উঠোনে জলের ছরা পড়ার আগেই আজ এ’বাড়ির দিন শুরু হয়ে গেছে। মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসতেই ঠাকুমা উশখুশ করতে লাগলো। ও দিদি, উঠতে হবে, ছাড়ো আমায় —এসব বলে আমার হাত সরিয়ে ঠাকুমা যখন ঘরের দুয়ারে দাঁড়ালো, তখন আকাশে ছিটেফোঁটা আলো। সেই আলোতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ঠাকুমাকে ছায়া বলে মনে হয়। আর ঐ দিকে কলঘরের বাইরে জ্বলতে থাকা টিমটিমে ইলেকট্রিক বাল্বের আলো উঠোন পেরিয়ে এদিক আসার আগেই তলিয়ে যাচ্ছে বিশাল ওই জামগাছের ছায়ায়। ঠাকুমা এক-পা, দু’-পা করে অন্ধকার উঠোনে নেমে পড়তেই আমি ফিসফিস করে উঠি,
“ও ঠাকুমা, একা ওদিকে যেও না”।
কিন্তু সে কথা ঠাকুমা শুনলে তো। আমাকে পেছনে ফেলে ঠাকুমা টুপ করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
আমি ঘরের মেঝেতে একা দাঁড়িয়ে।
“মনি, আমার কাছে আয়…” –
মনিপিসিরও আজ তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেছে। ঘরের ভেতর জ্বলতে থাকা ডিম আলোয় সবকিছু নীল হয়ে আছে।
– ও মনিপিসি, আজ ভোরে নদীর পাড়ে যাবে?
এতদিন হয়ে গেল, ঠাকুমা আর মনিপিসি শহরে এসেছে কিন্তু কোনোদিন ভোরেই মনিপিসিকে নদী দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়নি। বলা যায়, ভোরবেলা মানেই মনিপিসির আলিস্যি।
কিন্তু আজ যেন কী হল, মনিপিসি আমার কথায় সায় দিয়ে দিল,
“আর একটু আলো ফুটুক দাঁড়া”।
ঠাকুমা কলতলা থেকে স্নান সেরে চলে এল। হাতে কতগুলো কাঠটগর ফুল। ভাদুড়ি বাড়ির বাগান থেকে কাঠটগরের একটা ডাল আমাদের বাসার প্রাচীর পেরিয়ে এদিকে এসেছে। ঠাকুমা ওখান থেকে হাত বাড়িয়ে ক’খানা ফুল পেয়েছে,
“আজ একটু গোবিন্দকে ভোগ দেবো। সব জায়গার মঙ্গল-অমঙ্গল আছে তো।”
কথাগুলো যেন ঠাকুমা নিজেকেই বলল।
ঠাকুমা নিজের ব্যাগ থেকে একটা নিরামিষ বাটি বের করে কিছু সাবুদানা ভিজিয়ে দিল।
মুসা’র মা চলে এসেছে। উঠোনে জলের ছরা পড়ছে।
আমি আর মনিপিসি বেরিয়ে পড়লাম ভোরের নদী দেখবো বলে। বাসার সামনে ভরতের মা। আমাদের ফটক খোলা দেখেই এগিয়ে এল,
“মাইজি ও মাইজি…”
আমরা মসজিদের মাঠে খেজুর বাগানের তলায়। দূর থেকে ভেসে আসছে ঠাকুমা আর ভরতের মা’র গলা,
– বাড়ির পুজো…
– মাইজি আপ মেরে মা জ্যায়সি হো…
– আমাদের বাড়িতে একবার যেও…
– মন্দির মে মান্নাত করুঙ্গি…
আলটপকা কথাগুলো পেছনে ফেলে আমি আর মনিপিসি শিখাদিদিদের বাড়ি ছেড়ে এখন মুসা’র মা-দের পাড়ায়। ওই তো নদীর পাড়। রাস্তা থেকে উঁচু সেই পাড় নদীকে এখনো আমার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে। আমি মনিপিসির হাত ছেড়ে দৌড়ে উঠে যাই নদীর উঁচু পাড়ে। খাড়া পাড়ে পা ঝুলিয়ে বসি। ভোরের বাতাস নদীজল ছুঁয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। সেই বাতাসে উড়ছে আমার চুল,
“ও মনিপিসি, চুলগুলো একটু বেঁধে দাও না।”
হাতখোঁপা করে দিতেই আমি পাড় ধরে একটু নীচে নামলাম। আরেকটু এগোলেই জল ছোঁয়া যাবে।
আকাশের গা থেকে অন্ধকার মুছে গেছে। সাদাটে আকাশটা তিরতির করে কাঁপছে নদীর জলে। আমি আরেকটু নীচে নামি। মনিপিসিও এবার আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভোরের বাতাসে এখন শুধু নদীজলের সোঁদা ঘ্রাণ। এক পা দু’পা করে আমি নদীর কাছে এগোই। পা ডুবিয়ে দিতেই নদীজলে কেঁপে হারিয়ে গেল আকাশটা।
ও’পাড়ে জলের তলা থেকে সূর্য উঠছে। লালচে আলোয় ভরে গেল নদীর জল,
“ও মনিপিসি, আর ক’দিন বাকী আছে পুজোর? এবার আমাকে এমন রঙের জামায় ফুল তুলে দেবে কিন্তু।”
আমার এই কথাতে মনিপিসি কী বুঝল কে জানে? হাত টেনে আমাকে জল থেকে তুলে নিল,
“আজ চল্, অনেক কাজ আছে রে।”
নদীর জল ছেড়ে লাল আলোয় ততক্ষণে ভরে গেছে চারপাশ। আর আমরা বাসার পথ ধরতেই একটু আধটু রোদ মাটি ছুঁতে শুরু করল। ঠাকুমা এরমধ্যে সাবুর সবজি খিচুড়ি রান্না করে ভোগ দিতে বসে গেছে। আর মা কেরোসিন স্টোভে চড়িয়েছে চা।
আজ বাবা বড়বাজার যাবে। মাছের ট্রেন এসে থামে যে সেখানেই তো। বরিশালের ইলিশ হোক কিংবা খুলনার চিংড়ি, বাবা বড় বাজারেই পায়। তাই চা আর সলটেড বিস্কুট খেয়েই বাবা বেরিয়ে গেল।
আজ সকালের পাতে ঠাকুমা দিল ভোগের সাবুখিচুড়ি, তার সাথে মনিপিসির হাতে বানানো সাবুর পাঁপড়। পাত উঠে যেতেই মা ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। আমার অবশ্য আজ সেসবে মন নেই। স্কুল না যাবার আনন্দে আমি ঠাকুমার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াচ্ছি।
উঠোন জুড়ে ধুয়ে দেওয়া কাপড়ে জাম-জামরুল গাছের পাতা গলে পড়েছে রোদ। সে রোদ তেতে উঠছে একটু একটু করে। ভাদুড়ি বাড়ির বাগানে একটানা ডেকে চলেছে ঘুঘুপাখিটা।
আমাদের বাজারের ব্যাগ উঠোনে পড়ল। মুসা’র মা কচুর পাতায় ব্যাগ উপুড় করতেই বেরিয়ে এল বরিশালী চওড়া ইলিশ আর বেলেমাছ। চকচকে বেলে মাছগুলো নদীর মাছ, বড়বাজারে খুব কমই এমন মেলে।
ঠাকুমার খুব পছন্দের মাছ এটা। এ ক’দিনে বাবা এই মাছ জোগাড় করে উঠতে পারেনি। কিন্তু আজ মিলে যেতেই নিয়ে এসেছে।
আজ খুব বেশি পদ হবে না। যত তাড়াতাড়ি রান্নার পাঠ শেষ করে ফেলা যায় আর কি। ইলিশের জ্বালের ঝোল হবে, হাতে মাখা সেদ্ধ লাউশাক আর বেলেমাছের পাতুরি। কেরোসিনের স্টোভে নীল আঁচ জ্বলে উঠল। সব মশলা, অনেকগুলো কাঁচামরিচ আর সর্ষের তেল মেখে ইলিশমাছের জ্বালের ঝোল ঠাকুমা বসিয়ে দিল। ভাদুড়ি বাড়ির লাউয়ের মাচা থেকে মুসা’র মা কচি দেখে কতক লাউপাতা এনে দিল। সেই পাতার শিরা ছিড়ে একপাশে সরিয়ে রাখল ঠাকুমা।
মনিপিসি সর্ষে আর কাঁচামরিচ বাটতে বসে গেল,
“মনি, তোর বইগুলো নিয়ে নিস কিন্তু।”
– পুজোর মধ্যেও আমারে পড়তে হবে?
প্রশ্নটা আমার মুখে আসার আগেই মা’র উত্তর,
“পুজোর পরেই পরীক্ষা, পড়তে হবে তো।”
আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও মা বই গোছাতে লাগল।
উনুন থেকে ইলিশের জ্বালের ঝোল নেমে যেতেই ভাতের হাঁড়ি সেখানে বসল। আজ ঝিঙেশাইল চালের ভাত হবে। ঠাকুমা আর দেরি করে না। হলুদ, লবণ আর সর্ষেবাটায় বেলে মাছগুলো মেখে নিল তাড়াতাড়ি। দুটো করে লাউপাতা বিছিয়ে তাতে শুইয়ে দিল সর্ষেমাখা হলুদ বেলে। তার উপর বুকচেরা কাঁচামরিচ আর খানিক সর্ষের তেল। এরপর পাতা মুড়িয়ে ভালো করে ঢেকে নিল মাছগুলো।
স্টোভের আঁচে ভাতে উতোল এল। ঠাকুমা ঢাকনা তুলে ভাতগুলো নেড়ে তাতে মিশিয়ে দিল আলাদা করে রাখা লাউপাতা।
– ও ঠাকুমা, বেলেমাছের পুঁটুলিগুলো দিলে না?
ঠাকুমা হাসে, “দেবো দিদি, ভাত আরেকটু বলক হোক।”
ভাতের বলকে এখন লাউপাতার ঘ্রাণ। ঠাকুমা এবার স্টোভের আঁচ কমিয়ে বলক ওঠা ভাতের ভেতর বেলেমাছের পুঁটুলি ফেলে দিল।
উঠোনের মেলে দেওয়া কাপড় জলঝরে এখন বাতাসে উড়ছে। দুপুরের আজান পড়ে গেল। মনিপিসি স্নান করে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে। আমিও কলতলা থেকে ক’ঘটি জল ঢেলে এলাম।
ভাত হয়ে গেছে। ঠাকুমা ভাতের হাঁড়ি উপুড় দিল। ঢাকনা গলে পড়ছে হলুদ সবজে মাড়, তাতে সর্ষে আর লাউপাতার ঘ্রাণ।
– ও দিদি, দেরি কোরো না, খেতে বসো।
আজ পাতে ভাত দেবার আগেই ঠাকুমা ডাকছে। আমি খালি পাতের সামনে বসতেই ঠাকুমা একহাতা সবজে ভাত ঢেলে দিল। তাতে ক’খানা সেদ্ধ লাউপাতা জড়ানো। পাতের একপাশে লাউপাতাগুলোয় একটু লবণ আর সর্ষের তেল ঢেলে দিল,
“ও দিদি, মাখিয়ে খাও।”
আমি লাউপাতা ফেলে খানিক ভাত মুখে দিলাম। লাউপাতার ঘ্রাণে ভাতগুলো মৌ মৌ করছে। ঠাকুমা পাতে দিল মাছের ভাপা পুঁটুলি। পাতায় মোড়ানো বেলেমাছ সেদ্ধ হয়ে খুলে খুলে পড়ছে। সেখান থেকে খানিক মাছ তুলে মুখে দিতেই মোমের মতো গলে গেল,
“ও ঠাকুমা, মাছেও তো লাউপাতার ঘ্রাণ!”
ঠাকুমা হাসে।
আজ দুপুরের পাত উঠে গেল তাড়াতাড়ি। বাসার ফটকে রহিম চাচার রিক্সা এসে দাঁড়াল। পেছনে আরও একটি রিক্সা। বাবা পাঠিয়েছে।
পুজোর বেশ আগেই আমি বাড়ি যাচ্ছি, বাদলবাড়িতে ঠাকুমার মানত আছে যে আমাকে নিয়ে।
– ও ঠাকুমা, তাঁতঘরে নতুন নকশা উঠেছে, তাই না? পাল কি বাড়িতে চলে এল? গোলেনূর দাদির সুপারি বাগানে রঙ ধরেছে কি? বাইরবাড়িতে আউশের পালা পড়েছে কি? — আমার অজস্র প্রশ্নের ভেতর ঘুরে বেড়ানো বাড়ি যাবার আকুতি ঠাকুমা কীভাবে যেন বুঝে ফেলে,
“ও দিদি, বাড়িটা কতদিন পর তার আসল মানুষকে দেখতে পাবে বল!”
বাড়ির দিকে ছুটতে থাকা বাসে আমি আর ঠাকুমা পাশাপাশি বসা। দু’জনেই সামনের দিকে তাকিয়ে। বাতাসে চোখ ভাসিয়ে বাড়ি খুঁজছি আমরা। আর ঠিক কতদূর গেলে আমাদের বাড়ি পাওয়া যাবে?