নদীর বুকে জমে থাকা মিহি কুয়াশা জল ছুঁয়ে উঠে আসে ডাঙায়। মাঠের খেজুর গাছগুলো চোখকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে পড়ে রাতের আকাশ থেকে নেমে আসা নীহারে। উঠোনের খানিক উপরে ভাসতে থাকা সাদা কুয়াশায় হাত লাগাতেই ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে ওদের আপন আগল। আর সেই জলে আমি বারান্দায় আঁকি আলপনা, জলের আলপনা।
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ফুরিয়ে গেছে অগ্রহায়ণের নগরকীর্তনও। তবে বাড়ি ফেরার কড়ে গোনা দিন এখনো শেষ হয়নি আমার। ক-দিন আগেই পিয়ন চাচা লাল ঝুলি থেকে দিয়ে গেছে চিঠি। পোস্টকার্ডে লেখা চিঠি। গোটা শব্দের সে চিঠিতে যতটুকু বাড়ি আর নিজের কথা লেখা তারচেয়ে অনেক বেশি লেখা আমার কথা। কেমন হল আমার পরীক্ষা, কতটুকু বড় হলাম আমি, এখনো পাতের খাবার না ফুরাবার অজুহাত খুঁজি কিনা, বাড়ির কথা মনে করে মনমরা হয়ে থাকি কিনা—কতশত প্রশ্ন! সেই পোস্টকার্ড আমি বারবার পড়ি, অনেকবার পড়ি। বিছানার তোষকের তলা থেকে সুযোগ পেলেই বের করে সামনে ধরি সেই পোস্টকার্ড,
মা… ও মা…. ঠাকুমা আর কী লিখেছে? বাইরবাড়ির অর্জুন গাছে ফল এসেছে এবার? গোলেনূর দাদীর তেজপাতা গাছে নতুন পাতা এল? এবার কি পাটাই ব্রত করবে ঠাকুমা?
কতশত প্রশ্ন আমার। বারবার পোস্টকার্ড ছুঁয়ে আমি বারবার ঠাকুমাকেই ছুঁয়ে থাকি। আমি বারবার মনে করতে চাই বাড়ির কথা—যে বাড়িতে আমার জন্য কোনোকিছুতে বারণ নেই, যে বাড়ির প্রতিটি কোণায় স্নেহের এক অকৃত্রিম জগত আমার জন্য হাত বাড়িয়ে অপেক্ষায় থাকে।
আর এদিকে আমি শহরের এই নিয়মের জগতে একটু একটু বাঁধা পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে উঠি, বিড়বিড় করে বলি,
বাড়ি যাব… আমি কবে বাড়ি যাব?
আমার প্রশ্নের উত্তরে বারবার সামনে এসে দাঁড়ায় নতুন বছরের নতুন বই, নয়তো দীপংকর স্যারের দিয়ে যাওয়া দিস্তার খাতায় পাটিগণিত। আমি যতই মন দিয়ে তা শেষ করি না কেন, লালকালির দাগে বারবার বলে দেওয়া হয়—আমাকে আরও পড়তে হবে, স্কুল শুরুর আগেই আমাকে শিখে ফেলতে হবে সব পাটিগণিত। নতুন ক্লাসের বই নাকি আগে থেকে এগিয়ে না রাখলে আমি পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়বো ক্লাসে।
আর এজন্যই বাড়ি যাবার সব বায়নায় আড়ি দিয়ে আমাকে সকাল হতেই বসে যেতে হয় বইখাতা নিয়ে। নতুন ক্লাসের বই এনে অগ্রিম অংক শিখতে বসেছি আজ সকালের কুয়াশায় রোদের মিঠে ওম পড়তেই। পাশেই কেরোসিনের স্টোভ থেকে নেমেছে আদা আর খেজুরের গুড়ের চা। সেই চায়ের কাপ বাবার কাছে পৌঁছে দিয়েই মা এসে বসেছে স্টোভের আঁচ কমিয়ে আমার পাশে। অনেক বায়নার পর আজ আমার জন্যও কাপে পড়েছে খানিক খেজুর গুড়ের চা। সেই চায়ে বাড়ি থেকে ঠাকুমার পাঠানো আমন ধানের লাল মুড়ি ফেলি আমি। চামচ ডুবিয়ে সেই চায়ে ভেজানো মুড়ি দু-চারটা মুখে পুরি, তো বাকি সময় গল্প জুড়ি নতুন বইয়ের,
ও মা… জানো, এবারের অংকগুলো আমি তাড়াতাড়ি শিখে ফেলবো
অথবা,
সমাজ বইটা খুব সহজ, একটু পড়লেই মনে থাকে সব…
চা জুড়িয়ে এসব কথার ফাঁকে আমি ঘুরেফিরে সেখানেই ফিরি,
অংক সব শেখা হয়ে গেলে তখন বাড়ি যাবো আমরা, তাই না মা?
স্টোভের আঁচ বাড়িয়ে মা হাসে,
যাবো তো বাড়ি, ক-দিন পরেই যাবো….
আমাকে আবার অপেক্ষার পথ দেখিয়ে মা সকালের পাতে ফেলার জন্য বানাতে শুরু করে তিনকোনা পরোটা আর ফুলকপি ভাজা।
শীতের রোদে ওম আরেকটু বাড়ে। উঠোনের ওপর ভেসে থাকা কুয়াশা কখন যে ছু-মন্তর হয়ে উড়ে গেছে তাও টের পাওয়া যায়নি। বারান্দার এককোনায় রাখা মাটির বড় হাঁড়িটা থেকে বাঁশের ঝাঁঝরি উঠে গেছে বেশ অনেকটা সময়। সেখানে নদীর জলে জিইয়ে রাখা কৈ মাছগুলো এখন উঠোনে খববল করে বেড়াচ্ছে। মুসার মা মোড়ের চায়ের দোকান থেকে ছাই এনে বসে গেছে সেগুলোকে কাটতে।
কাল সারারাত শুকনো শিমের বিচি জলে ডুবিয়ে রেখেছিলো মা। আজ দুপুরে রান্না হবে কৈ-এর মৌলি। ঠাকুমার মায়ের এই পদ ঠাকুমার হাত হয়ে এখন মায়ের কাছে এসেছে। এই পদ বাড়িতে হলেই দাদুর পাতে দু-মুঠো ভাত বেশি দিত ঠাকুমা আর নিজের জন্য শেষ পাতে আমে ফলসির টক বাদ দিয়ে তুলে নিত কৈ-মৌলির শিম বিচি। যতটুকু খেত, তার চেয়ে বেশি গল্প হত নাটোরের লালদীঘির। গল্পে গল্পে বলত—কীভাবে সেই দীঘিতে ডুব দিয়ে এসে ঠাকুমা খেতে বসত কৈ-মৌলি।
দুপুরের পাতে আজ পড়বে বাঁধাকপির ঘণ্ট, শিম সর্ষে আর কৈ-মৌলি।
টাইমকলে জল এসেছে। জেট গুঁড়ো সাবানের গন্ধমাখা ভেজা কাপড় পড়েছে শীতের নরম রোদে। সেই রোদে কাপড়গুলো দুলে দুলে ছবি আঁকে অলস সময়ের। আমি ফটকের সামনের এক টুকরো উঠোনে কখনো টক বেগুনে খেলনাবাটি খেলি, আবার কখনো ঘর টেনে পাঁচগুটি খেলি। তবে এসব খেলায় কেউ গলা মিলিয়ে আমার সঙ্গে বলে না,
তেলোটা কামিনী
গুটিকে যামিনী
ও তিনশো টাকা
চার শো দানা
পঞ্চমীটা কানা….
সঙ্গিহীন আমি একা একাই ছড়া কাটি।
স্টোভের নীলচে আঁচের জোর বাড়ল। এবার রান্না হবে কৈ-মৌলি।
কালো কৈ-এর গায়ে পড়েছে হলুদ। তাতে লবণ আর একটু তেল দিয়ে মাখিয়ে নিল মা। কড়াইয়ের তেল তেতে ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করেছে এরইমধ্যে। সেই তেলে মাছগুলো পড়তেই বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো শীতের তেলভরা কৈ-এর এক অদ্ভুত সুঘ্রাণ। মাছগুলো উল্টেপাল্টে সাঁতলে নিল মা।
মুসার মা শিলপাটায় বেটে দিলো কাঁচামরিচ আর জিরে। চন্দনের মতো মিহি এই বাটনা।
এবার মাছগুলো তুলে কড়াইয়ে ফেলা হল আরও খানিক তেল। তেলে পড়ল সর্ষে ফোড়ন। ফোড়ন ঘ্রাণ ছাড়লেই তাতে কাঁচামরিচ আর জিরে বাটা দিয়ে দিল মা। হলুদ আর লবণ ফেলে কষিয়ে নিল ভালো করে। মসলা তেল ছাড়তেই মা তাতে সেদ্ধ শিমের বিচি ঢেলে দিল। একটু নেড়ে এবার পড়ল ঢাকনা কড়াইয়ে।
বেলা পড়েছে বারবেলায় অনেকক্ষণ। উঠোনের রোদের এখন মিশেছে নদীর হিম বাতাস। সেই রোদে স্নান শেষে আমি বসেছি চুল শুকোতে। হাতে ধরা ভাজা চালডালের আনন্দনাড়ু।
ক-দিন আগে বাড়ি থেকে সঞ্জীব কাকু এসেছিল নতুন ধানের চাল, নতুন বছরের মুগডাল, ঝোলা গুড়ের হাঁড়ি, আমন ধানের মুড়ি আর আনন্দ নাড়ু সঙ্গে নিয়ে। কড়মড় করে সেই নাড়ু খেতে খেতে বারবার রুটি জ্বালের কথা মনে পড়ছে আমার আজ। শীত এলেই ঠাকুমা নতুন গুড়ে রুটি জ্বাল দেয়। নাড়ুতে সেই নতুন গুড়ের ঘ্রাণ।
এবারের চিঠিতে ঠাকুমাকে লিখতে হবে রুটি জ্বালের কথা। আমার ইচ্ছে জানলে সব ফেলে ঠাকুমা রুটি জ্বাল বানিয়ে ঠিকঠিক শহরের এই বাসায় হাজির হবে, আমি খুব ভালো করে জানি তা।
ভাবনাটা কী করে যেন মুসার মা বুঝে ফেলে,
দ্যাশের কথা ভাবতিছো?
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে আবার মন দিই আনন্দ নাড়ুতে।
কড়াইয়ে এবার গরমজল পড়েছে ঝোলের। সেই জল ফুটছে টগবগ করে। ফুটন্ত ঝোলে এবার পড়লো সাঁতলানো কৈ মাছ আর অনেকগুলো বুকচেরা কাঁচামরিচ। একটু পরেই এই ঝোলে মৌরি বাটা মিশিয়ে নামিয়ে নেবে।
রোদের ওমে টান পড়লো হঠাৎ করেই। জাম-জামরুলের পাতায় জমতে শুরু করেছে তেজহীন শীতের শেষবেলা। একটা দুইটা চড়ুই কিচিরমিচির করে উঠছে থেমে থেমে।
বারান্দায় পাত পড়ে গেল দুপুরের। পাতের ভাতে বারবেলার রোদ। সেই রোদ একটু একটু নিভে যাচ্ছে শেষবেলার শীনশীনে বাতাসের তোড়ে। ওমহীন রোদে এখন শুধুই জাম-জামরুলের ঝরে পড়া পাতার ঘ্রাণ।