাকে জীবন থেকে। সে মুখে স্বীকার করে না ঠিকই। হেরে-যাওয়া মানুষের আনন্দবোধই আলাদা স্বাদের। এই সামান্য নেচেগেয়ে কাটানো মুহূর্ত ওঁদের জীবনশক্তি দেয় ভরপুর। অভিজাত সমাজ বলে, “এসব আদিম। ওঁদের শিক্ষা দাও।” কিন্তু কোন শিক্ষা দেবে? বাংলার জল-মাটি-বাতাসে ছড়িয়ে থাকা চিরায়ত ছড়া-ধাঁধা-সংগীত-যাত্রা-ভাসান ছেড়ে কেরানি-মার্কা কোন সে-শিক্ষা? অভিজাতরা রে রে করে তেড়ে ওঠে, বলে, “গণ্ডমূর্খ! বোঝো না বাস্তব শিক্ষা?” কিন্তু মানবজীবনে ‘বাস্তব’ কথাটি বড়ই গোলমেলে যে! কল্পনা ও বাস্তবতার ভিতর কোনটা বাস্তব থেকেও বেশি বাস্তব, বলবেন স্যর?” (পাঁচকুড়ুনির মা, অমিতকুমার বিশ্বাস, কবিতা আশ্রম, প্রথম প্রকাশ, মার্চ ২০২১, পৃ. ৩৪-৩৫)
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ইছামতী’ উপন্যাসে যে গ্রাম বাংলা, জনপদজীবন, মানুষের জীবন জীবিকা, নিসর্গ প্রকৃতি, শোষণ নিপীড়নের কথা ব্যক্ত করেছিলেন তা সত্তর বছর পরে কেমন আছে, কতটা বদলে গেছে তার খোঁজ নিতে গিলে দারস্থ হতে হয় এ আখ্যানের। বিভূতিভূষণের বনবাংলা পরবর্তীকালে বাংলা উপন্যাসে নানা তরঙ্গে ছড়িয়ে গেছে। নলিনী বেরার ‘শবরচরিত’ উপন্যাসে সুবর্ণরেখা তীরবর্তী জঙ্গলের মানুষ, জঙ্গলনির্ভর লোধা, শবরদের বিচ্ছুরণ। দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘তিস্তাপুরাণ’ উপন্যাসে তিস্তা সংলগ্ন জনপদসহ নিসর্গ সংলগ্ন মানুষের জীবন জীবিকার কথা। সমরেশ মজুমদারের লেখায় চা বাগান সংলগ্ন জনজাতি, প্রান্তিক মানুষের কথা। ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় সুন্দরবন সংলগ্ন নিসর্গ প্রকৃতি ও জনপদ-জীবন-জীবিকার কথা নির্মিত হয়েছে। নলিনী বেরা যেমন রাইবু, শিশুবালা, সোমবারি, নামালিয়াদের জঙ্গলে ভাসিয়ে দিয়েছেন অমিতকুমার বিশ্বাসও পাঁচি, বুঁচিদের ইছামতী সংলগ্ন বদলে যাওয়া মানচিত্রের নিসর্গে ভাসিয়ে দিয়েছেন। সেখানে কত লোকখাদ্য, কত গাছপালা, লোকওষুধ, খালবিল, ফসলের ভেষজ গন্ধ, নদীঘাট ও রাজনীতির শোষণ নিয়ে এক রঙিন স্বপ্নভূমি। সর্বস্বহারা, ব্যথিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষ আপনতালে আপনজলে উতালা বাতাসে ভেসে ভেসে যায়। অহংকার, অভিমান নয় জীবনের তেজে এরা কেবলই দোল খায়। ছিটকে গিয়েও বাসভূমি সংলগ্ন নিসর্গে মিশে শান্তি খোঁজে। বড় আশ্চর্য এই নিকেতন। আর তার আশ্চর্য শিল্পী অমিতকুমার বিশ্বাস।
সেদিন ছিল নীলকরদের শোষণ আজ আছে রাজনীতির চেলা চামুণ্ডা, গ্রামীণ মাতব্বরদের শোষণ। ব্যক্তি অধিকার, অভিরুচি সেদিনও খর্ব হয়েছে, আজও হচ্ছে। ব্যর্থ লড়াই চালিয়ে যায় পাঁচিদের মতো প্রান্তিক যোদ্ধরা। পাঁচি কিছুটা খ্যাপাটে, মুখরা, জেদি, আপনতালে ভাসমান। অভাব এই স্বভাবের জন্য দায়ী। আর পাঁচজন মেয়ে থেকে পাঁচি আলাদা। পুরুষতান্ত্রিক শোষণ, সমাজকে সে মুখ ঝামটা মেরে ফেলে দিতে পারে। রক্তচক্ষু শোষণ, প্রভাবশালী পুরুষ, বলদর্পী ক্রোধের বিরুদ্ধে একাই বাক্যুদ্ধে সচল। মুখের ভাষায় অবিরাম খিস্তি খেউর, ছড়া কেটে ব্যঙ্গ শ্লেষে ভরিয়ে দিতে পারে। যেহেতু একটু খ্যাপাটে, বিদঘুটে লোকমানুষ পিছনে লাগেও। জনপদের শান্ত নিরালা নির্জন নিসর্গে সে যেন স্বদোম্ভী, অস্থির, চঞ্চল, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। গোটা পাড়াগাঁকে একাই মাথায় তুলে রাখে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃন্ময়ীর সঙ্গে পাঁচির প্রভেদ আছে। জীবনের প্রাত্যহিক সত্য বালিকাকে জটিল করেছে। ভাষাযুদ্ধে সে প্রান্তিকতাকে যেমন বহন করে তেমনি জীবনের ক্লেদ, দ্রোহকে খিস্তিতে উড়িয়ে দেয়। অমিতকুমার বিশ্বাস ন্যাচারালিস্ট শিল্পী। শিল্পের জন্য তিনি কিঞ্চিত আপস করেননি। বরং জীবনকে অকৃত্রিমভাবে শিল্পের আঙিনায় উপস্থিত করেছেন। জীবনশিল্পের যুগপৎ মিলনে ‘পাঁচকুড়ুনির মা’ হয়ে উঠেছে প্রান্ত বাংলার বহুস্তরীয় আখ্যান। পটভূমির সত্য, জীবনের সত্য, ইতিহাসের সত্য, লোকমানুষের অভাব-অভিযোগের সত্যে তা দ্বন্দ্বময় জীবনের দীর্ঘস্থায়ী যাপনক্রিয়াকে যে ভাষায়, যে বয়ানে ব্যক্ত করে তা মেঠো বাংলার নিজস্ব সম্পদকে চিনিয়ে দেয় কানায় কানায়।
বনভূমি ছিল অন্ত্যজ মানুষের নিজস্ব অধিকারে। নলিনী বেরার ‘শবরচরিত’ আখ্যানে দেখেছি বনভূমি প্রশাসনের হাতে চলে যাওয়ায় লোধা, শবরদের জীবন, জীবিকা কীভাবে সংকটের মুখে পড়ে যাচ্ছে। অমিতকুমার বিশ্বাসের ‘পাঁচকুড়ুনির মা’ উপন্যাসেও পাঁচিদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বনভূমি স্থানীয় মহাজনদের দখলে গিয়ে তা খাস জমিতে পরিণত হবে। নলিনী বেরা যেখানে গোষ্ঠীর জীবনচিত্রে সেই সংকটকে দেখেছেন অমিতকুমার বিশ্বাস দেখেছেন ব্যক্তির বয়ানে। নলিনী বেরা বৃহৎ ফ্রেমে, অমিতকুমার বিশ্বাস ক্ষুদ্র ফ্রেমে। এ আখ্যানে মায়াভরা এক বেদনা আছে। মেঠোবাংলার জীবনক্রিয়া ভেসে গেছে নিসর্গের ছন্দে। ব্যক্তি মানুষ, গোষ্ঠীর মানুষের জীবনলীলাকে লেখক ভাসিয়ে দিয়েছেন ইছামতীর মৃদুমন্দ স্থির গতির মতো। নিসর্গ থেকে বিচ্ছন্ন করলে এ মানুষ আর বাঁচে না, প্রাণস্পন্দন থাকে না। নিত্য অভাবের মধ্যে সামান্য আয়োজনেই এ মানুষ বয়ে যায় মহাকালের কণ্ঠে। ভাষাছাঁদের হরেকরকম মুন্সিয়ানা আখ্যানকে কাব্যিক সৌন্দর্যে যেমন ভাসিয়েছে তেমনি জীবনের অনিয়ন্ত্রিত বিন্যাসে আখ্যানের গতিতরঙ্গ আলতো আঁচেই নির্মিত করে ভাঙনের অমাবস্যাকে। কর্পোরেট পুঁজি, ভোগবাদ, আগ্রাসী সভ্যতা ও মূল্যবোধহীনতায় মানুষের কাছে বাংলার মেঠো সুর হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ যার মধ্যে ছিল প্রকৃত বাংলা। মৃদু বয়ানে শুনতে পাই—
“আসলে এই গানের কোনও শুরু নেই, শেষ নেই। সুরের ভিতর গ্রামবাংলার ব্যথাপুঞ্জরা মহাশূন্যের আকাশগঙ্গায় ভেসে থাকে, বেঁচে থাকে। এখানে মাঝির কণ্ঠে গান, চাষার কণ্ঠে গান, গাড়োয়ানের কণ্ঠে গান, ভিখারির কণ্ঠেও গান। সামান্য ক্ষুধা নিবৃতির জন্যও মুঠো মুঠো গান ছড়ায়, গান বোনে বাংলার আবহমান মানুষেরা। এই মাটি ভর্তি গান পুড়িয়ে-পুড়িয়ে দু-একটি হাঁড়ি-পাতিল বানানোর খুব প্রয়োজনীয়তা ছিল এককালে। কিন্তু আজ মানুষের রাক্ষুসে-ইচ্ছেতে যেভাবে পুড়ে যাচ্ছে লাখ লাখ বছরে তৈরি হওয়া মাটি ও মাটিগান, তাতে এই নির্মোহ প্রকৃতি কতদিন মানুষের এই ঔদ্ধতা-অবধ্যতাকে ক্ষমা করে যাবে? বুক পুড়ে যাওয়া কণ্ঠ, সুখ পুড়ে যাওয়া গান আমাদের পুড়ে যাওয়া জীবনের ভিতর উঁকি মারলে কিছু কি আর পড়ে থাকে? শরীর ও চিতাকাঠ মিশে গেলে নাভিমূল পিণ্ডাকারে ছাই মেখে গড়াগড়ি খায়। জলকসি ভেঙে তাকে শীতল করবে কারা?” (তদেব, পৃ. ৬৬-৬৭)
শুধু চরিত্রের ক্লেদ, বিষণ্ণতা, অভিমান নয় লেখকের দ্রোহসত্তাও কম নেই। চরিত্রের ক্লেদ, বিষণ্ণতা, যন্ত্রণা স্পষ্ট আকারে ব্যক্ত হলেও লেখকের দ্রোহসত্তাকে ধরা যায় না। তা তিনি ভাসিয়ে দেন কাব্যিক সুরে মহাকালের বৃহত্তর সত্যে। এই মায়াভরা বাংলা ঔপনিবেশিক কাল থেকে লুঠ হয়েছে। আজ সেই ভাঙনের পালে হাওয়া লেগেছে। একজন স্বদেশমাতার সন্তান হয়ে, স্বজনভূমির রক্ষাকবদ গায়ে তুলে লেখক কী করবেন? কখনো আক্ষেপের মালা ঝুলে থাকে নিত্যকালের ছন্দে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ উপন্যাসের গয়ামেম চরিত্রকে ঘিরে এখানে অনেক মিথ, ইতিহাস, লোকশ্রুতি। গল্পগাথাও কম নেই। পণ্ডিতবৃত্তের ইতিহাসকে অতিক্রম করে লোক ইতিহাসের আড়াল দিয়ে জনপদ ঔপনিবেশিকতার অত্যাচার সম্পর্কে পরিচিত হয়। সেই বৃহত্তর বনবাংলা আজ নানা মাতব্বর, পুঁজিবাদ, মাফিয়াদের কবলে চলে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের আবেগ আছে, বেদনা আছে, কিন্তু প্রতিরোধের কোনো বুনিয়াদ নেই।
‘পথের পাঁচালী’র অপু-দুর্গার মতো এ আখ্যানের পাঁচি সঙ্গীসাথী নিয়ে বনে জঙ্গলে, জনপদে নিত্য ভ্রমণরত। তবে ‘পথের পাঁচালী’র সামাজিক ভিত্তি থেকে এ আখ্যানের সামাজিক ভিত্তি পৃথক, যদিও অর্থনৈতিক ভিত্তির তেমন তফাত নেই। ভাষাগত বদল আছে। জীবনবিশ্বাসের সহজিয়া সুর এখানে জীবনের চড়াই উতরাইয়ে ধাক্কা খেয়েছে। সেদিন দরিদ্রতা ছিল, ঔপনিবেশিক শাসন থাকলেও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের খুব বেশি ছাপ ছিল না। আজ আর্থ-সামাজিক অবস্থান বদলে গেছে। স্বাধীন দেশেও শ্রেণিশোষণ অব্যাহত। ছোট ইংরেজদের নব্য সংস্করণ পুলিশ, মহাজন, মাতব্বর, রাজনৈতিক নেতা প্রত্যকেই শোষণে ওস্তাদ। এমনকি প্রান্তজনের অধিকারকে প্রতিমুহূর্তে ছিনিয়ে নিচ্ছে। অবধারিতভাবে প্রান্তজনের মুখের ভাষাও বদলে গেছে।
অমিতকুমার বিশ্বাস আধুনিক সময়ের জটিল রসায়নকে তীব্র কষাঘাতে ছিন্নভিন্ন করেছেন। ইতিহাসের পদধ্বনিকে সঙ্গী করে লোকবাংলার অপরূপ ঐশ্বর্যকে মন্থন করতে করতে জীবনের প্রত্যাঘাত নির্মাণ করে চলেন। ভাষার বিবিধ ছাঁদে বাজিমাত করেছেন লেখক। প্রান্তজনের মুখে আঞ্চলিক সংলাপ, মধ্যবিত্তের মুখে সাধারণ বাংলা ও লেখকের বর্ণনায় আবেগাত্মক কাব্যধর্মী সুরেলা ভাষা আখ্যানকে বহুস্বরে নিয়ে গেছে। গয়ামেমের পরগণা, মোল্লাহাটি ক্রমেই ব্যক্তি মালিকানায় ঢুকে যাচ্ছে। সেখানে লড়াই দিয়ে এসেছে সরেন সর্দারের বংশধররা। ঐতিহ্যসহ ইতিহাসকে বাঁচানোর লড়াই। পুঁজিবাদের বিকাশে নয়া সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লোকমানুষের ইস্তেহার। হ্যাঁ জেল, মৃত্যু ঘটেছে তবুও লড়াইয়ে সামিল পাঁচি। এন.আর.সি, মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়ার কৌশল, উদ্বাস্তুদের নিপীড়ন, চোখে ক্রোধ ও দেহকে তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এক নারীর অপরাজেয় ভাষ্য এ আখ্যান। পল্লিগীতের সুরে, বিবিধ লোকগানের ভাসমান জোয়ারে, ইছামতীর বাঁকে বাঁকে মৃদুমন্দ বাতাসে জীবনের ক্রোধী আর্তনাদ মিশে গেছে কাল থেকে মহাকালে।
অমিতকুমার বিশ্বাস দক্ষ লেখনীতে লোকগানের সুরে পল্লির জীবনের আঁচ মেপেছেন বারুদগন্ধে। কিন্তু সেই তেজি আর্তনাদকে তিনি ডুবিয়ে দিয়েছেন কাব্যগন্ধী গদ্যে। লোকায়ত বাংলার সামগ্রিক সত্যকে নির্মাণ করেছেন মহাকালের বীণায়। ইতিহাস থেকে সমকাল, গোষ্ঠী থেকে ব্যক্তিমানস, ভাষাসংস্কৃতি থেকে কৃষিসংস্কৃতি, নিসর্গের মায়াবী বিচ্ছুরণ থেকে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যক্তিসহ সমষ্টির ভূমিকা, নদীসংস্কৃতির বদলে যাওয়া মানচিত্রে তিনি মানুষকে গ্রথিত করেছেন স্বদেশ সংস্কৃতির আটপৌর বিন্যাসে। একুশ শতকে কেমন আছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইছামতী তীরবর্তী বাংলা তা জানতে হাতে তুলে নিতে হবে ‘পাঁচকুড়ুনির মা’ আখ্যান।
যেসব পাঠক পড়তে আগ্রহী নন কিন্তু শুনতে আগ্রহী তাদের জন্য এই আয়োজন
পাঁচকুড়ুনির মা। অমিতকুমার বিশ্বাস। কবিতা আশ্রম। প্রথম প্রকাশ, মার্চ ২০২১। মূল্য ৩০০ টাকা।
পুরুষোত্তম সিংহ। ঘোষপাড়া, সুভাষগঞ্জ, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর। ৭৩৩১২৩। ৮৭৫৯১০৪৪৬৭।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।